তানভীর হাসান
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:০১ এএম
আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২৫ ১০:৪৮ এএম
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তীতে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন ১৪৩ জন ভিআইপি। তাদের মাঝে ১২৮ জন আদালতের নির্দেশে কারাবিধি অনুযায়ী ডিভিশন পেয়েছেন। আটক এসব ভিআইপি বন্দি নিয়ে বিপাকে রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ।
কারা সূত্রে জানা গেছে, অন্যায় আবদার মেটানো না হলে কথায় কথায় হুমকি দেওয়া ভিআইপি বন্দিদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কারা সেলে গরমে হাঁসফাঁস করে অনেকে আবদার করেছেন এয়ারকুলার ও চার্জার ফ্যানের। কারও আবদার কদিন পর পর স্বজনদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে চাওয়া। অনেকে চান তিনবেলা পরিবারের রান্না খাবার। কেউ চান ঘুমানোর জন্য নরম বিছানা। অথচ কারাবিধি অনুযায়ী এসব সুবিধার কোনোটিই দেওয়ার নিয়ম নেই। অনেকে অসুস্থ না হয়েও থাকতে চান হাসপাতালে। এ অবস্থায় তাদের দেখভালের সহকারীরাও (তারাও কারাবন্দি) দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাচ্ছেন। এসব এখন কারাগারে ‘ওপেন সিক্রেট’। তবে মুখ খুলতে নারাজ কারা কর্তৃপক্ষ।
এসব নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন জাহাঙ্গীর কবির প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘জেল কোড অনুযায়ী সবাই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ডিভিশনপ্রাপ্তরাও তাদের নির্ধারিত সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। এখানে কারো অন্যায় আবদারে নিয়মের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়া কারা চিকিৎসকের পরামর্শের বাইরে কাউকে হাসপাতালে রাখারও সুযোগ নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদি কাউকে হাসপাতালে পাঠানো হয় তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা শেষে রোগীকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়। সেখানেও পাহারার জন্য কারারক্ষী রাখা হয়। একজন ডেপুটি জেলার সার্বক্ষণিক তাদের নজরদারিতে রাখেন।’
ভিআইপি কারাবন্দিদের হুমকি-ধমকি প্রসঙ্গে বলেন, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর কয়েকজনকে সতর্ক করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এমন আচরণ করলে জেল কোড অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কারা সূত্র জানায়, কারাবিধি অনুযায়ী সাবেক এমপি, মন্ত্রী ও সরকারি কর্মকর্তাসহ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা কারাগারে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বা ডিভিশন পান। এজন্য যেকোনো বন্দি নিজের সামাজিক অবস্থান তুলে ধরে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে আবেদন করতে পারেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আদালত যদি কোনো বন্দির ডিভিশন সুবিধার আবেদন মঞ্জুর করে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন তখন সেই বন্দিকে ডিভিশন সুবিধা দেওয়া হয়।
কারা কর্মকর্তারা জানান, ‘তিন শ্রেণির ডিভিশন দেওয়া হয়। ডিভিশন-১, ডিভিশন-২ ও ডিভিশন-৩।’
জেলকোডের ৬১৭ বিধিতে বলা আছে, ‘যারা ভালো চরিত্রের অধিকারী ও অনভ্যাসগত অপরাধী; সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে যাদের জীবনযাপনের ধরন উচ্চমানের এবং যারা নৃশংসতা, নৈতিক স্খলন এবং ব্যক্তিগত প্রতিহিংসামূলক অপরাধ বা বিস্ফোরক আগ্নেয়াস্ত্র সঙ্গে রাখা, সম্পত্তি সংক্রান্ত মারাত্মক অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত নন বা অন্য কাউকে এসব অপরাধ করতে প্ররোচিত বা উত্তেজিত করেনি তারা ডিভিশন-১ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন।’
এ ছাড়া বিধি ৬১৭ (২)-এ বলা হয়েছে, ‘নাগরিকত্ব নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে জীবনযাপনের ধরন উচ্চমানের বন্দিগণ ডিভিশন-২ প্রাপ্তির যোগ্য হবেন। অভ্যাসগত বন্দিগণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই শ্রেণির বহির্ভূত হবে না, সরকারের অনুমোদন বা পুনর্বিবেচনার শর্তে শ্রেণি বিভাজনকারী কর্তৃপক্ষকে বন্দির চরিত্র এবং প্রাক পরিচিতির ভিত্তিতে এ শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য ক্ষমতা দেওয়া হবে। যেসব বন্দি ডিভিশন ১ ও ২-এর অন্তর্ভুক্ত নয় তারা তৃতীয়টির অন্তর্ভুক্ত হবেন, যেখানে বলা হচ্ছে, আদালত কোনও বন্দিকে ডিভিশন ১ ও ডিভিশন ২ প্রদানের জন্য প্রাথমিক সুপারিশটি সরকারের অনুমোদন কিংবা পুনর্বিবেচনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন এবং মন্ত্রণালয় সেটি অনুমোদন বা পুনর্বিবেচনা করবেন।’
ডিভিশনপ্রাপ্তরা কী ধরনের সুবিধা পান জানতে চাইলে একজন কারা কর্মকর্তা বলেন, ‘বিধি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির ডিভিশনপ্রাপ্ত প্রত্যেক বন্দির জন্য আলাদা রুম থাকে। খাট, টেবিল, চেয়ার, তোশক, বালিশ, তেল, চিরুনি, আয়না সবকিছুই থাকে। তার কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য আরেকজন বন্দিও দেওয়া হয়। ছেলে বন্দির ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসেবে ছেলে আর মেয়ে বন্দির জন্য একজন মেয়ে থাকবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি বইপত্র পান এবং তিনটি দৈনিক পত্রিকা পান। সাধারণ বন্দিদের চেয়ে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির খাওয়ার মানও ভালো থাকে।’
কারা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গণহত্যায় জড়িতসহ বিভিন্ন অপরাধে কারাগারে আটক ১৪৩ ভিআইপি বন্দির মধ্যে ১২৮ জন ডিভিশন পেয়েছেন। তাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী ৩৯ জন; সাবেক সংসদ সদস্য ২৭ জন; সরকারি কর্মকর্তা ৪৭ জন এবং অন্যান্য শ্রেণি-পেশার ১৫ জন। ভিআইপি হিসেবে কারাগারে আটক ১৫ জন এখনও ডিভিশন পাননি। যাদের মধ্যে পাঁচ জন সাবেক সংসদ সদস্যও রয়েছেন। বাকিরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার।
কারা সূত্রমতে, ডিভিশন পাওয়া বন্দি হিসেবে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে আছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক মন্ত্রী দীপু মনি, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, টিপু মুনশি, নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, নুরুল ইসলাম সুজন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আসাদুজ্জামান নূর, কামরুল ইসলাম, সাধন চন্দ্র মজুমদার, ইমরান আহমেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলাম, রমেশ চন্দ্র সেন প্রমুখ। এ ছাড়া আছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ, ফরহাদ হোসেন, শহিদুজ্জামান সরকার, মাহবুব আলী, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাকির হোসেন ও কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম এবং সাবেক উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম ওরফে জ্যাকব ও আরিফ খান জয়। সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক, সাবেক মন্ত্রী আবদুস শহীদ, সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, সাবেক সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, শাহজাহান ওমর, আবদুস সালাম মুর্শেদী, সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনসহ অনেকে।
ডিভিশন পাওয়া তালিকায় আরও রয়েছেন বিচারপতি এএইচএম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক), ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান, নৌবাহিনীর রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম সোহায়েল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সাবেক মুখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান ও আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন, হেলালুদ্দিন আহমেদ, মহিবুল হক, আমিনুল ইসলাম খান ও শাহ কামাল।
এই তালিকায় আরও আছেন সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম, সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও একেএম শহীদুল হক, ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া, বাংলাদেশ ডেটা সেন্টারের সাবেক মহাপরিচালক তারেক এম বরকত উল্লাহ, অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মশিউর রহমান, সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মাইনুল হক, বেসিক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক মো. আলী চৌধুরী।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ডিভিশনে আরও আছেন ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার মো. জসীম উদ্দীন মোল্লা, পুলিশ কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আবদুল্লাহেল কাফি, র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলেপ উদ্দিন, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি মো. আবুল হাসান ও গুলশান থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মো. মাজহারুল ইসলাম।