× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

অনিয়ম-দুর্নীতি

মেয়াদ বৃদ্ধির নামে শুভঙ্করের ফাঁকি!

আরমান হেকিম

প্রকাশ : ১২ মার্চ ২০২৫ ০৯:৩২ এএম

প্রবা গ্রাফিক্স

প্রবা গ্রাফিক্স

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ছলচাতুরির শেষ নেই। শুরুর দিকে ঝিমিয়ে থেকে শেষ সময়ে ‘তড়িঘড়ি’ করে কাজ করা হয়। এতে কাজের মান যেমন ঠিক থাকে না, তেমনি নির্ধারিত সময়ে কাজও শেষ করা যায় না। এর ফলে প্রতিবছর কৌশলে কয়েকশ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়ে থাকে। এই অপকৌশলের কারণে প্রকল্পের ব্যয় গড়ে ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। এতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা গচ্চা যায়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ১৩৬টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। আর গত সাড়ে চার বছরে এই সংখ্যা ১ হাজার ৭২০টি। 

পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রকল্পের ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বৃদ্ধি একটি ‘আইওয়াশ ফর্মুলা’। এখানে দেখানো হয় প্রকল্পের কোনো ব্যয় বাড়ছে না, মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়া হলেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। কিন্তু আদৌ তা হয় না। কারণ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি মানে বাস্তবায়ন পর্যায়ে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় বহনের বোঝা বাড়ানো। 

তারা বলেন, সাধারণত একটি প্রকল্পে রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বাইরেও থাকে প্রায় ১১ ধরনের ভাতা। এগুলো হলো : বাড়িভাড়া, বিনোদন, উৎসব, চিকিৎসা, আপ্যায়ন, টিফিন, যাতায়াত, শিক্ষা, মোবাইল ফোন, ভ্রমণ ও অন্যান্য ভাতা। সেই সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খরচের মধ্যে থাকে টেলিফোন বিল, গাড়ি পরিচালনা, ড্রাইভারের বেতন, গ্যাস ও জ্বালানি বিল, পেট্রোল-অয়েল ও লুব্রিক্যান্ট বিল, অফিস ব্যয়সহ নানামুখী ব্যয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে এ ধরনের ব্যয় চলমান থাকে। তবে এগুলো প্রকল্পের মধ্য থেকেই বহন করতে হয়। এজন্য পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায়। 

বেশ কয়েকটি প্রকল্পের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শুরুতে কয়েক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়ানো হয় না। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের ব্যয় এক লাফে কয়েক হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। তেমনি একটি প্রকল্প : দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্প। প্রকল্পটিতে চার দফা ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে একবারেই প্রকল্পের ব্যয় ৮৭৪ শতাংশ বাড়ানো হয়। ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ১৮ হাজার কোটির বেশি করা হয়। যদিও পরবর্তীতে কিছু অংশের কাজ বাদ দেওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় ৬ হাজার কোটি টাকা কমেছে। 

পরিকল্পনা কমিশন-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ১৪২টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পেয়েছে, যার মধ্যে বাস্তবায়ন তদারকি ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ১৩৬টির মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে। এদিকে কমিশনের কর্মকর্তাদের মতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ গত মাসে পরিকল্পনা কমিশন এবং আইএমইডির কাছে ৫০টিরও বেশি নতুন প্রস্তাব জমা দিয়েছে, যার মধ্যে ছয়টির মামলা বিচারাধীন।

আইএমইডির পরিচালক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেকদিন আগে এলজিইডির একটি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির সুপারিশ নিয়ে আসেন প্রকল্প পরিচালক। পরে দেখি প্রকল্পটির এখনও জিও (প্রশাসনিক আদেশ) জারি হয়নি। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। আপনি চিন্তা করতে পারেন তিনি যে-ই প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন, সেই প্রকল্পের এখনও অফিসিয়াল কোনো আদেশই জারি হয়নি অথচ তার এই বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এখন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে দেখে সে আসছে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে। মেয়াদ বৃদ্ধির বেশিরভাগ প্রকল্পের ক্ষেত্রেই দেখা যায় প্রকল্প পরিচালকের গাফিলতির কারণে কাজ হয়নি। শাস্তির বিধান না থাক, এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এই অব্যবস্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করার মানেই শেষ পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধির দিকে ধাবিত হওয়া। এ ধরনের প্রস্তাবগুলো প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতাকে বৈধতা দেয়। একই সঙ্গে বাড়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন খরচ। এসব প্রকল্প পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের পাশাপাশি কী কারণে বারবার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে, তার সঠিক মূল্যায়ন জরুরি।’

আইএমইডির তথ্য বলছে, এর আগে গত ৪ বছরে ১ হাজার ৫৮৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর সবচেয়ে বেশি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছরে। 

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৪৫টির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ করতে না পারায় ৩৫৪টি প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৮০টি প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে মেয়াদ বেড়েছে ৪০০টি প্রকল্পের। 

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) এক গবেষণা বলছে, দেশের ৯৫ শতাংশ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। এসব প্রকল্প বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে শেষ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে না পারায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে গড়ে ব্যয় বাড়ে প্রায় ২৬ শতাংশ।

বিআইডিএসের গবেষণায় বলা হয়েছে, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ৮০ শতাংশ প্রকল্পই নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। বারবার মেয়াদ বাড়ানোর কারণে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ে প্রায় ৫৬ শতাংশ।

ব্যর্থতা ঢাকতে কাজ না করেই ইতি টানা হয়

অপ্রয়োজনে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পগুলো একসময় সরকারের বোঝায় পরিণত হয়। কিন্তু ব্যর্থতা ঢাকতে যেনতেনভাবে প্রকল্পের কাজ করা হয়। গেল ৬ বছরে শতভাগ কাজ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে ৮০৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের। এর মধ্যে বেশকিছুর কাজ চার ভাগের এক ভাগ শেষ হয়েছে। 

আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির (আরএডিপি) আওতায় মোট ৩২৫টি প্রকল্প শেষ করার লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এসব প্রকল্পের মধ্য থেকে বাস্তবায়ন হয় ২৭৭টি এবং লক্ষ্যের বাইরে থেকে হয় ২৪টি। সব মিলিয়ে সমাপ্ত প্রকল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০১টি। কিন্তু এগুলোর মধ্যে শতভাগ কাজ শেষ না করেই বিভিন্ন পর্যায়ে সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ১২৯টি প্রকল্প। তবে ১৭২টির কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। 

আইএমইডি জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে শতভাগ কাজ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ১১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর মধ্যে কোনোটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ছিল ৩০ শতাংশের নিচে।

একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত করা হয়েছে ১৮৬টি প্রকল্প। শুধু তা-ই নয়, এগুলোর কোনোটির আর্থিক ও বাস্তব অগ্রগতি ছিল সাড়ে ৩ শতাংশ পর্যন্ত। ২০২০-২১ অর্থবছরে কাজ বাকি রেখেই সমাপ্ত ঘোষিত প্রকল্পের সংখ্যা ছিল ১২৪টি। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে শতভাগ কাজ শেষ না করেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয় ৯২টি প্রকল্প। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে কাজ অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত করা হয় ১৫৭টি প্রকল্পের।

জানতে চাইলে আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সম্ভাব্য সমীক্ষা ছাড়া তড়িঘড়ি করে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রয়োজন না থাকলেও নানা ধরনের কম্পোনেন্ট যুক্ত করে প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের পরিকল্পনাতেই যদি গলদ থাকেÑ ভালোভাবে শেষের আশা করা যায় কীভাবে?’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা