পথে ডাকাতি ছিনতাই, ঘরে চুরির আতঙ্ক

গত ২৫ মার্চ শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছৈয়গাঁও ইউনিয়নের বারিজঙ্গল গ্রামে স্ত্রীকে ঘরে রেখে তারাবির নামাজে যান স্বামী মান্নান গাজি। নামাজ শেষে ঘরে ফিরে দেখেন স্ত্রীর জবাই করা লাশ পড়ে আছে। স্বজনরা বলছেন, ডাকাতি করতে এসে ডাকাত দল ৫৫ বছর বয়সি ‍মুক্তা বেগমকে জবাই করে হত্যা করেছে। শরীয়তপুরে এমন ডাকাতির ঘটনা নিত্যদিনের। শুধু শরীয়তপুরই নয়, দেশের আনাচে-কানাচে বেড়েছে ডাকাতি। ডাকাতির সঙ্গে চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধের লাগাম টানা যায়নি গত ৮ মাসেও। এবারের ঈদযাত্রায় চুরি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের আতঙ্ক দানা বেঁধেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। বিশেষ করে ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষ যেমন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের কবলে পড়তে পারেন, তেমনি ফাঁকা বাসাবাড়িতে বাড়বে চুরি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদ ঘিরে সারা দেশে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের তৎপরতা বেড়েছে। গত ৮ মাসে যেসব অপরাধী চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের অধিকাংশ আবার জামিনে বেরিয়ে গেছে। অন্যদিকে জেল পলাতক দাগী অপরাধীদের পাশাপশি কিশোর গ্যাংয়ের চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ার তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে।

গত ২৬ মার্চ র‌্যাবের পোশাক পরে ধানমন্ডিতে নিকেতন জুয়েলার্সের মালিকের বাসায় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। সংঘবদ্ধ ডাকাত দল নিজেদের র‌্যাব পরিচয় দিয়ে বাসাটিতে প্রবেশ করে ৩৭ লাখ টাকা এবং আড়াই ভরি স্বর্ণ লুটে নেয়। পুলিশে এ ঘটনায় জড়িত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এদিকে গত ১৩ মার্চ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক বিধবা নারীর ঘরে ঢুকে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটায়। 

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ মহাপরিদর্শক (এআইজি মিডিয়া) এনামুল হক সাগর প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এবারের ঈদযাত্রায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইসহ সব ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে মাঠ পুলিশ প্রস্তুতি নিয়েছে। গত ২০ মার্চ থেকে পুলিশ নিয়মিত মাঠে তল্লাশি, টহল জোরদার করেছে।’

তিনি বলেন, ‘অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। কোন জেলায় বা মেট্রোপলিটনে কোন ধরনের অপরাধ বেশি ঘটেছে তার ছক তৈরির মাধ্যমে পুলিশ প্রস্তুতি নিয়েছে।’

পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ‘গত ৭ মাসে (আগস্ট ২০২৪ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) সারাদেশে অন্তত ৪২৫টি ডাকাতির মামলা হয়েছে। ছিনতাই বা দস্যুতার ঘটনায় ৮৪৭টি এবং চুরি ঘটনায় ৪ হাজার ২২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকা রেঞ্জে, দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম রেঞ্জ। অন্যদিকে চুরির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জে, দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা রেঞ্জ।’ 

পুলিশের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখে গেছে, গত মাসে মামলার ক্ষেত্রে চুরির মামলা সবচেয়ে বেশি। এর পরের অবস্থানে ছিনতাই এবং সবশেষ অবস্থানে আছে ডাকাতি। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে। ৪৯০ ডাকাতির মধ্যে ঢাকা বিভাগেই ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে ১৭৪টি। একইভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা ঢাকা রেঞ্জে ২৭৩টি। এর পরের অবস্থানে চট্টগ্রাম রেঞ্জ ২৬৩টি। তৃতীয় অবস্থানে রাজশাহী রেঞ্জ ১১৯টি। চুরি ও দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১ হাজার ১৬৯টি। দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা রেঞ্জ ১ হাজার ৮৪টি। মেট্রোপলিটন এলাকার মধ্যে ঢাকাতে ডাকাতির ঘটনায় ৪১টি আর গাজিপুরে ২৩টি। তৃতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে ১১টি। ছিনতাইয়ের ঘটনায় ডিএমপিতে ২৪৮টি দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটনে ৯১টি আর গাজিপুর মেট্রোপলিটনে ৪৬টি মামলা হয়েছে। চুরি ও দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনায় ডিএমপিতে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন আর রাজশাহী মেট্রোপলিটনে তৃতীয় অবস্থান।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ‘ঈদের দীর্ঘ ছুটি এবং ঈদযাত্রায় চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ আর এ আশঙ্কা থেকেই ইতোমধ্যে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত সভায় বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। চেকপোস্ট, টহল ও মোবাইল টিমের কার্যক্রম বাড়ানো হলেও ঈদের ছুটিতে ফাঁকা হচ্ছে রাজধানী। ফাঁকা বাসাবাড়ি ও সড়কে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বাড়তে পারে।

তারা আরও জানান, ‘অপরাধ পর্যালোচনা করে চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাইপ্রবণ জেলা, সড়ক মহাসড়ক এবং মেট্রোপলিটন এলাকাগুলো শনাক্ত করা হয়েছে। কোন জেলায় চুরি বেশি হচ্ছে, কোন জেলায় ডাকাতির ঘটনায় বেশি মামলা হচ্ছে এবং কোন জেলায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা বেশি হয়েছেÑ তা পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত সদস্যদের পাশাপাশি বিশেষায়িত ইউনিটগুলোকে নিরাপত্তা জোরদারে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় চেকপোস্টের পাশাপাশি মোটরসাইকেলে বিশেষ টহল দফার (দিনরাত) ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন মার্কেট, রেল, বাস ও লঞ্চ স্টেশনগুলোতে ছিনতাই প্রতিরোধে জোর দেওয়া হয়েছে। বাসাবাড়ির নিরাপত্তায় কমিউনিটি ‍পুলিশ ও বিট পুলিশিং কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।’ 

সড়ক-মহাসড়কে সক্রিয় দেড় হাজার গ্রুপ

ডাকাতির ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে সড়ক-মহাসড়কে। দেশে সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি করে এমন প্রায় দেড় হাজার গ্রুপের সক্রিয় থাকার তথ্য রয়েছে পুলিশের কাছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলপলাতক ও আগে ডাকাতি করতো এমন দাগী অপরাধীও। যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু অপরাধীও।

পুলিশ জানিয়েছে, ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি কম থাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে এসব চক্র।’ যদিও হাইওয়ে পুলিশের ভাষ্য, ‘এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছু ঘটনা দিয়ে সামগ্রিকভাবে সড়ক-মহাসড়কে ডাকাতি বেড়েছেÑ তা বলা যাবে না। হাইওয়ে পুলিশ কাজ করছে।’

হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেন, ‘মহাসড়কে ডাকাতি নিয়ন্ত্রণে নানা উদ্যোগ নিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘ঈদকে সামনে রেখে মহাসড়কে ডাকাতির ঘটনা বাড়ছে বলে তথ্য পেয়েছি। নানা কারণে ডাকাতির ঘটনা বেড়েছে। বিশেষ করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মাদকের টাকা জোগার করতেও ডাকাতি-দস্যুতার দিকে ঝুঁকছে। দেশে তিন হাজার ৯৯১ কিলোমিটার হাইওয়ের নিরাপত্তায় দুই হাজার ৮০০ পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে।’

এদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল ও কুমিল্লার মহাসড়ক চান্দাইল, নারায়ণগঞ্জের সিমরাইলে বেশি ডাকাতির ঘটনা ঘটার তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়েও ডাকাতি হচ্ছে। এসব এলাকায় অনেককে আগে থেকে টার্গেট করেও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি পাবনার সাঁথিয়ায় আঞ্চলিক সড়কের ছেচানিয়া ব্রিজের পাশে বাস-ট্রাকসহ অন্তত ১৫টি গাড়িতে গণডাকাতির ঘটনা ঘটে।

গত ১৪ জানুয়ারি র‌্যাব পরিচয়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দরে যাত্রীবাহী বাসের গতিরোধ করে দুই প্রবাসীকে তুলে নিয়ে মারধর ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারে চলন্ত বাসে যাত্রীবেশে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত দুই মাসে বাগেরহাট, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় রাতে বাস থামিয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া গত ১৫ জানুয়ারি মহাসড়কের মিশ্বানী এলাকায় ৩০০ বস্তা চালভর্তি ট্রাক পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি শামসুল আলম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, ‘সড়ক-মহাসড়কে সাধারণত নির্জন এলাকায় ডাকাতির ঘটনা ঘটে। গত ৮ মাসে এবং এর আগের ডাকাতির ঘটনা বিশ্লেষণ করে এবার ঝুঁকিপূর্ণ বা ডাকাতি হওয়া প্রবণ এলাকায় হাইওয়ে পুলিশের সার্বক্ষণিক টহম টিম মোতায়েন করা হয়েছে।’

বেড়েছে স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি

সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে জুয়েলারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও ব্যবসায়ীদের ওপর সরাসরি আক্রমণের ঘটনা বাড়ছে। এসব অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদের হাতে জুয়েলারি ব্যবসায়ী খুন ও হত্যাচেষ্টার ঘটনাও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা। গত ৮ মাসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ১৭টি স্বর্ণ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানে চুরি ও ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। যাতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। বাজুসের পরিসংখ্যান বলছে, ‘চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই সারা দেশে ১১টি স্বর্ণ বিক্রয় প্রতিষ্ঠানে চুরি ও ডাকাতি হয়েছে।’ বাজুসের পক্ষ থেকে জুয়েলারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এক সংবাদ সম্মেলনে নিরাপত্তা দাবি করা হয়েছে।