ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৩৯ এএম
ছবি : সংগৃহীত
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় দেশে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ, সেলিব্রেটি, যৌনকর্মী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অনেক নারী মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, নারীদের ভয় দেখিয়ে আটকে রাখা যাবে না।
তাদের একজন আলোকচিত্রী সাদিয়া মারিয়ম রুপা। তিনি বলেন, ‘রাস্তায় বের হলে মনে হয় কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। আগে নিরাপত্তা নিয়ে বের হলেও এখন মনে হয় সেই নিরাপত্তা নিয়েও লাভ নেই। রাষ্ট্র সব সময় নারীর প্রতি বিমুখ। এখন এই বিমুখতা যেন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যারা টিজ করে, তাদের ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করা হয়। যেকোনো সময় যেকোনো বিষয় নিয়ে মনে হয় কেউ ফলো করছে। কিছু একটা বলে ফেলবে আমি কীভাবে উত্তর দিব। অনেকভাবেই নিজেকে তৈরি রাখতে হয়। আমি রাস্তায় বের হতে ভয় পাই, তবুও কাজের জন্য বের হচ্ছি।’
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক ছাত্রীকে ‘ওড়না পরা’ নিয়ে হেনস্তার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া কর্মী মোস্তফা আসিফ অর্ণবকে তৌহিদী জনতা নামে এক দল থানা থেকে ছাড়িয়ে নেন। পরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়। এই ঘটনায় দেশজুড়ে নারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, মামলা প্রত্যাহারের মাধ্যমে একটি অশুভ বার্তা দেওয়া হয়েছে।
শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ঘটনা না, গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে এমন আরও কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোতে মেয়েদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। দেশের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আজ শনিবার (৮ মার্চ) উদযাপন হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন; নারী ও কন্যার উন্নয়ন’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য সামিনা লুৎফা বলেন, ‘এভাবে মামলা তুলে নেওয়া হলে নারী নির্যাতন আরও বাড়বে। নারীরা আরও বেশি অনিরাপদ বোধ করবে। মেয়েদের ভয় দেখিয়ে ঘরে আটকে রাখার চেষ্টা চলছে। পুরুষতন্ত্র অনেক পুরোনো, কিন্তু এটাকে ব্যবহার করে নারীদের হেনস্তা করা হচ্ছে।’
তবে নারীদের এত সহজে ঘরে আটকে রাখা যাবে না উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘জুলাইয়ে যেসব নারী সামনে ছিল, তাদেরও টার্গেট করা হয়েছে। এতে কার লাভ? নারীদের ভয় দেখানো হচ্ছে, কিন্তু শ্রমবাজারে নারীরা যুক্ত হয়ে গেছে। তাদের আর ভয় দেখানো যাবে না। নারীদের সাহসের সঙ্গে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।’
এর আগে ঢাকার লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে ধূমপান করা নিয়ে দুই তরুণীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় দেশজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গত কয়েক মাসে নারীকেন্দ্রিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এমন ঘটনা কখনও দেখিনি। ভুক্তভোগীর মামলা প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে, যা খুবই দুঃখজনক। এর আগে লালমাটিয়ার ঘটনায়ও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। এখন রাস্তায় বের হতে ভয় হয়।’
ঘটনাগুলোতে সরকারের তেমন উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যায়নি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘সরকার ঘটনাগুলোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। সবাই ক্ষমা চেয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। সমস্যা সমাধানের জন্য কি ক্ষমা চাওয়াই যথেষ্ট? বাংলাদেশ নারী উন্নয়নে এগিয়েছে, কিন্তু এই ধরনের বাধা নারীদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপের মতো।’
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘আগেও অনেক ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এখন সংখ্যাটা বেড়েছে। সরকার হয়তো এই ঘটনাগুলোকে ছোট বিষয় হিসেবে দেখে এড়িয়ে যাচ্ছে অথবা এগুলোকে নিরুৎসাহিত করছে না।’
এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও আজ শনিবার (৮ মার্চ) উদযাপিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ অবস্থায়ও নারীরা তাদের অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে গুরুত্ব সহকারে মোকাবিলা করে নিরাপদ ও সমতাভিত্তিক একটি সমাজ গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্ব নারী দিবসে এই প্রত্যয়ই হোক নারীদের অঙ্গীকার।