× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

৪৫ কোটি টাকার সান্ত্বনা!

আরমান হেকিম

প্রকাশ : ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ১১:০৬ এএম

৪৫ কোটি টাকার সান্ত্বনা!

রেলের বহুল আলোচিত লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) দুর্যোগে এবার দায়সারা ভঙ্গিতে এগিয়ে এসেছে কোরিয়া সরকার। ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকায় আমদানি করা ৩০টি ‘ক্লাস ৩০০০’ মিটারগেজ ইঞ্জিনের একটির পর একটি বিকল হওয়ার পর পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা ৪৪ কোটি ৯২ লাখ টাকার একটি অনুদান প্রকল্প হাতে নিয়েছে। হুন্দাই কোম্পানির অনুদান প্রকল্পের মাধ্যমে কিছু যন্ত্রপাতি সরবরাহ, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতিতে কিছু সংস্কার আনার কথা বলা হয়েছে। 

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে এই অনুদান প্রকল্পে রেলওয়ের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই বরং এটি মূল ব্যর্থতার দায় এড়িয়ে যাওয়ার একটি চেষ্টা মাত্র।

২০২১ সালে কোরিয়ার হুন্দাই থেকে আমদানি করা ৩০টি ইঞ্জিন এখন রেলের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই বছর যেতে না যেতেই নষ্ট হয়ে অচল হয়ে পড়েছে। যা মেরামত করার সক্ষমতা নেই বাংলাদেশ রেলওয়ের। তাই ইঞ্জিনগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে সরকারি সেবামূলক এই সংস্থাটি। সেখানে না পারছে গিলতে না পারছে ফেলতে অবস্থা বিরাজ করছে। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আমদানি করা ইঞ্জিনের লাইফ টাইম ২০ বছর ধরা হলেও ইতোমধ্যে পাঁচটি ইঞ্জিন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। এর মধ্যে স্পেয়ার পার্টস দুষ্প্রাপ্যতা ও কারিগরি অজ্ঞতার কারণে বিকল ইঞ্জিনগুলো সচল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার ১০টি ইঞ্জিনের ৪টি মোটরের মধ্যে ২টি করে মোটর নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ২টি মোটর নিয়ে ফুল স্পিড নিয়ে চলতে পারছে না। কোথাও লাইন একটু উঁচু হলে রাস্তায় থেমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। ব্রীজ অতিক্রম করতে বেগ পেতে হচ্ছে। বাকি ১৫টা কোনো রকমে চলছে। এসব ইঞ্জিন নতুন প্রযুক্তির হওয়ায় এগুলোর কাজ করার মতো অভিজ্ঞতা সম্পন্ন প্রকৌশলী রেলে নেই। অথচ পুরাতন অনেক ইঞ্জিন আছে, যার বয়স ৪০ বছর হলেও এখনও ভালোভাবেই চলছে।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, অর্ধেক ইঞ্জিন পড়ে থাকে মেরামতের জন্য। রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রকৃতপক্ষে দক্ষতা এবং যন্ত্রাংশের ঘাটতির কারণেই এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। 

এ পরিস্থিতিতে কোরিয়া সরকার ‘ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট অব রোলিং স্টক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স ফর বাংলাদেশ’ নামে প্রকল্পের আওতায় ৩৮টি যন্ত্রপাতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি দেশের ও বিদেশের প্রশিক্ষণ, মানসম্পন্ন রক্ষণাবেক্ষণ পদ্ধতির বিকাশ এবং বিদ্যমান সক্ষমতা উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) আহমেদ মাহবুব চৌধুরী জানিয়েছেন, প্রকল্পে প্রস্তাবিত যন্ত্রপাতির তালিকা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সীমিত। তিনি বলেন, ‘আমরা উচ্চমূল্যের আরও কার্যকর যন্ত্রপাতি চেয়েছি। শুধুমাত্র কিছু কমপ্লায়েন্স মেশিন এনে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।’

প্রকল্পের মোট ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪৪ কোটি ৯২ লাখ টাকা অনুদান হিসেবে দিচ্ছে কোরিয়া, আর ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ ও কোরিয়ার মধ্যে এই প্রকল্প নিয়ে আলোচনা শেষ হয়েছে এবং দুই দেশের মধ্যে রেকর্ড অব ডিসকাশন (আরওডি) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অনুদান প্রকল্প মূল সমস্যার শেকড় স্পর্শ করছে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক বলেন, ‘এটা একজনকে ঠকিয়ে আরেকজনের দেনা শোধ করার মতো। ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার ক্ষতির বিপরীতে ৪৪ কোটির অনুদান কখনই যথেষ্ট হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যখন রেলওয়ের নেটওয়ার্ক ধীরে ধীরে ব্রডগেজ ও ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত হচ্ছে, তখন মিটারগেজ লোকোমোটিভ কেনা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। এ ধরনের ভারী ও কম গতিসম্পন্ন ইঞ্জিন বহু রুটে চলতে পারে না, আর এর রক্ষণাবেক্ষণও কঠিন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এগুলোতে নিম্নমানের ইঞ্জিন ব্যবহারের ফলে নিয়মিত ব্রেকডাউন হচ্ছে, অথচ কার্যকর মেরামতের তেমন কোনো সুযোগও নেই।’

রেল মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা যদিও বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে কর্মরত ইঞ্জিনগুলোর ব্যবহারযোগ্যতা বাড়বে, যাত্রীসেবা বাড়বে এবং আয়ের পরিমাণও বাড়বে, তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা।

রেলওয়ের কর্মকর্তারাই স্বীকার করছেন যে, লোকোমোটিভগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত না করেই এগুলো চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তদুপরি, নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বা অর্থায়নকারী সংস্থাগুলোর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সার্ভিস ওয়ারেন্টি বা খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ চুক্তি ছিল না, যা প্রকল্প পরিকল্পনায় মারাত্মক ভুল বলে ধরা হচ্ছে।

যন্ত্রপাতির নতুন তালিকা চূড়ান্ত করতে রেল সচিবের সভাপতিত্বে সভা হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। মেকানিক্যাল বিভাগ সংশোধিত তালিকা দিলেও তা নিয়েও অসন্তুষ্ট রেলওয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

সব মিলিয়ে, ১ হাজার ১৪৮ কোটি টাকার ক্ষতির দায় এখন চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিছু প্রযুক্তিগত দুর্বলতার ওপর, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এই ক্ষতির দায় বহন করছে দেশের জনগণ। ৪৪ কোটির অনুদান প্রকৃত ব্যর্থতার প্রতিকার নয়Ñ এটি বরং রেলওয়ের পরিকল্পনায় ভয়াবহ দূরদর্শিতার অভাবের প্রমাণ হিসেবেই থাকছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে প্রয়োজন গভীর প্রযুক্তিগত মূল্যায়ন, বাস্তব সক্ষমতার নিরীক্ষা এবং নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর কার্যকর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। অন্যথায়, এমন বড় অংকের আরও অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশকে।

উল্লেখ্য, ৩০টি লোকোমোটিভ কেনার প্রকল্পে অর্থায়ন করেছিল এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এবং কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ)। ৩০টি লোকোমোটিভের মধ্যে ১০টি এসেছে এডিবির অর্থায়নে, আর বাকি ২০টি ইডিসিএফের অর্থায়নে। অথচ প্রকল্পটি গ্রহণের সময় এসব ইঞ্জিন দেশের পরিবেশ ও রেলপথের উপযোগী কি না সে বিষয়ে কোনো নিরীক্ষা বা মূল্যায়ন হয়নি বলে জানা গেছে।


শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা