ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৫ ১১:৩৫ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
করোনা মহামারি চলাকালে প্রান্তিক মানুষকে সরাসরি সহায়তার উদ্যোগ নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। দুই কোটি মানুষকে (ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লাখ পরিবার) আড়াই হাজার টাকা করে নগদ সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য প্রতি জেলায় রাজনৈতিক নেতাদের দায়িত্ব না দিয়ে সরকারের সিনিয়র সচিব বা সচিবদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই সময় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ-সংক্রান্ত আদেশ জারির পর আওয়ামী লীগসহ শরিক দলের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আমলানির্ভরতা নিয়ে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা সচিবদের ওপরে। এটা মনে রাখতে হবে। জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে কোনো রাজনীতি নেই। রাজনীতিবিদদের চেয়ে আমলাদের এখন বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।
বহুল আলোচিত ওই অফিস আদেশে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব বা সচিবরা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে ত্রাণ কার্যক্রম সমন্বয়ের কাজে তার মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা দপ্তরের উপযুক্তসংখ্যক কর্মকর্তাকে সম্পৃক্ত করতে পারবেন। নিয়োগ করা কর্মকর্তারা জেলার সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় গণমাধ্যম ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে কোডিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম পরিচালনার কাজ তত্ত্বাবধান ও পরিবীক্ষণ করবেন। পাশাপাশি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করবেন। ওই সময় দায়িত্ব পালনকারী সচিবরা হলেনÑ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম (মুন্সীগঞ্জ), আইসিটি বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব এনএম জিয়াউল আলম (কুমিল্লা), অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম (সিরাজগঞ্জ), জননিরাপত্তা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন (চট্টগ্রাম), স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সাবেক সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ (কক্সবাজার), জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব এবং নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান (শরীয়তপুর), পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার (মানিকগঞ্জ), প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল (যশোর), কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মো. মেসবাহুল ইসলাম (লালমনিরহাট), গণপূর্ত সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার (গোপালগঞ্জ) প্রমুখ। তারা সকলেই চাকরি থেকে অবসরে চলে গেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ঘনিষ্ঠ। নানা অভিযোগে তাদের কেউ কেউ এখন কারাগারে অথবা পলাতক। এদের অনেকেই বিগত সরকারের আমলে সচিব থাকাকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে বিদেশে পাচার করেছেন। তাদের এসব অবৈধ সম্পদের বিষয়ে শিগগির অনুসন্ধান চালাবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
জানা যায়, তৎকালীন ৬৪ জেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবরা দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো সাহায্য কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। কাগজে-কলমে বলা হলেও আমলারা স্থানীয় সংসদ সদস্য বা রাজনৈতিক নেতাদের পরামর্শ নিতেন না। তাদের ইচ্ছায় তালিকা প্রস্তুত করে সরকারি সহায়তা দেওয়া হতো। যে কারণে লাখ লাখ প্রান্তিক মানুষ সহায়তার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি সহায়তায় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এক্ষেত্রে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট নেপথ্যে কাজ করেছে। এসব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা বহু অভিযোগ আনলেও ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তা আমলে নেননি। যে কারণে দুর্নীতিবাজ আমলারা থেকে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন আরও প্রভাবশালী, আরও বেপরোয়া। করোনাকালে সরকারি সহায়তার নামে তাদের শত শত কোটি টাকা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টিও একসময় ধাপাচাপা পড়ে যায়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর পতিত সরকারের আমলে নেওয়া মেগা প্রকল্প থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত শুরু করে সরকার। তার অংশ হিসেবে ২০২০ সালে ৬৪ জেলায় করোনা মহামারির সময় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সরকারি সহায়তা দেওয়ার দায়িত্ব পাওয়া সচিবদের আমলনামা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত হয়। ইতোমধ্যে তাদের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে যাচাই চলছে। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিতে অভিযুক্ত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের অনেকেই ওই সময় জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল, সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, এনএম জিয়াউল আলমসহ কয়েকজন সচিব বর্তমানে কারাবন্দি হয়ে আছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪ সালে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর বর্জনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একতরফা জয় পায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও তা ‘রাতের ভোট’ হিসেবে চিহ্নিত হয়, যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে তারা সরকারি চাকুরেদের ব্যবহার করে। এ কারণে সরকারের ওপর প্রশাসন ও পুলিশের বিশেষ প্রভাব তৈরি হয়। অনেকটাই আমলানির্ভরতা হয়ে ওঠে সরকার। এভাবে গত দুই দশকে আওয়ামী লীগসহ শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের অবক্ষয় ও স্থবিরতা গ্রাস করে। অনিবার্যভাবে বাড়তে থাকে আমলানির্ভরতা। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগে গণতান্ত্রিক অনুশীলন কমে যায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমলারা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে লাগামহীন হয়ে ওঠেন।
করোনা মহামারি শেষে অভিযোগ ওঠে, কোভিড-১৯ সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য সরকারি কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা সচিবরা ক্ষতিগ্রস্তদের নগদ সহায়তায় টাকা বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। নগদ সহায়তাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কোনো তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ করা হয়নি।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান (সচিব) বদিউর রহমান বলেন, ‘দেশের রাজনীতি তৎকালীন আমলা ও ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে যায়। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতেই থাকা উচিত। আমলাদের হাতে থাকা দরকার আমলাতন্ত্র। রাজনীতিবিদরা যদি আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন তাহলে তো আমলারা ছড়ি ঘোরাবেনই। দেশপ্রেমিক ও ন্যায়নিষ্ঠ না হলে আমলা যত পাকা হন, তিনি তত বেশি শয়তান হবেন। এখন আমলাতন্ত্র ও বাণিজ্য রাজনীতিতে চেপে বসেছে। দেশে দীর্ঘদিন ধরে সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ার কারণে এসব হয়েছে।’