প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫ ২২:৫০ পিএম
দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলো একসময় চোরাচালান, মানব পাচার, লাগেজ চুরি এবং চাঁদাবাজির অভয়ারণ্য ছিল। প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ও অনিয়মের সংস্কৃতি ছিল গভীরভাবে প্রোথিত। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারী এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন।
গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হয়েছে যাত্রীদের ভোগান্তির নানা দিক। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ও বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ২০১৬ সালে সরকার বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব প্রদান করে। এরপর থেকেই বিমানবন্দরগুলোর পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বিমান বাহিনীর কঠোর নজরদারির ফলে সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়। তবে, কিছু অসাধু ব্যক্তি থেমে থাকেনি। তারা বিমান বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান, মানব পাচার এবং মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অভিযানে সিভিল অ্যাভিয়েশনের বেশ কয়েকজন সদস্যকে এসব অপরাধে আটক করা হয়।
এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান সিন্ডিকেট বিমান বাহিনীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা বিমানবন্দর থেকে বিমানবাহিনীর সদস্যদের সরানোর জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। গত ১৭ মার্চ সকাল ১০টায় বেবিচকের প্রধান ফটকের সামনে অবরোধের ঘটনা ঘটে। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করে তীব্র যানজট সৃষ্টি করা হয়। এর ফলে রাজধানীর সঙ্গে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং বহু বিদেশগামী যাত্রী তাদের ফ্লাইট মিস করে। বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়।
বেবিচকের কিছু অসাধু কর্মচারী ও স্থানীয় সন্ত্রাসীরা এই অবরোধে সরাসরি জড়িত ছিল। জানা যায়, সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা শহীদুল্লাহর ভাই সাদ্দাম (ছাত্রলীগ সম্পাদক, নোয়াখালী), তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ASG ইদ্রিস আলী মানিকসহ প্রায় ১২০ জন স্থানীয় সন্ত্রাসী এই ঘটনায় অংশ নেয়। এ ছাড়া বেবিচকের কিছু অসাধু কর্মচারী, যেমন এয়ারপোর্ট টার্মিনালে মাদকসহ আটককৃত পরিচ্ছন্নতা কর্মী হারুন, নিরাপত্তা কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ, ড্রাইভার নুরুল ইসলাম, ফায়ার অপারেটর জসিম, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর নুরুল নবী টিপু, সিকিউরিটি কর্মকর্তা মাসুদ, চৌকিদার মোবারক, হান্নান, বাচ্চু প্রমুখ এই আন্দোলনে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। তারা আন্দোলনকে তীব্র করার জন্য বহিরাগত সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে এনেছিল।
বেবিচকের এক কর্মচারী নুর ইসলাম বলেন, এই অল্প সংখ্যক অসাধু কর্মচারীর কারণে আমরা ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। আন্দোলনে লোক এনেছে ভাড়া করে। শুনেছি, সাধারণ কর্মচারীদের তেমন সাড়া না পেয়ে বেবিচকের হারুন ও অলক নামক দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বহিরাগত প্রায় ১২০ জন সন্ত্রাসী নিয়ে আন্দোলনের লোকবল বাড়ানো হয়। বিমান বাহিনী তো ভালোই কাজ করছে। তাদের সরালে বিমানবন্দরের অবস্থা আবার আগের মতোই হবে।
গত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর সারা দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হলে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন বিমানবন্দরকে অরক্ষিত রেখে পালিয়ে যায়। তখন থেকেই বিমান বাহিনী বিমানবন্দরগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। তাদের কঠোর নজরদারি ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার ফলে বিমানবন্দরের পরিবেশে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তারা স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক ব্যবসা ও লাগেজ চুরির মতো অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে চোরাকারবারিদের অসাধু চক্র ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে এবং তারা বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় বিমানবন্দরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
বেবিচক সূত্রে জানা যায়, প্রায় ছয় হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মাধ্যমে বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়ে আসছে। চলতি বছরের শেষে বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ নতুন জনবল নিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। তবে, কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেদের পছন্দের প্রার্থী নিয়োগ দেওয়ার জন্য আন্দোলনে উস্কানি দিচ্ছেন। তারা উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গসহ আরও অনেককে এই আন্দোলনে সরাসরি সম্পৃক্ত করেছেন।
বিমান বাহিনীর কঠোর নজরদারি ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার ফলে বিমানবন্দরের দুর্নীতির স্বর্ণযুগের অবসান হয়েছে। যাত্রীদের হয়রানি কমেছে, লাগেজ চুরি রোধ করা সম্ভব হয়েছে এবং বিমানবন্দরের প্রতিটি কার্যক্রম আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। ICAO ANNEX 17 অনুযায়ী বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় লন্ডন, ম্যানচেস্টার, টরন্টোসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নির্বিঘ্নে ফ্লাইট পরিচালিত হচ্ছে। শিগগিরই নিউইয়র্কের ফ্লাইট চালুরও সম্ভাবনা রয়েছে।
এই উদ্যোগের ফলে গত বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর (HSIA) এককভাবে ৩০০০ কোটি টাকারও বেশি রাজস্ব আয় করেছে এবং ১২.৫ মিলিয়ন যাত্রীর যাতায়াত নিশ্চিত হয়েছে, যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন বিভাগের সঙ্গে কার্যকর সমন্বয় থাকায় যাত্রীদের সেবার মান বহুগুণে বেড়েছে।
বিদেশগামী যাত্রী, বিশেষ করে প্রবাসীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিমান বাহিনীর সদস্যদের আন্তরিকতা ও কার্যক্রমের প্রশংসা করছেন। তারা বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় বিমান বাহিনীর সেবা অব্যাহত রাখা এবং প্রয়োজনে বাংলাদেশ এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্স গঠনের জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছেন।
সততা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে পরিচালিত বিমানবন্দর শুধু সরকারের সাফল্যের প্রতীক নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার গুরুত্বপূর্ণ এক মাধ্যম। এখন সময় সচেতন থাকার, যাতে কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আবারও বিমানবন্দরের সুশৃঙ্খল পরিবেশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে না পারে।