ওবাইদুল আকবর রুবেল, ফটিকছড়ি (চট্টগ্রাম)
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৫ ১২:৫৬ পিএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৫ ১৩:৫৬ পিএম
চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাটের নেপচুন চা-বাগানে পাতা সংগ্রহে ব্যস্ত নারী শ্রমিকরা
প্রতিদিন সকালে কিংবা কাজের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে আমাদের ক্লান্তি দূর হয় না। আড্ডায়-বিনোদনেও চায়ের জুড়ি নেই। অথচ আমরা অনেকেই জানি না চা উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের নিষ্পেষিত জীবনের কথা।
আঠারো শতকে উপমহাদেশের চট্টগ্রামে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও দুটি শতক। সাদা-কালোর জগৎ ছেড়ে আমরা অনেক আগেই প্রবেশ করেছি বর্ণময় রঙিন পৃথিবীতে। কিন্তু আজও চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির চা-বাগান শ্রমিকরা সাদা-কালো যুগের সেই ছন্দহীন জীবনেই বাস করছেন। আজও তাদের জোটেনি যুগের সঙ্গে তাল মেলানো মজুরি। নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা, চোখে পড়ার মতো স্যানিটেশন ব্যবস্থা, নেই নারী-শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তাও। এ যেন আলোর নিচে অন্ধকারের প্রকৃত উদাহরণ।
মূল্যস্ফীতির এই সময়ে দৈনিক ১৭৮ টাকা মজুরিতে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন ফটিকছড়ি উপজেলার ১৮টি চা বাগান শ্রমিকরা। প্রতি বছরই মে দিবস আসে যায়। কিন্তু রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুঁড়ি আর দুটি পাতা ছিঁড়ে শৌখিন মানুষের কাছে চা পৌঁছে দেওয়া শ্রমিকদের ভাগ্যের বদল হয় না।
মে দিবস কেমন কাটে, মে দিবস নিয়ে তাদের দাবি-দাওয়াইবা কেমন এসব জানতে সরজমিনে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির নারায়ণহাট ইউনিয়নের নেপচুন চা বাগানে গেলে শ্রমিক তাহেরা বেগম হতাশার সুরে জানান নিজেদের সুখ-দুঃখের কথা। তিনি বলেন, ‘রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারা দিনে চা পাতা তুলে মজুরি পাই ১৭৮ টাকা। এ টাকায় তো এখন দুই কেজি চালও হয় না।’
স্বল্প মজুরিতে কীভাবে চলে সংসারÑ জানতে চাইলে একই বাগানের শ্রমিক হনুফা বেগম বলেন, ‘এখানে অনেক পরিবারেই সদস্য পাঁচ থেকে ছয়জন। পরিবারের একজন হয়তো কাজ পায়। তার আয়ের ওপর নির্ভর করেই বাকিদের চলতে হয়। ছোট ভাঙাচুরা ঘরে গবাদি পশুসহ সন্তানদের নিয়ে থাকতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাগান কর্তৃপক্ষের ঘর মেরামত করে দেওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয় না বছরের পর বছর। আমাদের কোনো নিজস্ব জায়গা নেই। বাগানে কাজ না করলে থাকার জায়গাও হারাতে হয়।’
চা শ্রমিক ও পঞ্চায়েত নেতাদের অভিযোগ অধিকাংশ চা বাগান কর্তৃপক্ষ শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারও যথাযথ পূরণ করে না। এ ছাড়া শ্রম আইন এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির শর্তগুলোও সঠিকভাবে মানা হয় না।
চা শ্রমিকরা জানান, চা শিল্পের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক বংশপরম্পরায়। তাদের শ্রমে-ঘামে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও তাদের ভাগ্যের চাকা ঘুরেনি। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দিনভর খাটুনির পর একজন স্থায়ী শ্রমিক যা মজুরি পান, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, সুপেয় পানিসহ মৌলিক সব সূচকেই তারা পিছিয়ে। জরাজীর্ণ বাসস্থান আর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকায় বাগানের নারী ও শিশুরা বিভিন্ন রোগে ভুগছে।
কৈয়াছড়া চা বাগানের চা শ্রমিক আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমরা যারা চা বাগানের বাইরে পরিবার নিয়ে বসবাস করি তাদের বিভিন্ন বঞ্চনার শিকার হতে হয়। যে টাকায় বাগানে কাজ করি, তাতে কোনোমতে সংসার চালাতে হয়।’
একই কথা বলেন সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন কর্ণফুলী চা বাগানের শ্রমিক কৃষ্ণ মনি। প্রতিদিন সকাল ৯টায় চা পাতা সংগ্রহের কাজ শুরু করে তা টানা চলে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। বাগানের কাছেই ঘর হলেও দুপুরে খেতে যাওয়ার সময় নেই। দিন শেষে মেলে ১৭৮ টাকা। কৃষ্ণ মনির মতো চা বাগানের সব শ্রমিকেরই একই নিয়মে দিন কাটে। মজুরি নিয়ে অভিযোগ প্রায় সবারই।
কষ্টের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল চোখে অঞ্জনি ত্রিপুরা বলেন, ‘যৎসামান্য বেতনে পরিবার নিয়ে চলা কষ্টের।’ সামনে ঝড়-বাদলের দিনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাগান কর্তৃপক্ষ রেইনকোট দেয় না, দেয় একটি প্লাস্টিক, তাতে শরীর ভিজে যায়।’
পঞ্চায়ত নেতা মৃদুল কর্মকার বলেন, ‘চা শ্রমিকদের শ্রমে-ঘামে এ শিল্পের প্রসার হলেও দারিদ্র ও বঞ্চনা তাদের পিছু ছাড়ে না। মে দিবস এলেই আমরা নানা প্রতিশ্রুতি শুনি, কিন্তু তার বাস্তবায়ন দেখি না। উন্নয়নের গল্প শোনানো হয়, কিন্তু আমাদের জীবনযাত্রায় কোনো পরিবর্তন আসে না।’