নাজমুল হক তপন
প্রকাশ : ১১ এপ্রিল ২০২৫ ০৯:৩৬ এএম
বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষ। এর অর্ধেক ২৫ বছর বয়সি। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের চেয়ে আমাদের দেশের তরুণের সংখ্যা বেশি। আর এটাই বড় সম্ভাবনা, বাংলাদেশের শক্তির জায়গা কোনটা- সেটাই তার প্রেজেন্টেশনে দেখিয়ে দিলেন আশিক চৌধুরী।
বুধবার বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর প্রেজেন্টেশন টক অব দ্য বাংলাদেশ। দুর্দান্ত উপস্থাপনাশৈলীর সঙ্গে কর্মদক্ষতা-কর্মস্পৃহা ও স্বপ্নের মিশেল নতুন আবেগে ভাসিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। সচরাচর অর্থনৈতিক সম্মেলনকে সাধারণ মানুষ মনেই করে, কাঠখোট্টা সর্বোপরি কিছু উপাত্ত আর পার্সেন্টেজের গাণিতিক হিসাব-নিকাশ। সেই পথে হাঁটেননি আশিক। সামনে টেনে এনেছেন বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে। তথ্যবহুল ও সাবলীল ভাষায় দেশের সম্ভাবনাময়ী খাতগুলো তুলে ধরেছেন স্বপ্নমাখা চোখে।
আশিকের ভাষায়, বিনিয়োগ করলে শুধু বাংলাদেশেই না; সেভেন সিস্টার্স, নেপালসহ সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে সারা বিশ্বের দেশের সাথে ব্যবসা করা যাবে। নেটিজেনরা এই নতুন স্বপ্নের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছেন, ইতোমধ্যে তিনি স্টারলিংক নিয়ে এসেছেন, নাসার সাথে চুক্তিতে চলে গেছেন। বিনিয়োগ হিসেবে বাইরের একটা ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। তারা এই বছর ১০০ কোটি ডলার বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবে। পাঁচটা বিশালাকার মালবাহী জাহাজ কিনে নিয়েছে, রিভার ম্যানেজমেন্টের প্ল্যান তৈরি করে বিশাল বিনিয়োগ আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, চারটা আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল (বিদেশি বিনিয়োগে) তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ইলেকট্রনিক ট্রেন অথবা বুলেট ট্রেন চালুর জন্য বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে ১০টা বৃহত্তর ইকোনমিক জোন তৈরির কার্যক্রম চলছে। একটা নতুন কর্মযজ্ঞে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।
প্রেজেন্টেশন সেই ভিডিও শেয়ার করে সোশ্যাল মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, ‘এই মেধাবী তরুণরা এতদিন দেশে আসতে ভয় পেতেন। তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই আশিক চৌধুরী। যিনি বিলাসবহুল জীবন ছেড়ে দেশের প্রয়োজনে নিজেকে নানাভাবে উপস্থাপন করছেন। এলমা খন্দকার এষা নামের একজন লিখেছেন, সময় এসেছে মেধাবীদের দেশে ফেরার। আমি নিজে কী পোস্ট দেব আশিক চৌধুরীর প্রেজেন্টেশন নিয়ে? নিউজফিডটা ভরা ফেসবুক ফ্রেন্ডদের আশিক চৌধুরীকে নিয়ে সুন্দর সুন্দর পোস্ট। শুধু লাভ রিঅ্যাক্ট দিচ্ছি। এমন অসংখ্য আশিক চৌধুরীর হাত ধরে দেশ এগিয়ে যাক। পোস্টের প্রতিটা লাইন শেষেই লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন এষা।
লেখক গাজী মিজানুর রহমান তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু লোক দেশপ্রেমের চেতনার কথা বলে মুখে ফেনা তুলে ভালো থাকার জন্য দেশের টাকা সিঙ্গাপুরে পাচার করে বিলিয়নেয়ার হয়, আর জনাব আশিক চৌধুরীর মতো কিছু লোক নিজ মাতৃভূমির ভালোবাসার টানে সিঙ্গাপুরের আয়েশি জীবন ছেড়ে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ছুটে এসেছেন দেশে।’ আশিক চৌধুরীর প্রেজেন্টশন সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল। অনেকেরই প্রশ্ন কে এই আশিক চৌধুরী? এতদিন কোথায় ছিলেন? আমরা তো এমন আশিকদেরেই চাই?
আশিক চৌধুরী পেশায় ব্যাংকার। সিঙ্গাপুরে বহুজাতিক দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) রিয়েল অ্যাসেট ফিন্যান্স বিভাগের সহযোগী পরিচালক হিসেবে ছিলেন কর্মরত। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের একটি ফোনকলেই বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
৫৯ সেকেন্ডের আহ্বানে আরাম-আয়েশ পেছনে ফেলে ছুটে এলেন আশিক
গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চুক্তি ও বৈদেশিক নিয়োগ শাখার উপসচিব এটিএম শরিফুল আলম স্বাক্ষরিত একটি প্রজ্ঞাপনে আশিক চৌধুরীকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে সিনিয়র সচিব পদমর্যাদায় বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনে আশিক চৌধুরীকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ফিরে আসা নিয়ে গত বছরের ৬ নভেম্বর আশিক চৌধুরী নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘সরকারি চাকরির আজকে এক মাস হলো। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এক দুপুরে প্রফেসর ইউনূস হঠাৎ ফোন করে বললেন, ‘আশিক, দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ পাওয়া গেছে। আসবা নাকি?’ আমি নন্দিনীকে জিজ্ঞেস না করেই রাজি হয়ে গেলাম। জানতাম ও কোনোদিন মানা করবে না। সো ৫৯ সেকেন্ডের এক হোয়াটসঅ্যাপ কলে আমরা সিঙ্গাপুরের বিলাসী জীবন ছেড়ে-ছুড়ে দেশের পথে রওনা দিলাম বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে, বন্ধুদের ভাষায় বাংলাদেশের চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসেবে।
আশিক যেখানে সাফল্য সেখানে
বাড়ি চাঁদপুর। তবে বাবার চাকরির সুবাদে আশিকের বেড়ে ওঠা যশোরে। স্কুল-কলেজের পাট চুকিয়েছেন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটে (আইবিএ)। ২০০৭ সালে স্নাতক শেষেই যোগ দেন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর টেরিটরি অফিসার হিসেবে। কিন্তু বড় চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকেননি তিনি। কেননা রক্তে আছে নতুন কিছু করার রোমাঞ্চ। ছুটিতে ছুটে যেতেন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়। ২০১১ সাল পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানেই চাকরি করেছেন। তারপর পড়তে যান যুক্তরাজ্যে। সেখানে নিজেকে গড়েছেন নতুনভাবে।
একনজরে আশিকের যত অর্জন
আশিক একজন বিশ্ববরেণ্য স্কাইডাইভার। ৪১ হাজার ফুট উঁচু থেকে দেশের লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে লাফ দেন। যার পুরস্কার হিসাবে নাম লিখিয়েছেন গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস বুকে।
১. ২০০৭ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর টেরিটরি অফিসার
২. ২০০৭-এর শেষের দিকে ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল প্ল্যানিং ডিভিশন’ ম্যানেজার
৩. ২০১২ সালে ‘আমেরিকান এয়ারলাইন্সের’ ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট
৪. ২০১৯-এ একই প্রতিষ্ঠানের ইউরোপ অ্যান্ড এশিয়ার ‘হেড অব ফিন্যান্স’
৫. গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের অ্যাভাইজার
৬. ২০২৪ সালে ‘হংকং ব্যাংকের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফিন্যান্স ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্টের’ অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর
৭. ২০২৪-এ গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম লেখান। ইউনাইটেড স্টেটের মেমপিস শহরের প্রায় ৪২ হাজার ফুট ওপর থেকে বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে লাফ দিয়ে মিশন শেষ করেন। এর পুরস্কারস্বরূপ তার নাম ওঠে গিনেস রেকর্ডস বুকে।
মানুষের লাস্ট ফ্রন্টিয়ের তার দেশ
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার এক মাস পর নিজের ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, গত এক মাস শুক্র-শনিবারসহ দিনে ১৮ ঘণ্টা কাজ করেও কূল পাচ্ছি না। প্রায় আড়াইশ সিইও, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছি তাদের সমস্যাগুলো কোথায় আর কী করে তার সমাধান করতে পারি। নতুন ইনভেস্টমেন্ট কীভাবে আনতে পারি, সে চেষ্টা চলছে। ফেল করা যাবে না। আমরা জনগণের সরকার। তাই প্রত্যাশা অনেক। অনেকটা জাতীয় ক্রিকেট দলের মতো। সবাই চায়, আমরা জিতি। কিন্তু পরের বলটা একটু খারাপ হলেই সবাই হা হা করে ওঠে। টিম সিলেকশন, বোলার সিলেকশন, ফিল্ড সেটিং, এসব নিয়ে নানা সমালোচনা। ম্যাচে সবাই ভালো বল করবে না, এটাই স্বাভাবিক। তা নিয়ে দলের সমর্থকরা গালাগাল করবে, তা-ও স্বাভাবিক। দলটা তো আমাদের। কয়দিন আগেও এসব করা কবিরা গুনাহ ছিল। তাই দিন শেষে টায়ার্ড হয়ে ফেসবুক খুলে যখন মনে হয় আমার বউও বিরোধী দল, তখন নিজেকে বোঝাই : এটাই তো আসলে বাকস্বাধীনতা। হোক না সমালোচনা। আমরা ভুল করব। তারপর শুধরাব। আমাদের দেশটা আস্তে আস্তে ঠিক রাস্তায় হাঁটবে।
এমন সুযোগসন্ধানীদের দেশে একজন আশিক চৌধুরীকে বেমানান উল্লেখ করে স্যাটায়ার করেছেন ফারুখ শেখ নামের একজন। ফেসবুকে লিখেছেন, আশিক চৌধুরীকে নিয়ে এত মাতামাতির কী আছে। উনি কি বিসিএস কিডার!
ওরে আবাল বাঙালি, দেখো জীবনকে কতভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করা যায়।
আশিক চৌধুরী তার গোটা ক্যারিয়ারে যতগুলো অপর্চুনিটিকে ব্রেক আউট করে এই ভেঙে পড়া দেশের জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্পিচ দিচ্ছে, ততগুলো অপুর্চিনিটি আপনি আর আমি পেলে হয়তো দেশের মা-বোনকে গালি দিয়ে ‘বিদেশে’ আয়েশের জীবন পালন করতাম।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই লোকের আবার গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডও আছে। গিনেসে নাম লিখিয়েছেন এই আশিক চৌধুরী। অথচ এত কিছুর পরও গর্দভের মতো মুখ উঠিয়ে একটা ভঙ্গুর দেশের হাল ধরতে চলে এসেছেন। মাথায় দেশপ্রেম নামক গোবর ঠাসা আশিকের মতো এই লোকগুলোর না জানি কবে শিক্ষা হবে কে জানে।