সংস্কারের সংলাপ শুরু

সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বৃহস্পতিবার এই কমিশন জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে আলোচনা করে। এদিকে সংবিধান, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন প্রক্রিয়া ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার সুপারিশের ওপর লিখিত মতামত দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আগামী রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে নিজেদের মতামত দেবে বিএনপি।

গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনে অবস্থিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে সুপারিশ জমা দেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। প্রতিনিধিদলে আরও ছিলেন সংগঠনের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ। সংস্কার প্রস্তাব জমা শেষে সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, জামায়াতে ইসলামী একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছে। আমিরে জামায়াতসহ নেতৃবৃন্দ প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত একটি অর্থবহ নির্বাচন দেওয়ার জন্য বারবার বলে আসছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ের ব্যাপারে একটি ধারণা জাতির সামনে পেশ করা হয়েছে। আমরা তার সাথে দ্বিমত পোষণ করিনি।

তিনি বলেন, আজকে আমরা পাঁচটি বিষয়ের ওপর আমাদের মতামত তুলে ধরেছি। কমিশনের প্রস্তাবের সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারিনি; আবার অনেক বিষয়েই একমত হয়েছি। আমরা ব্যাখ্যাসহ আমাদের বক্তব্য তুলে ধরেছি। আমরা সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেছি। আমরা আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যেই সংস্কার সম্পন্ন করে একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ শুরু করবেন।

সংস্কার নিয়ে রবিবার মতামত জানাবে বিএনপি

পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে আগামী রবিবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে বিএনপি মতামত দেবে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, মতামত জমা দেওয়ার পর বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হবে।

গতকাল রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলারের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি এসব কথা বলেন। বেলা ১১টায় এ বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটি ও চেয়ারপারসন ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ও চেয়ারপারসন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশেষ সহযোগী উপদেষ্টা কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ।

বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে আমীর খসরু বলেন, সবাই ধরেই নিয়েছে ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ইতোমধ্যে অনেকে বলছে, ডিসেম্বর অনেক দেরিতে। কিন্তু তারপরও ডিসেম্বর ‘কাট অফ টাইম’ হিসেবে ধরে নিয়েছে সবাই। সবার ধারণা ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হলে আমরা সঠিক পথে থাকব। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা ১৭ বছর সংগ্রাম করেছি। সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার একমাত্র মাধ্যম নির্বাচন।

বিএনপির এই নেতা বলেন, নির্বাচন নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে সবাই ভাবছে, নির্বাচন কবে হবে, কবে দেশে গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরে আসবে। দেশে একটি সরকার আছে কিন্তু এখনও গণতান্ত্রিক অর্ডার ফিরে আসেনি। সেটা না এলে, জনগণ সমর্থিত একটা সরকার ব্যতীত কোনো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, পুলিশ সাপোর্ট দিয়ে সেটা দাঁড়াতে পারবে না। সেটা আমরা লক্ষ করছি। জনগণের সমর্থিত সরকার, সংসদÑ যা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করতে পারলে অনেকগুলো সমস্যা সমাধান হবে। এগুলো একটা পলিটিক্যাল উইং ছাড়া সমাধান করা কঠিন। এজন্য আলোচনায় এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন আগে-পরের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে বিষয়গুলোয় আমরা ঐকমত্য হব, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন চিন্তা, বিভিন্ন দর্শন রয়েছে। সবাই যদি মনে করে সব বিষয়ে সবাই ঐকমত্য হবে, তাহলে এত রাজনৈতিক দলের দরকার নাই। বাকশাল নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু আমরা তো আবার বাকশালেও ফিরে যেতে চাই না। যেখানে ঐকমত্য হবে, সে বিষয়গুলো সমাধান করতে পারব ইমিডিয়েটলি। আর যেখানে ঐকমত্য হবে না, সেটা আগামী দিনে নির্বাচনে প্রত্যেকটি দল তাদের ম্যান্ডেট নিয়ে, মেনিফেস্টু নিয়ে, চিন্তা নিয়ে জনগণের কাছে যাবে এবং জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যে সংসদ হবেÑ সেখানে বাস্তবায়ন করবে।

সংস্কার-নির্বাচন নিয়ে কোনো চাপে নেই ঐকমত্য কমিশন : আলী রীয়াজ

এদিকে সংস্কার আগে নাকি নির্বাচনÑ এমন প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কোনো ধরনের চাপে নেই বলে জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

গতকাল জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। এর আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে কমিশনের কাছে মতামত জমা দেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কোনো চাপে নেই জানিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, এক্ষেত্রে স্মরণ করিয়ে দিই যে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান হলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেক্ষেত্রে ঐকমত্য কমিশনের ওপর চাপের প্রশ্নই আসে না। রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই তাদের অবস্থান বলবে। কিন্তু কমিশন হিসেবে আমাদের দায়িত্ব সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো তুলে ধরা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের জন্য একটা জায়গায় যেতে চাই। সুতরাং আমরা চাপে নেই।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের জানানো হয়েছে, আগামী দুয়েক দিনের মধ্যে তারা আমাদের মতামত জানাবেন। আমরা অপেক্ষা করছি, আশা করছি দুয়েক দিনের মধ্যেই তারা মতামত জানাবেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে আলোচনা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের সঙ্গে আগামী দুই-তিন দিনে বৈঠক হচ্ছে না। তাদের মতামত পাওয়া গেলে ঈদের পর থেকে যেসব দলের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব, তার মধ্যে এনসিপিও থাকবে।’

রাষ্ট্র সংস্কারে গত বছর সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন, দুর্নীতি, জনপ্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। কমিশনগুলো এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করে ঐকমত্যে পৌঁছতে সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়।

এই কমিশন পুলিশ সংস্কার কমিশন বাদে বাকি পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশের বিষয়ে মতামত নিতে ১৬৬টি প্রশ্নের স্প্রেডশিট পাঠায় ৩৮টি দলের কাছে। জামায়াত, এলডিপিসহ এখন পর্যন্ত ১৬টি দল তাদের মতামত দিয়েছে।

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা শুরু

সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গতকাল বৃহস্পতিবার এই কমিশন জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সঙ্গে আলোচনা করে।

বেলা ৩টায় এ আলোচনার শুরুতে এলডিপির প্রধান অলি আহমদ বলেন, কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্নমালার যে স্প্রেডশিট পাঠিয়েছে, তার মধ্যে এলডিপি ১২০টিতে একমত পোষণ করেছে। বাকি ৪২টিতে একমত নয়, ২টিতে আংশিকভাবে একমত এবং ২টি অস্পষ্ট বলে মনে করে এলডিপি।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্য সফররাজ হোসেন, এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমদসহ আট সদস্যের প্রতিনিধিদল আলোচনায় অংশ নেয়।

সূত্র মতে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। তারা সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশনের দেওয়া প্রতিবেদনগুলো থেকে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ চিহ্নিত করে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থ্যা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত ২৩টি, জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন-সংক্রান্ত ২০টি সুপারিশ রয়েছে। ওই সুপারিশগুলো ছক আকারে বিন্যস্ত করা হয়েছে। ওই ছকগুলো গত ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ ১২টি দল নিবন্ধিত নয়। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৯। কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে রাজনৈতিক দল এবং জোটগুলোকে তাদের মতামত জানানোর জন্য বলা হয়। তবে নির্ধারিত সময়ে সাতটি দল মতামত দিলেও পরবর্তী সময়ে আরও আটটি দল মতামত জমা দিয়েছে। অন্যরা অতিরিক্ত সময় নিয়েছে।

ঈদের আগে কমপক্ষে চারটি দলের সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। ঈদের পরে পর্যায়ক্রমে বাকিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।