পায়রা বন্দর
আরমান হেকিম
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৫ ১০:৪৮ এএম
প্রবা গ্রাফিক্স
বিশ্বজুড়ে লকডাউন এবং সরবরাহ চেইনের ব্যাঘাতের কারণে যখন বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সংকট চলছিল, তখন ২০২০ সালে বাংলাদেশ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় পায়রা বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে। তবে ভুল সময়ে চুক্তি করার মাশুল হিসেবে ৮৫৭ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে সরকারকে। নির্মাণ কাজ বিলম্বের ক্ষতিপূরণ বাবদ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ অর্থ দাবি করেছে।
তাছাড়া মহামারি-পরবর্তী সময়ের জটিলতা, নির্মাণ বিলম্ব এবং টাকার অবমূল্যায়নের কারণে প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো প্রকল্পের সংশোধিত প্রস্তাব সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক সূত্র জানায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব পাঠিয়েছে এবং এটি এখন যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যয় বৃদ্ধি দেশের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন সংকট তৈরি করতে পারে। সরকারি পর্যায়ে এ প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি পরিকল্পিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা যেত, তাহলে ব্যয় এতটা বাড়ত না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকল্পগুলোর বড় সমস্যা হচ্ছে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারা। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বেড়ে যায়। এতে অর্থের অপচয় হচ্ছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এ কথাটি বলে আসছিলাম। এজন্য চুক্তি করার আগে সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই চুক্তি করা প্রয়োজন।’
জানা গেছে, ৬৫০ মিটার দীর্ঘ টার্মিনাল ও ৩ লাখ ২৫ হাজার বর্গমিটার ব্যাক-আপ ইয়ার্ড নির্মাণ ছাড়াও ৬.৩৫ কিলোমিটার ছয় লেনের সড়ক, পাঁচ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ ২০২১ সালের মধ্যে শেষ করতে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৯ সালে। ছয় বছরেও শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। একনেকে প্রস্তাবটি অনুমোদন পেলে তিন বছরের কাজ আট বছরে শেষ হবে। একই সঙ্গে ব্যয় বাড়বে প্রায় ৩৭ শতাংশ।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পটির আওতায় জেটি নির্মাণে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল, বর্তমানে ঠিকাদার আরও প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা বেশি চাইছে। এ সময়ে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে এ অঙ্গে ব্যয় বাড়বে ১৬১ কোটি ডলার। সব মিলে জেটি নির্মাণে ব্যয় বাড়াতে হচ্ছে ৩০৬ কোটি টাকা। করোনা মহামারির মধ্যে লকডাউনে সই করা চুক্তির আওতায় কাজ না হওয়ায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সব মিলে ৮৫৭ কোটি টাকা বেশি চাইছে।
একই সঙ্গে মুদ্রার বিনিময় হারের পরিবর্তনজনিত কারণে বাড়তি লাগছে ৪৬৪ কোটি টাকা। বেশি সময় ধরে কাজ করায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাড়তি চাইছে ৩০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। ইয়ার্ড নির্মাণে প্রাইস অ্যাডজাস্টমেন্ট বাবদ বাড়তি ১৬০ কোটি টাকা পাচ্ছে ঠিকাদার। এ খাতে বিনিময় হারজনিত বাড়তি ব্যয় ৩৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সব মিলে ইয়ার্ড নির্মাণে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে ১৯৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। একই কারণে আন্ধারমানিক সেতু নির্মাণে ৮৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা বাড়তি পাবে ঠিকাদার। আর মুদ্রার অবমূল্যানজনিত ১২০ কোটি টাকাসহ সেতুটি নির্মাণে বাড়তি ব্যয় হবে ২০৪ কোটি টাকা।
প্রকল্পটিতে বিভিন্ন ইকুইপমেন্ট কেনার কাজ নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে না পারায় বাড়তি দাম বাবদ গুনতে হবে ৪৬৮ কোটি টাকা। এ খাতে টাকার অবমূল্যায়নজনিত ৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা বাড়তি ব্যয়সহ মোট গচ্চা যাচ্ছে ৫২০ কোটি টাকা।
প্রকল্পটির সংশোধিত প্রস্তাবনায় বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৯ নভেম্বর দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে পায়রা সমুদ্রবন্দর। স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নির্মাণসামগ্রী ও অন্যান্য পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাসপূর্বক দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় স্থানে পরিবহন সহজতর করার জন্য অর্থাৎ পায়রা বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরুর জন্য কন্টেইনার টার্মিনাল, মাল্টিপারপাস টার্মিনালসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও অবকাঠামো নির্মাণের লক্ষ্যে মূল প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে মোট ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ হতে ডিসেম্বর ২০২১ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় অনুমোদিত হয়।
বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রকল্পের বিভিন্ন কম্পোনেন্ট যেমনÑ জেটি, কন্টেইনার টার্মিনাল, সার্ভিসলেনসহ ৬ লেনবিশিষ্ট রোড এবং আন্ধারমানিক নদীর ওপর নির্মিতব্য সেতুর ডিজাইন, ড্রয়িং চূড়ান্ত হওয়ায় ব্যয় পরিবর্তনজনিত কারণে মোট ৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০১৯ হতে জুন ২০২৩ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একনেক সভায় ১ম সংশোধন অনুমোদিত হয়। পরবর্তীতে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক ২০২৩ সালের ১২ জুলাই প্রকল্পটির মেয়াদ বায় বৃদ্ধি ব্যতিরেকে দুই বছর অর্থাৎ জুন ২০২৫ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
প্রকল্প প্রস্তাবনা সূত্রে জানা গেছে, জুন ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩ হাজার ২৯ কোটি টাকা এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৭২ শতাংশ।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পায়রা সমুদ্রবন্দরের জন্য একসেসসহ জেটি, ব্যাক-আপ ইয়ার্ড, সংযোগ সড়ক, আন্ধারমানিক নদীর ওপর সেতু নির্মাণসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ হবে। এতে বন্দরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জাহাজ নোঙরসহ কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এবং কন্টেইনার ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার মাধ্যমে বন্দরের উপযোগিতা এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি পাবে।