বিশ্ব পানি দিবস
ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২২ মার্চ ২০২৫ ১০:০৭ এএম
আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৫ ১০:৫৭ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
জলবায়ু পরিবর্তন ও চিংড়ি চাষসহ বিভিন্ন কারণে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষ করে আশির দশক থেকে চিংড়ি চাষকে কেন্দ্রে করে বিপুল পরিমাণ জমি লবণাক্ত হয়ে গেছে। তা ছাড়া ভূ-গর্ভস্থ পানিও লবণাক্ততায় পরিণত হচ্ছে। এতে করে সবচেয়ে সমস্যায় পড়েছে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলা। এসব এলাকায় খাবার, রান্না-বান্নাসহ গৃহস্থালির কাজের জন্য একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে বৃষ্টির পানি। মিঠাপানি অভাবে কমে গেছে কৃষি ফসলের উৎপাদন। এ ছাড়া নিরাপদ পানির অভাবে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এমনকি তারা জরায়ুজনিত জটিলতায় ভুগছেন। অনেকেই অল্প বয়সেই প্রজননক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতে উপকূলবাসীর অনেকেই কাজের সন্ধানে নিজ এলাকা ছেড়ে জলবায়ু অভিবাসীতে পরিণত হচ্ছেন।
উপকূলে মিঠাপানির অভাবে যখন এ অবস্থা বিরাজ করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে আজ শনিবার (২২ মার্চ) বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটি দেশেও গুরুত্বসহকারে পালিত হচ্ছে। এ উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ। এবারের দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মাটির নিচের পানি অশেষ নয়, আপনার সন্তানের স্বার্থে পানি ব্যবহারে যত্নশীল হউন’।
কী বলছেন ভুক্তভোগীরা
পশুর নদীর তীরে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার অবস্থান। নদীটি সুন্দরবন হয়ে সরাসরি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এখানকার কৃষি ও জীবনপ্রণালি এই নদীকে ঘিরেই। গত ২৮ জানুয়ারির মধ্যদুপুর। মাথার ওপর খাড়া সূর্য। উত্তাপে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঘামছে। এই খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে কয়েকজন মিলে লবণাক্ত জমিতে ফসল চাষ দেখছিলাম। এমন সময় সেখানে তিনজন ছেলে আসে। তারা পানির সমস্যা নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাদের মধ্যে কলেজ শিক্ষার্থী সুভন দত্ত বলেন, ‘দেখে যান আমরা কী পানি খাই।’
জমি থেকে ৩-৪ মিনিট হাঁটতেই লোকালয়। সেখানেই সুভন দত্তদের বাড়ি। সেখানে দেখা যায় পাশাপাশি দুটি পুকুর। জনাকয়েক মানুষ সেখানে গোসল করছেন। দুজন নারী কলসি দিয়ে পানি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।
পুকুরটি দেখিয়ে সুভন দত্ত বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে আমরা বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খাই। বর্ষা-পরবর্তী ৬-৮ মাস পুকুরের পানি দিয়ে খাবার, রান্না, গোসলসহ গৃহস্থালির কাজ করি। এই যে দেখলেন মহিলারা পানি নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলো বাড়িতে নিয়ে ফিল্টার করবে। অর্থাৎ একটি মাটির কলসিতে ইট, বালি দিয়ে ফিল্টার বানানো রয়েছে। সেখানে পানি ঢালবে। আর সেসব পানি চুইয়ে চুইয়ে নিচে গিয়ে যা জমা হবে, তা দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এনজিও থেকে প্লাস্টিকের বড় বড় ট্যাংক দিয়েছে। সেখানেও পানি সংরক্ষণ করা হয়। তবে ট্যাংকগুলোতে দীর্ঘদিন পানি জমা থাকায় কিরা (পোকা) হয়ে যায়। আবার বড় আকারের একটি ট্যাংক নির্মাণ করে সেখানে পানি ফিল্টার করে বাড়ি বাড়ি সাপ্লাই দেওয়া হচ্ছে। তাদেরকে প্রত্যেক মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা দিতে হয়।’
সুভন দত্তের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন এলাকাটির প্রবীণ রামেন্দ্র নাথ হালদার। গ্রাম্য চিকিৎসক তিনি। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ২০-৩০ বছর আগে তারা পুকুরের পানি খেতেন। এখন ফিল্টার করে খান।
পানির সমস্যা সমাধানে সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, কিছু উদ্যোগ নিলেও সেটি কাজ হয়নি। কেননা মাটির অনেক গভীরের পানিতেও লবণ। এ অবস্থায় টিউবওয়েল বা শ্যালো বসিয়ে মিঠাপানি পাওয়া যাচ্ছে না।
সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি ও শ্যামনগরসহ কয়েকটি উপজেলা একই ধরনের অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানান পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী রনজিত কুমার বর্মণ। তিনি বলেন, আশির দশক থেকে যখন চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে তারপর থেকেই এসব অঞ্চলে মিঠাপানির সংকট সৃষ্টি হয়। ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালো ও টিউবওয়েল বসিয়েও পানি পাওয়া যায় না। এখানকার মানুষের পানির জন্য বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও পুকুরে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করতে হয়।
ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা
সুভন দত্ত, রামেন্দ্র নাথ হালদার ও রণজিত কুমার বর্মণের কথার সত্যতা মিলে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএম মোস্তাফিজুর রহমানের দেওয়া তথ্যে। তিনি জানান, খুলনা অঞ্চলের নদী, মাটি এমনকি ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। সেখানে টিউবওয়েল স্থাপন করলেও লবণের হদিস মিলছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, বটিয়াঘাটায় টিউবওয়েলের পানিতে ২০০৪ সালের মে ও জুন মাসে ২ দশমিক ৬ ও ৩ দশমিক ২ ডিএস পার মিটার লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালে সেখানে লবণের উপস্থিতি কিছুটা কমে ১ দশমিক ৮ ও ১ দশমিক ৬ ডিএস পার মিটার হয়। ফুলতলায় (দক্ষিণ) ২০০৪ সালের মে ও জুন মাসে ২ দশমিক ২ ও ২ দশমিক ২ ডিএস পার মিটার লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালে সেখানে লবণের উপস্থিতি কিছুটা কমে ১ দশমিক ৭ ও ১ দশমিক ৯ ডিএস পার মিটার। ফুলতলা উত্তরে মে ও জুন মাসে ২ দশমিক ৪ ও ২ দশমিক ৫ এবং ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৫ ও ১৪৪ ডিএস পার মিটার।
৭২ শতাংশ মানুষ লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। এতে করে কৃষি, খাদ্য ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের এসব জীবনযাত্রা নিয়ে ‘এক্সপোজড অ্যান্ড এক্সপ্লয়টেড : ক্লাইমেট চেঞ্জ, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মডার্ন স্ল্যাভারি ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি গবেষণা করেছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)।
সেই গবেষণায় বলা হয়, উপকূলীয় অঞ্চলের ৭২ শতাংশ মানুষ লবণাক্ততার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ মানুষ অনিয়মিত বৃষ্টির কবলে পড়ছে। এতে করে তাদের কৃষি, খাদ্য ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
ওকাপের পরিচালক মো. শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে জোয়ারের পানি ঘন ঘন লোকালয়ে পৌঁছে যাচ্ছে। এতে করে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ উভয় স্থানের পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। এই বৃদ্ধি প্রতিবছর খুব দ্রুত হচ্ছে।
গবেষণাস্থল সাতক্ষীরা ও পিরোজপুরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, মিঠাপানি না পাওয়াসহ নানা কারণে মানুষ তাদের কর্মসংস্থান হারাচ্ছে। বিশেষ করে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে করে তারা জলবায়ু অভিবাসীতে পরিণত হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নারীদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা বেশি বাড়ছে। বিশেষ করে তাদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। জরায়ু কেটে ফেলছে। উচ্চ রক্তচাপ বাড়ছে ইত্যাদি। এতে করে সামাজিকভাবেও একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেননা সেসব অঞ্চলের নারীদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অল্প বয়সে মা হতে গিয়ে তারা অপুষ্টিসম্পন্ন বাচ্চা প্রসব করছে। ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে।’
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ডিপিএইচই) ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণাক্ত পানির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের ৬১ শতাংশ মানুষ গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। নিরাপদ পানির অভাবে নারীরা, বিশেষ করে কিশোরীরা সবচেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে। পানি কম পান করার কারণে নারীরা উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি মা থেকে নবজাতক শিশুদের স্বাস্থ্যও প্রভাব ফেলছে। তা ছাড়া অধিকাংশ নারী জরায়ুর জটিলতায় ভুগছেন। অনেকেই কম বয়সেই প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছেন।
যে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা
গত ২৫ বছরে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততার মাত্রা বছরে গড়ে ২৬ শতাংশ করে বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের ২০১৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভূগর্ভে লবণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। এতে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলে খাওয়ার পানি ও সেচের পানির সংকট বাড়ছে। এতে করে কমপক্ষে ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে ফেলবে। বর্তমানে সেখানে সুপেয় পানির সংকটে ভুগছে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মানুষ।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ শীর্ষক প্রতিবেদনে আগামীতে বাংলাদেশে জলবায়ু ক্ষতির শীর্ষ ১০টি ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো লবণাক্ততা।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট পানিবিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘লবণাক্ততা বাড়ার দুটি সূত্র রয়েছে। এক. সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি ও দুই. সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস। বাড়ার মাত্রা বছরে গড়ে ৩ মিলিমিটার। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ২০২১-২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনা অঞ্চলে বছরে সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ছে ৩-৪ মিলিমিটার, বাগেরহাট ও বরগুনায় সাড়ে ৪ থেকে ৫ মিলিমিটার, পটুয়াখালী ও ভোলায় ৬-৭ মিলিমিটার এবং চট্টগ্রামে ৬-৭ মিলিমিটার। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ায় লবণ পানি একটু একটু করে ভিতরে ঢুকছে। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের কারণে লবণাক্ততা বাড়ছে। আমাদের উপকূলে ১৫ ফুট উঁচু বেড়িবাঁধ আছে। এ বাঁধ জোয়ার ঠেকায়।’
১০০ বছর আগে উপকূলের মানুষ পানি ধরে রাখত মটকায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একশ বছর আগে বাগেরহাট, খুলনাসহ উপকূল অঞ্চলের মানুষ বৃষ্টির পানি মটকায় (বড় মাটির কলস) ধরে রাখত। এসব পানি শুধু খাবার কাজে ব্যবহৃত হতো। এগুলো খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হতো। তাতে শিং মাছ ছেড়ে দিত, তাতে করে পোকা হতো না। এখন বিভিন্ন সংস্থা বা সরকারিভাবে প্লাস্টিকের ট্যাংক দিচ্ছে। এতে যে পানি ধরে রাখা হয় তা পর্যাপ্ত নয়। তারা এই পানি ফেব্রুয়ারি-মার্চ পর্যন্ত খেতে পারে। এপ্রিলে পানি থাকে না। এসব পানিতে প্রচুর পোকা হয়। দুই-তিন মাস পানি জমিয়ে রাখলে তাতে পোকা ধরে। তবে ব্র্যাক ফিল্টার দিচ্ছে।’
ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘এসব পানি দিয়ে তারা খাবারের ব্যবস্থা করছে কিন্তু গোসল ও রান্নার পানি কোথায় পাবে? সেজন্য গ্রামগুলোতে যেসব সরকারি খাসজমি আছে সেখানে গভীর পুকুর খনন করতে হবে। এটা করতে পারলে সেখানকার মানুষকে বাঁচাবে। এসবের পাড় উঁচু করতে হবে। সেখানে কেউ গোসল করবে না। গরু-ছাগল ধুবে না। তাহলেই পানি নিরাপদ থাকবে। এসবের জন্য খালের পানি ব্যবহার করবে। তবে গোসল করতে পারে সেখানে সাবান ব্যবহার করা যাবে না। আগে প্রায় প্রতিটি গ্রামে এ ধরনের পুকুর ছিল। আমরা সেই অবস্থা ফিরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ পাব না।’