সুজন কৈরী
প্রকাশ : ০৮ মার্চ ২০২৫ ১০:২০ এএম
গ্রাফিক্স : প্রতিদিনের বাংলাদেশ
দেশজুড়ে রান্নার কাজে এলপিজি (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) সিলিন্ডারের ব্যবহার বিপুল। সুবিধার বিবেচনায় দিন দিন বাড়ছে ব্যবহারকারীর সংখ্যাও। সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী এই জ্বালানিটি যেমন সুবিধাজনক, তেমনি এর অপব্যবহার ও অসচেতনতা ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বা গ্যাস লিকেজের কারণে অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঘটনায় প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানহীন সিলিন্ডার ব্যবহার ও সচেতনতার অভাবে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন তারা।
সর্বশেষ গত ২৩ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) ঢাকার সাভারে একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে বিস্ফোরণে একই পরিবারের নারী ও শিশুসহ সাতজন দগ্ধ হয়। ঘটনাটি ঘটেছে সাভারের হেমায়েতপুর নালিয়াশুর এলাকায় নোয়াব আলীর একতলা বাড়িতে।
দগ্ধদের উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় দগ্ধরা হলেনÑ জিসান (২০), সোলেমান (১৮), শিল্পী (৪০), তার ছেলে সজীব (৭), হালিমা আক্তার (৪০), আমেনা বেগম (৬০) ও সুজাত মোল্লা (২৭)। তারা সবাই আত্মীয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) রাতে রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারের আশুলিয়া থানার গুমাইল এলাকায় একটি বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় শিশুসহ ১১ জন দগ্ধ হন। স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর দগ্ধদের উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। দগ্ধদের মধ্যে তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
দগ্ধদের মধ্যে রয়েছেনÑ সুমন রহমান (৩০), সূর্য্য বানু (৫৫), জহুরা বেগম (৭০), মনির হোসেন (৪৩), সোহেল (৩৮), শিউলি আক্তার (২৫), শারমিন (২৫), শামিন মাহমুদ (১৫), মাহাদী (৭), সোয়ায়েদ (৪) ও সুরাহা (৩ মাস)।
জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান জানান, দগ্ধদের মধ্যে সুমনের শরীরের ৯৯ শতাংশ, শিউলির ৯৫ শতাংশ, শারমিনের ৪২ শতাংশ, সোয়াইদের ২৭ শতাংশ, শামিনের ১৪ শতাংশ, মাহাদির ১০ শতাংশ, সুমাইয়ার ৯ শতাংশ, সূর্য্য বানুর ৭ শতাংশ, সোহেলের ১০ শতাংশ, জোহরা বেগমের ৫ শতাংশ ও মনিরের ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ছয়জনের শ্বাসনালিও দগ্ধ হয়েছে।
ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে দগ্ধ সুমনের ফুপাতো ভাই মোহাম্মদ শহীদ জানান, শবেবরাত উপলক্ষে পরিবারের সদস্যরা সুমনের বাসায় জমায়েত হয়েছিলেন। বিকাল থেকে রান্না চলছিল। রাত ৯টার দিকে চুলা জ্বালানোর সময় হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন ধরে যায়। বাসার সব জানালা বন্ধ থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
হাসপাতালে দগ্ধ মনিরের মা রহিমা বেগম বলেন, গ্রামের বাড়ি থেকে শুক্রবার সুমনের মা ও তার ভাই সোহেলের পরিবার ওই বাসায় বেড়াতে আসে। রাতে শবেবরাতের রুটি ও পিঠা বানানোর সময় হঠাৎ সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে সুমনের কক্ষে আগুন ধরে গেলে তাদের পরিবারের শিশু ও নারীসহ মোট ১১ জন দগ্ধ হয়। পরে স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়।
দগ্ধ সোহেল রানা বলেন, শবেবরাত উপলক্ষে আমার ভাই সুমনের বাসায় পরিবার নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে পিঠা বানানোর সময় হঠাৎ সিলিন্ডার লিকেজে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘরে আগুন ধরে গেলে পরিবারের সবাই দগ্ধ হয়।
এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ব্যালেডিয়াস বিজনেস সলিউশন নামের এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট প্রায় আধা ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় হতাহতের কোনো খবর না পাওয়া গেলেও গুদামের সম্পূর্ণ গ্যাস সিলিন্ডার পুড়ে যায়।
এ ছাড়াও প্রায় সময়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনার খবর পাওয়া যায়।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৪টি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫৩ জন আহত ও ৮ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ থেকে ৭০৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, যাতে ৮ জন আহত হয়েছেন।
এর আগের বছর ২০২৩ সালে গ্যাস সিলিন্ডারের থেকে সৃষ্ট আগুনে ২৩ জন আহত ও চারজন নিহত হয়েছেন। ২০২২ সালে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে সৃষ্টি আগুনে ৩০ জন আহত ও একজন নিহত হয়েছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে গ্যাস সিলিন্ডারজনিত দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মূল কারণ গ্যাস লিকেজ। সিলিন্ডারের হোসপাইপ, রেগুলেটর বা ভালভের ত্রুটির কারণে গ্যাস লিক হয়। এই গ্যাস বাতাসে জমে থাকলে সামান্য স্ফুলিঙ্গ বা আগুনের সংস্পর্শে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এ ছাড়া অনেকেই সিলিন্ডার চুলার খুব কাছাকাছি রাখেন, যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, গ্যাস সিলিন্ডার চুলা থেকে কমপক্ষে ১০ ফুট দূরে রাখা উচিত। সিলিন্ডার কখনই কাত করে রাখা যাবে না এবং সিলিন্ডার রাখার স্থানে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ ছাড়া সিলিন্ডার রোদ ও তাপ থেকে দূরে রাখা জরুরি। সিলিন্ডার নিচের দিকে ট্রাপ হয়। এখানে যদি ওপরের দিকে ভেন্টিলেশন রাখা হয়, তবে তা কাজ করবে না। অথচ বেশিরভাগ বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালে এসব ঝুঁকির বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করা হচ্ছে।
তারা আরও বলেন, সব গ্যাস সিলিন্ডার নির্দিষ্ট সময় পর পর টেস্ট করা জরুরি। এলপিজি গ্যাস রিফিল করা হয় টেন বার প্রেসারে। পরীক্ষা করে দেখতে হবে সিলিন্ডারটি আসলে উপযোগী কিনা।
এদিকে বাসাবাড়ি ছাড়াও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যস্ত সড়কের ফুটপাতে রয়েছে স্ট্রিট ফুডের দোকান। কোথাও কোথাও রাস্তার পাশেও ছোট কাভার্ড ভ্যান কিংবা ভ্রাম্যমাণ টং দোকানে গরম খাবার তৈরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। এসব দোকানের গ্যাস সিলিন্ডার চুলা থেকে মাত্র এক দেড় হাত দূরে রাস্তা কিংবা ফুটপাতের ওপর রাখা। পাশাপাশি চায়ের দোকানগুলোতেও ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়ে তাদের কারও সামান্যতম কোনো মাথাব্যথা নেই।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক ড. মো. আদসাদুল ইসলাম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের প্রধান কারণ হলো নিম্নমানের সরঞ্জাম ও অসচেতনতা। অনেক সময় মানহীন সিলিন্ডার বা রেগুলেটর ব্যবহার করা হয়, যা ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি বলেন, প্রতি পাঁচ বছর পর পর সিলিন্ডার পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু অনেকেই এই নিয়ম মানে না।
তিনি বলেন, সিলিন্ডার সাধারণত বিস্ফোরিত হয় না। বিস্ফোরণ ঘটে সিলিন্ডারের অন্য যন্ত্রাংশে। রেগুলেটরসহ অন্যান্য যেসব যন্ত্রাংশ বাজারে পাওয়া যায় তার অধিকাংশই নিম্নমানের। এ ছাড়া সিলিন্ডার রাখা হয় চুলার একদম কাছে। সিলিন্ডার পরিবহন ও রক্ষণাবেক্ষণে তেমন নিয়ম মানা হয় না। ব্যবহারের পর ঠিকমতো বন্ধও করা হয় না। ফলে গ্যাস লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি আরও বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার কেনার ক্ষেত্রে গায়ে মেয়াদ রয়েছে কি না তা দেখতে হবে। মোটকথা গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিক সচেতন হতে হবে। সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার সাধারণত নিরাপদ। তবে সিলিন্ডারের সঙ্গে যুক্ত সরঞ্জাম, যেমন রেগুলেটর বা হোসপাইপ নিম্নমানের হলে গ্যাস লিকেজের ঝুঁকি বাড়ে। তিনি পরামর্শ দেন, উচ্চমানের রেগুলেটর ও অন্যান্য সরঞ্জাম ব্যবহার করতে। কম দামের পণ্য কেনার চেয়ে একটু বেশি দাম দিয়ে ভালো মানের পণ্য কিনলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমে।
উদারহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি রেগুলেটরের মূল্য ২০০ থেকে দুই হাজার বা আড়াই হাজার টাকারও রয়েছে। এখন ২০০ বা ৩০০ টাকার রেগুলেটরের থেকে খুব ভালো কাজ করবে ১৫০০ বা দুই হাজার টাকার রেগুলেটর। যেমন ১৪০০ বা ১৫০০ টাকার একটি রেগুলেটর আছে বাজারে, যা ব্যবহারে গ্যাস লিকেজ হলেও আগুন ধরবে না। কারণ রেগুলেটরটি অটোমেটিক গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়।
তিনি আরও বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারকারীকে অধিক সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি যারা বিক্রি করছেন তাদেরও গ্রাহকদের সিলিন্ডার ব্যবহারের বিষয়ে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া ও সচেতন করতে হবে।
অগ্নিনির্বাপক বিশেষজ্ঞরা জানান, সিলিন্ডার ভালো হলেও গ্যাস লিক হতে পারে যদি এর পাইপ, রেগুলেটর নিম্নমানের হয়। দেশের বাজারে ভালো-খারাপ দুই মানের যন্ত্রাংশই আছে। কিন্তু অনেকে না বুঝেই কম দামের মানহীন পণ্য কেনেন। আবার অনেকে অর্থ বাঁচাতে নিম্নমানের পণ্য ব্যবহার করেন। আর এসব কারণেই সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার ভয়ংকর ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সঠিক ব্যবহার, উচ্চমানের সরঞ্জাম ও নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। সচেতনতা ও সতর্কতা বাড়ানোই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান।