সরেজমিন পঙ্গু হাসপাতাল
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:৪৯ পিএম
আপডেট : ২৯ মার্চ ২০২৫ ১৫:৫০ পিএম
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে নয় মাস বয়সী শিশু আরাফ আদনানকে কোলে নিয়ে হাসপাতালে আন্দোলনে আহত বাবা আরিফুল ইসলাম। ঈদ কোথায় করবেন এখনো জানেন না এই পরিবার। প্রবা ফটো
হাসপাতালের নিচে হাঁটাহাঁটি করছিলেন মো. রাফি। দেখে বোঝার উপায় নেই রাফির দুই হাত প্রায় অচল হয়ে গেছে জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে। হাসিমুখে এসে নিজেই বললেন আমি আন্দোলনে আহত হয়েছি। সঙ্গে আরও আহতদের দেখাতে নিয়ে গেলেন ওয়ার্ডে। রাফি এক হাত ভাঁজ করতে পারেন না। বাঁকা হয়ে গেছে। সেই হাতে কিছু করতেও পারেন না। আরেক হাতে একশর বেশি রাবার বুলেটের গুলি আছে। সে হাতটাও কোনোরকম নাড়াতে পারেন।
ঝালকাঠির বাসিন্দা রাফি বাড়ি থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আন্দোলনে যোগ দিতে। ১৮ জুলাই পায়ে গুলি লাগে তার। এরপর আবার ৫ আগস্ট বের হয়ে যান তিনি। সেদিন দুই হাতে গুলি লাগে তার।
রাফির কাছে জানতে চাওয়া হয়Ñ ঈদ কোথায় করবেন, বাড়িতে যাবেন নাকি হাসপাতালে। তিনি বলেন, হাতের অবস্থা ভালো না। যাব কি না জানি না।
রাফির পাশেই হুইলচেয়ারে বসেছিলেন শনির আখড়ার বাসিন্দা রুমেন মিয়া। তিনি রাফিকে ধরে বলেন, ভাই, আমাদের সঙ্গে ঈদ করবে এবার। তার একটি পায়ে ব্যান্ডেজ মোড়ানো। খুব কাছ থেকে শটগান দিয়ে গুলি করায় অণ্ডকোষ ও কিডনিতে লেগেছে। এখন সুস্থ হতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।
রুমেন মিয়া আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, আগে কী ঈদ করেছিলাম। গত ঈদে চট্টগ্রাম ঘুরতে গেছিলাম। এই ঈদে হাসপাতালে। তিনি বলেন, পরিবারের বড় সন্তান আমি। আমার একটা মেয়ে হয় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর। এখন তার দুই মাস। মেয়ে হওয়ার পর প্রথম ঈদ আমার। পরিবার ঈদে হাসপাতালে থাকতে চায়। কিন্তু আমি বলেছি আমার একার জন্য সবাই হাসপাতালে এসো না।
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে আহত মো. রাফির সঙ্গে আরেক আহত মো. রুমেন মিয়া বসে আছেন। এবারের ইদ দুইজন একসঙ্গেই কাটাবেন হাসপাতালে
দুই ছেলেমেয়ের জনক আমিনুল হক। এবার ঈদে ছেলেমেয়েকে কিছু কিনে দিতে পারেননি, সে কথা ভাবতেই চোখে পানি আসে তার। তিনি বলেন, আমার আর টাকা-পয়সা নেই, কাজ নেই। ময়মনসিংহে চিকিৎসা চলছিল। জানুয়ারির ৮ তারিখে এই হাসপাতালে ভর্তি হই। একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে বাড়িতে যাব ভাবছি। গিয়ে দেখি ঈদের বাজার কিছু করা যায় কি না।
মো. আবদুল্লাহ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। তার এক পায়ে রড লাগানো আরেক পা নাড়াতে পারেন না ঠিক করে। ভোলার বাসিন্দা আব্দুল্লাহ এবার প্রথম ঈদে হাসপাতালেই থাকবেন। পাশেই তারা বাবা বলেন, ভোলায় যেতে আসতে ৪০ হাজার টাকা লাগবে অ্যাম্বুলেন্সে। যাওয়া আসা সম্ভব না।
আব্দুল্লাহ বলেন, আমার সুস্থ হতে পাঁচ বছর লাগবে। সামনের ঈদও হয়তো হাসপাতালেই কাটাতে হবে। শুধু আব্দুল্লাহ না স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অনেকেই হাসপাতালে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের অনেকে এখনও জানেন না ঈদে বাড়ি ফেরা হবে কি না। অনেকেই চাইলেও বাড়িতে ফিরতে পারবেন না।
আরিফুল ইসলাম, মুনির খান, মেজবাহুর রহমান, মো. শাহীনের মতো এমন অনেকেই এবারের ঈদ পার করবেন হাসপাতালের বেডে অনিশ্চয়তায়।
ছেলের যখন দুই মাস তখন আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন আরিফুল ইসলাম। এখন ছেলের নয় মাস। তিনি বলেন, একটা বাচ্চাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার পায়ে গুলি লাগে। ১২ বছরের বাচ্চার গায়ে গুলি লাগে। তাকে তুলি সেসময় আমাকে গুলি করে। তারপর থেকে এই হাসপাতালে।
পায়ে ভর দিতে পারেন না ময়মনসিংহের বাসিন্দা রুম্মন হোসেন। তিনি বলেন, ১৯ জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে হাসপাতালে আসি। তখন ভালো করে ট্রিটমেন্টও দেয়নি। যুদ্ধ করেছি হাসপাতালে। ৭ আগস্ট থেকে আমাদের চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখন আমার পায়ের রড লাগানো আছে। হাসপাতালেই থাকতে হবে।
কুষ্টিয়ার কয়েকজন মিলে গাড়ি বাড়া করে ঈদে বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। আহত মেজবাউর রহমান বলেন, কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। যারা কুষ্টিয়ার তাদের সবাই একসঙ্গে গাড়ি নিয়ে বাড়িতে যাব। এতে খরচও কম পড়বে। এমনিতেই অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে। ৫ আগস্ট দুপুরে গুলি লাগে। কাতার যাওয়ার কথা ছিল, সেটা আর হয়নি।