আন্তর্জাতিক নারী দিবস
ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:৩৫ এএম
গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এ বাণী আজও নারীর ক্ষমতায়নের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে নারীরা এখন শুধু ঘরের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নেই, তারা দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী থেকে শুরু করে পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যাংকিং, প্রকৌশলসহ সব ক্ষেত্রেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। প্রশাসনে সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা কাজ করছেন। তবে প্রশ্ন হলোÑ সব সেক্টরে নারীরা কি সমানভাবে সফল হচ্ছেন?
বাংলাদেশে নারীরা এখন শুধু মাঠপর্যায়ে নয়, প্রশাসনের শীর্ষ পদেও সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। বিভিন্ন সময়ে মাঠ প্রশাসনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নারী কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ফলে প্রশাসনে নারী কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ন সুদৃঢ় হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও নারী কর্মকর্তারাও পিছিয়ে নেই। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৮ জন নারী জেলা প্রশাসকের (ডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া ৮১ সচিবের মধ্যে ১৪ জন নারী সচিব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন। উপজেলা পর্যায়েও ১৭৭ জন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে কাজ করছেন। তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
আজ ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বাংলাদেশে এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলোÑ ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন : নারী ও কন্যার উন্নয়ন-২০২৫’। এই প্রতিপাদ্য সামনে রেখে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। নারীরা এখন শুধু ঘরেই নয়, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।
এদিকে নারীদের সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তারা সাহস নিয়ে কাজ করছেন। শুধু মাঠ প্রশাসনে নয়, এখন প্রশাসনের নানা স্তরে নারীর অবস্থান বাড়ছে, সুসংহত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকারের নানামুখী উদ্যোগের পাশাপাশি মানুষের সচতেনতাও এক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। নারীদের জন্য কর্মপরিবেশও ভালো হয়েছে, তবে এখনও বেশ ঘাটতি আছে। এজন্য কর্মপরিবেশ আরও উন্নত করা দরকার বলে মনে করেন নারী কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, বিশেষ করে চাকরিজীবী মা-বাবার কথা বিবেচনা করে কর্মক্ষেত্রে উন্নত মানের ডে-কেয়ার বাড়ানো উচিত। এ ছাড়া নারীর জন্য উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পুরুষদের প্রথাগত মানসিকতা পরিবর্তনে সচেতনতা তৈরিসহ আরও কিছু কাজ করলে কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান আরও সুসংহত হবে। প্রশাসনে নারীর অবস্থান বাড়লে তা নানা ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ফল রয়ে আনবে বলে মনে করছেন নারী কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান সরকার নারীবান্ধব। নারীর কর্মপরিবেশ তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পদে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটি এক দিনে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়েছে; আগামীতে আরও বাড়বে। তবে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রত্যাহার করার প্রক্রিয়া চলমান।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, বর্তমানে সারা দেশে সরকারি চাকরিজীবী আছেন, মঞ্জুরিকৃত পদ, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ২১ হাজার ৭৯১, অধিদপ্তর ও দপ্তর ১৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৪৫, করপোরেশন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ৪ লাখ ৩০ হাজার ৫৮৩, মোট ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৫১৯ জন। এর মধ্যে ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন নারী। প্রথম শ্রেণিতে নারী (এখন গ্রেড ভিত্তিতে চাকরি নির্ধারিত হলেও মুখে মুখে শ্রেণি বলা হয়) চাকরিজীবীর সংখ্যা ১ লাখ ৯৫ হাজার ৬৭৯ জন। এর মধ্যে নারী ৩৯ হাজার ৭৮৭ জন। সব মিলে প্রশাসনে ১ হাজার ৫৭৪ জন নারী কর্মকর্তা রয়েছে। বর্তমানে প্রশাসনে মোট ৮১ জন সচিব আছেন। এর মধ্যে নারী সচিব ১৪ জন। তারা হলেনÑ মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বেগম মমতাজ আহমেদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে ড. ফারহিনা আহমেদ, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে নাজমা মোবারেক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ইসরাত চৌধুরী, দুর্নীতি দমন কমিশনে খোরশেদা ইয়াসমিন, বেসাময়িক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে নাসরীন জাহান; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফারজানা মমতাজ; তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে বেগম মাহবুবা ফারজানা, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগম, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে আলেয়া আক্তার, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার জাহেদা পারভীন এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) লামিয়া মোরশেদ এবং বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিফা খান। গুরুত্বপূর্ণ এ দপ্তরগুলোর শীর্ষ পদ নারী কর্মকর্তারা দক্ষতার সঙ্গে সামলাচ্ছেন। এভাবে মাঠপর্যায় থেকে শুরু করে প্রশাসনে বিভিন্ন স্তরে নারী কর্মকর্তাদের অবস্থান বাড়ছে, সুদৃঢ় ও সংহত হচ্ছে। যেকোনো সময়ের চেয়ে বিগত কয়েক বছরে নারীদের কর্মপরিবেশও ভালো হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বিগত সময়গুলোর চেয়ে বর্তমানে শুধু প্রশাসনিক এ পদগুলোতে নয়; সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এসব পদে নারীরা বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতায় নিজেদের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখছেন। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে বিগত যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। কর্মক্ষেত্রেও নারী অনেক ভালো করছেন। ভবিষ্যতে এটা আরও বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।
মাঠ প্রশাসনে জেলা সামলাচ্ছেন ১৮ জন নারী ডিসি : দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ১৮ জন নারী জেলা প্রশাসক (ডিসি) দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে রংপুর বিভাগের কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নুসরাত সুলতানা। ঠাকুরগাঁওয়ে ইশরাত ফারজানা, রাজশাহী বিভাগের বগুড়ায় হোসনা আফরোজা, রাজশাহীতে আফিয়া আখতার, জয়পুরহাটে আফরোজা আক্তার চৌধুরী, নাটোরে আসমা শাহীন, জামালপুরে হাছিনা বেগম, বান্দরবানে শামীম আরা রিনি, চট্টগ্রামে ফরিদা খানম, গাজীপুরে নাফিসা আরেফীন, টাঙ্গাইলে শরীফা হক, কিশোরগঞ্জে ফৌজিয়া খান, মেহেরপুরে সিফাত মেহনাজ, নড়াইলে শারমিন আক্তার জাহান।
এ প্রসঙ্গে বগুড়ার জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, একজন নারীকে নিজেকেই প্রমাণ করতে হয়, তিনি সে পদের যোগ্য কি না। তবে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ এখন বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও পরিবর্তন হবে।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এখন নারীরা চ্যালেঞ্জ নিতে পছন্দ করেন। তিনি দায়িত্ব পালনকালে কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হননি। তবে নারীরা সর্বক্ষেত্রে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত। জনগণের সেবা দিতে নারী হিসেবে তার কোনো সমস্যা হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
১৭৭ জন নারী উপজেলা প্রশাসনে ইউএনওর দায়িত্বে: তৃণমূলে তথা উপজেলা প্রশাসনে নির্বাহী প্রধান (ইউএনও) হয়ে মাঠের দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, আইনশৃঙ্খলা উন্নতি, ভূমি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তারা। এরপরও সামলাতে হয় রাজনৈতিক প্রভাব। বর্তমানে ৪৯২ উপজেলার ইউএনওদের মধ্যে ১৭৭ জন নারী দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে প্রায় ২০ জনকে পদোন্নতিজনিত কারণে বদলি করা হয়েছে। দায়িত্বরত ইউএনওদের মধ্যে এই হার ৩৬ শতাংশ। উপজেলা প্রশাসনে ইউএনও পদই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তারাই উপজেলায় সরাসরি সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তারা উপজেলার অন্য সরকারি দপ্তরগুলোর কাজে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া সারা দেশে ভূমি-সংক্রান্ত দপ্তর সহকারী কমিশনার (ভূমি) আছেন ১৩৮ জন নারী। তবে আগামীতে মাঠ প্রশাসনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে এবং সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাঠে দায়িত্ব বাড়ছেন।
এ বিষয়ে ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়া বলেন, সমাজে ধীরে ধীরে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ ইতিবাচকভাবে নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরও পরিবর্তন হবে। আমি মাঠে কাজ করে জনগণের সেবা দিতে পারছি। এই আমার বড় পাওয়া।