× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সেক্টর কর্মসূচি বন্ধ, ভেঙে পড়ছে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসেবা

ফারহানা বহ্নি

প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:২৬ পিএম

আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৩:৫২ পিএম

গ্রাফিক্স : প্রবা

গ্রাফিক্স : প্রবা

অবকাঠামো ও সেবার পেছনে গত ২৭ বছরে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচির (এইচএনপিএসপি) বিকল্প ভাবছে সরকার। দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে প্রণয়ন করা হয় স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি) অপারেশনাল প্ল্যান বা ওপি, যা বহুজাতিক ঋণদাতাদের অর্থায়নে পরিচালিত হতো। 

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের এ কর্মসূচি যেভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছিল, তাতে সম্পদের অপচয় ও কার্যক্রমের পুনরাবৃত্তি হয়েছে। বিদ্যমান খাতভিত্তিক বাজেট পদ্ধতি থেকে নিয়মিত রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরিত হওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দুই বছরের একটি এক্সিট প্ল্যান প্রস্তুত করছে। এই রূপান্তর রুটিন ব্যয়, যেমন, বেতন, ওষুধ, রোগীদের পুষ্টি, বিদ্যুৎ ও রক্ষণাবেক্ষণের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। পরিকল্পনা কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, এ রূপান্তর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও সহজ করবে ও স্বাস্থ্যসেবার দক্ষতা বাড়াবে।

এদিকে ৯ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে স্বাস্থ্য খাতের ৩৪টি উন্নয়ন কর্মসূচি। পাঁচ বছর মেয়াদি ওপি চালু না থাকায় এসব কর্মসূচি এখন বন্ধ। এর মধ্যে অন্যতম সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ, প্রাথমিক স্বাস্থ্য, বিকল্প চিকিৎসা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসার লক্ষ্যে গড়ে তোলা শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোও। তালা ঝুলছে একের পর এক কমিউনিটি হাসপাতালে। পথে বসতে শুরু করেছে কর্মচারীরাও।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইদুর বলেন, সেক্টর কর্মসূচি থেকে বের হয়ে আসার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনাধীন। এর উদ্দেশ্য চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবাকে সমন্বিত করা। আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে পুরো ওপি থেকে বের হতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচি নির্ধারণ করতে হবে। ইন্টিগ্রেটর হেলথকেয়ার ডেলিভারি সিস্টেমের আওতায় এক ছাতার নিচেই হবে সবকিছু।

জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, গত সাত আট মাস ওপি বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্য খাতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আমাদের বুঝতে হবে কোনটা বন্ধ করা উচিত আর কোনটা নয়। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে পূর্ণাঙ্গ কিছু হয়নি। সরকার যা সামনে এসেছে সেই প্রকল্পই করেছে। আবার বাতিল করে নতুন কিছু করেছে। কিছু পরিপূর্ণ ছিল না। বিপুল অর্থের ক্ষতি হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তাৎক্ষণিক নিতে হবে। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অগোছালো কাজ হয়েছে এই খাতে। অর্থনৈতিক লুটপাটও বেশি হয়েছে। তাই অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

কমিউনিটি হাসপাতালগুলো বেহাল

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে গুরুত্বপূর্ণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের ‘কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা’ (সিএইচসিপি) বেতন পাচ্ছেন না আট মাস ধরে। দেশের ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের ওষুধ, বেতন দেওয়া এবং সব সেবা চলে ওপির অর্থে। ক্লিনিকগুলোয় মজুদ থাকা ওষুধে এরই মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর, হেপাটাইটিস, ডেঙ্গু, এইডস, জলাতঙ্ক, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মতো কার্যক্রম। 

দেশের স্বাস্থ্য খাতের সিংহভাগ অবকাঠামো, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, হাসপাতালের সেবা ব্যবস্থাপনা এবং টিকা ও পুষ্টি কার্যক্রমসহ ৩০টির বেশি কর্মসূচি পরিচালিত হয় পাঁচ বছর মেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা বা অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) মাধ্যমে। গত বছরের জুনে শেষ হয় ‘চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি’। ওই বছরের জুলাই মাসেই পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য ১ লাখ ৬ হাজার ১০০ কোটি টাকার পঞ্চম এইচপিএনএসপি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে সময় তা অনুমোদন করেনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ওপি চালু না থাকায় কমিউনিটি ক্লিনিকে ১৪ হাজারের কিছু বেশি সিএইচসিপি গত জুনের পর আর বেতন পাননি।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গর্ভবতী নারী ও কিশোরীদের জন্য জরুরি ফলিক এসিড ও আয়রন ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে না।

সিবিএইচসির লাইন ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ওপি থেকে বের হওয়া এবং এর কার্যক্রম ভবিষ্যতে কীভাবে পরিচালনা করা যায়, তার রোডম্যাপ দিতে বলা হয়েছে।

হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্টের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. সুপ্রিয় সরকার বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রাজস্ব খাত থেকে দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। যেমন, শিশুদের টিকার বিষয়টা নিয়ে আগেই ভাবা হয়েছিল। রাজস্ব থেকে সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবুও এই সমস্যা সমাধান করতে ফেব্রুয়ারি চলে এসেছে। এখানেও দেরি হয়েছে। সরকারি মেডিকেলে একটা বিষয় আছে তাদের রাজস্ব খাত থেকেও একটা বরাদ্দ আসে, সেখান থেকে হয়তো ম্যানেজ করতে পারবে। কিন্তু কমিউনিটি হাসপাতালগুলো বেশি বিপদে পড়েছে। শিশু বিকাশ কেন্দ্রগুলোও অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছিল। এর আগেও এখানে কর্মরতরা দুই মাস পর বেতন পেয়েছেন। তাই তাদের একটা প্রস্তুতি ছিল কিন্তু এবার সাত-আট মাস হয়ে গেছে, যা সত্যিই তাদের জন্য অনেক বড় সমস্যা তৈরি করেছে। 

তিনি বলেন, প্রায় সাত-আটজনের চাকরি ছাড়ার নোটিস পেয়েছি। বিকাশ কেন্দ্রগুলোয় সংকট হয়নি বড় ধরনের। তবে কর্মচারীরা সংকটে পড়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকের কর্মী জাহিদুল ইসলাম আশঙ্কায় আছেন, চাকরিটা আছে কি নেই। দীর্ঘ সময় বেতন না পেয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

তিনি বলেন, সংশোধিত বাজেট অনুমোদনের পর রাজস্ব খাত থেকে বেতন হবে। আর জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বেতন দেওয়া হবে ওপি থেকে। এত প্রক্রিয়ার মাঝে বেতন কবে হবে। 

খানসামা উপজেলার হোসেনপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি আব্দুল মান্নান বলেন, সামান্য বেতন দিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাই। তার ওপর আবার গত সাত মাস ধরে বেতন বন্ধ। এতে পরিবার-পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছি। অনেক সিএইচসিপি বেতন-ভাতা না হওয়ার দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। দ্রুত এর সমাধান দরকার। 

কমিউনিটি ক্লিনিকে যে ওষুধ সরবরাহ করা হয় তা সাধারণত চার থেকে পাঁচ মাস চলে। সর্বশেষ ওষুধ সরবরাহ করা হয় গত ২ অক্টোবর। বর্তমানে কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ঠান্ডা-জ্বর ও কৃমির ওষুধ এবং আয়রন, ফলিক এসিডসহ বিভিন্ন ধরনের ২২টি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কমিউনিটি বেইজড হেলথ কেয়ারের (সিবিএইচসি) লাইন ডিরেক্টর ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, কীভাবে বেতন-ভাতা হবে জানি না। আমাদের কাছে কোনো সারাংশ আসেনি। কমিউনিটি ক্লিনিকে ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে। সংকটের শঙ্কায় আমরা ক্লিনিকগুলোকে যৌক্তিকভাবে ওষুধ খরচ করতে বলেছি।

জনস্বাস্থ্যবিদদের সংগঠন পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকার চলমান ওপি বাস্তবায়ন করার পাশাপাশি নতুন কর্মকৌশল নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে পারে। এটা প্রায় ৩০ বছর ধরে চলছে। জনস্বাস্থ্যের বড় কাজগুলো এর মাধ্যমেই হয়। পরিবর্তন করতে চাইলে ওপি চলমান অবস্থায় দুই বছর আগে কার্যক্রম শুরু করতে হয়।

বেতন না পেয়ে রাস্তায় নেমেছে শিশু বিকাশ কেন্দ্রের কর্মরতরা

প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা এবং ইন্দ্রিয় বিকাশের সুযোগ বাড়াতে ২০০৮ সালে শিশু বিকাশ কেন্দ্র গড়ে তোলা শুরু হয়। এসব কেন্দ্রে ১০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে বিশেষায়িত সেবা দেওয়া হয়। সারা দেশের ২৪টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও ১১টি জেলা সদর হাসপাতালে একটি করে মোট ৩৫টি শিশুবিকাশ কেন্দ্র আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সালের আগস্ট থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৯৩৪ জন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু চিকিৎসা নেয়।

একেকটি কেন্দ্রে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, ডেভেলপমেন্ট থেরাপিস্ট, অফিস ব্যবস্থাপক ও ক্লিনারÑ মোট পাঁচজন জনবল থাকে। ৩৫টি কেন্দ্রে জনবল আছে ১৭৫ জন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংশ্লিষ্ট শাখায় আছেন আরও ১১ জন।

গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজের চাইল্ড সাইকোলজিস্ট দীপন চন্দ্র সরকার বলেন, দীর্ঘ আট মাস বেতন ছাড়া কোনোভাবে মানিয়ে চলেছি, কিন্তু আর পারছি না। ১৫ বছর ধরে সমাজের জন্য আমরা নিরলসভাবে কাজ করে আসছি। অথচ আমাদের সঙ্গে যে বৈষম্য করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ঢাকা মেডিকেলের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের আফরোজা বেগম বলেন, অনেকেই কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। কতদিন বেতন ছাড়া থাকতে হবে জানি না। এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা