× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

টিআইবির প্রতিবেদন

নিয়ন্ত্রণহীন জিম্মি দশায় সরকারি ক্রয় খাত

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪২ পিএম

আপডেট : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২০:৪৭ পিএম

ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ছবি : প্রবা

ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। ছবি : প্রবা

আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির আঁতাতে সরকারি ক্রয় খাত নিয়ন্ত্রণহীন জিম্মি দশায় হয়েছে। এমনকি ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। সরকারি ক্রয়ের ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ পেয়েছেন শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। 

রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এই প্রতিবেদন তুলে ধরেন। ‘বাংলাদেশের ই-ক্রয়কার্য : একচ্ছত্র বাজার, যোগসাজশ ও রাজনৈতিক প্রভাব’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে সরকারি ক্রয় খাতে অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়। 

সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি ক্রয় খাত সারাবিশ্বেই সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ। বাংলাদেশে তা নিয়ন্ত্রণহীন দখলদারত্বের হাতে জিম্মি দশায় নিমজ্জিত হয়েছে। ২০১৮ সালে আমাদের একটি গবেষণায় দেখেছি যে প্রাতিষ্ঠানিক ক্রয় খাতের দুর্নীতি-অনিয়মের জন্য মোট ক্রয় বাজেটের ২৭ শতাংশ পর্যন্ত অপচয় হয়।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশা ছিলো যে ই-জিপি ব্যবস্থার মাধ্যমে এই ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হবে, সরকারি ক্রয় খাতে দুর্নীতি কমবে এবং ব্যয়িত অর্থের সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, ই-জিপির মাধ্যমে ডিজিটাইজেশন করা হলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা নিশ্চিত হয়নি; বরং ইলেক্ট্রনিক ক্রয় ব্যবস্থাকেও কুক্ষিগত করে আমলাতন্ত্র, ঠিকাদার ও রাজনৈতিক শক্তির ত্রিপক্ষীয় আঁতাতে সরকারি ক্রয়ের বাজার দখল আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে।’ 

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০১২ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ লাখ কোটি টাকার বেশি সরকারি ক্রয় খাতে ব্যয় করেছে শীর্ষ ১০টি মন্ত্রণালয়। এর সিংহভাগ অর্থাৎ ৬১ শতাংশ কার্যাদেশ পেয়েছেন শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক এই কার্যাদেশ প্রাপ্তির হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ এখানে বাজারের বিশাল অংশ প্রভাবশালী ঠিকাদারদের দখলে। 

তিনি বলেন, একক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি প্রভাবশালী ঠিকাদারদের চক্র নীতিমালার ফাঁকফোকর ব্যবহার করে যৌথ অংশীদারত্ব বা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে কার্যাদেশ নেওয়ার সুযোগকে একই উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পথ রুদ্ধ করেছে এবং দখলদারত্ব আরো ঘণীভূত করেছে। আবার ই-জিপি কর্তৃপক্ষের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে যে, মন্ত্রণালয় বা সরকারি সংস্থার নেতৃত্বের পরিবর্তন হলে শীর্ষ কার্যাদেশগুলো হাতবদল হয়েছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত থেকেছে। এটা ক্রয় খাতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের অকাট্য প্রমাণ। 

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘কর্তৃত্ববাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রেক্ষিতে একই অবস্থা অব্যাহত থাকবে কিনাÑ এ প্রশ্নের উত্তর সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি এবং ই-জিপি প্রক্রিয়ার যুগোপযোগী সংস্কারের ওপর নির্ভর করবে। তবে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও চর্চায় ইতিবাচক পরিবর্তন ছাড়া এ ক্ষেত্রে বাস্তব সুফল অর্জন অসম্ভব।’

গণমাধ্যমকর্মীদের প্রশ্নের জবাবে গবেষণা দলের প্রধান ও টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ই-জিপি সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনের অপপ্রয়োগ করে অনিয়মকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। বিশেষত জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার পরিবেশ ধ্বংস করা হয়েছে। ই-জিপি প্রর্বতনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল প্রতিযোগিতা বাড়ানো। কিন্তু সে চিত্র আমরা দেখছি না। বরং আইনের ঘাটতিকে পুঁজি করে বাজার দখলের চর্চা অব্যাহত রয়েছে। আমরা মনে করি এই দুর্বল আইনের সংস্কার প্রয়োজন।’

টিআইবির গবেষণা কার্যক্রমে ২০১২-২০২৪ সময়কালে দেশের ৬৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ই-জিপি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে মোট ছয় লাখ ৬৬ হাজার ৪৭৪টি ক্রয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০১১ সালে ই-জিপি চালু হওয়ার পর থেকে এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯৬ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত চুক্তির মূল্য ৮৮১ কোটি টাকা। এর চেয়ে বেশি মূল্যের সব চুক্তি এই প্ল্যাটফর্মের বাইরে রয়েছে। শীর্ষ ১০ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ অর্জন করেছেন। অন্যদিকে সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ ঠিকাদারের বাজার অংশীদারত্ব সব মন্ত্রণালয়ের জন্য ১ শতাংশেরও কম। 

গবেষণায় বলা হয়, শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার গত এক দশকে অধিকাংশ মন্ত্রণালয়ে তাদের বাজার অংশীদারত্ব বৃদ্ধি করেছেন। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পাঁচ শতাংশ ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭৪ দশমিক ৯৬ শতাংশ কাজ করেছেন। এই মন্ত্রণালয়ে শীর্ষ ঠিকাদারদের দখল ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা অন্যতম সর্বোচ্চ বৃদ্ধি। 

এছাড়া সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।  সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে মাত্র ১১ শতাংশ (৩৮৪ জন) ঠিকাদার ৯৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ মোট চুক্তিমূল্যের কাজ করেছেন। ৩৫ জন ঠিকাদারই ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ বাজার দখল করেছেন। এই বিভাগে নয়টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। 

পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে মাত্র ৯ শতাংশ (৩৩৬ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৯১ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ করেছেন। মাত্র ৩৮ জন ঠিকাদার দখল করেছেন ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ বাজার।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ (৬০৭ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৭১ শতাংশ কাজ করেছেন। ৮১ জন ঠিকাদার ৩২ দশমিক ৩২ শতাংশ বাজার দখল করেছেন। 

স্থানীয় সরকার বিভাগে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ (২৮৬৫ জন) ঠিকাদার মোট চুক্তি মূল্যের ৬২ দশমিক ৮৮ শতাংশ কাজ করেছেন। ২৯৪ জন ঠিকাদার ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ বাজার দখল করেছেন।

বাজার দখলের পেছনের কারণ হলো শীর্ষ ঠিকাদারদের যৌথ উদ্যোগ বা জয়েন্ট ভেঞ্চার গঠন করে বড় প্রকল্প নিয়ন্ত্রণ। গবেষণায় দেখা গেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগে নয়টি বড় ঠিকাদারি নেটওয়ার্ক সক্রিয় রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকিউরমেন্টে ১২টি প্রধান ঠিকাদারি সম্প্রদায় চিহ্নিত হয়েছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় রয়েছে ১১টি ঠিকাদারি গোষ্ঠী। শীর্ষ ঠিকাদাররা যৌথ উদ্যোগ গঠনের মাধ্যমে বাজারের বড় অংশ দখল করে রেখেছেন। 

এই ঠিকাদাররা জয়েন্ট ভেঞ্চারের মাধ্যমে যে চুক্তিমূল্যে কাজ করেছেন তা এককভাবে প্রাপ্ত কাজের পাঁচ গুণ। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিবর্তন সরকারি প্রকল্প লাভের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্যকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদারদের আধিপত্য বদলে যায়। 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে মেয়র পরিবর্তনের সময় শীর্ষ ১০ ঠিকাদারের সম্পূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আবার কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মেয়র পরিবর্তনের ফলে শীর্ষ ঠিকাদার বদলে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মাত্র দু’জন ঠিকাদার দুই মেয়রের সময়কালেই কাজ পেয়েছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী পরিবর্তনের সময়ও একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে।

এই গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সরকারি ক্রয়ে সুশাসন নিশ্চিতকরণে ছয় দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। সুপারিশমালায় রয়েছে- বাংলাদেশ পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অথরিটি (বিপিপিএ) কর্তৃক জয়েন্ট ভেঞ্চার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা, যাতে যোগসাজশের মাধ্যমে বাজার দখলের সুযোগ না থাকে; সিন্ডিকেট ভাঙতে বিপিপিএ কর্তৃক প্রতিযোগিতামূলক আইন প্রণয়ন করা এবং জয়েন্ট ভেঞ্চারের কার্যক্রম সীমিতকরণ; মার্কেট শেয়ারের ক্ষেত্রে একক ঠিকাদার ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের একটি সীমারেখা নির্ধারণ করা, যাতে সবাই সমান সুযোগ পায়; বিপিপিএসহ ক্রয় কার্যক্রমে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক ভালো চর্চাগুলো বজায় রাখা এবং একচ্ছত্র বাজার ব্যবস্থার বদলে প্রতিযোগিতমূলক পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখা; পাবলিক প্রকিউরমেন্ট নীতিমালা সংশোধন করা, যেন প্রতিষ্ঠান ও জয়েন্ট ভেঞ্চারের বেনিফিসিয়াল ওনারশিপের তথ্য সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং যে চুক্তিগুলো ই-প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়ায় হয়নি সেগুলোকে দ্রুত ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা।    

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সংস্থাটির উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর রিফাত রহমান ও কে. এম. রফিকুল আলম।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা