উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:৪০ এএম
আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৪:৩৫ পিএম
ছবি : সংগৃহীত
ভাষা নদীর মতোই কূল ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়। ভাষা হলো মানুষের প্রাণ। ভাষা ছাড়া আমরা যেমন সম্পূর্ণ মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না, ঠিক তদ্রূপ মাতৃভাষা ছাড়া গভীরতর সব আঙ্গিকে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না। একজন বাংলাভাষী মানুষ কখনও ইংরেজি ভাষায় তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারলেও সেটি অপূর্ণ থেকে যায়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে ৭,০৯৯টি ভাষা প্রচলিত রয়েছে। (তথ্যসূত্র : ইথনোলগ ২০তম সংস্করণ)। তার মধ্যে বাংলা একটি ভাষা। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক দিয়ে বাংলা পৃথিবীর চতুর্থ বৃহৎ মাতৃভাষা। বাংলা ভাষার পাশাপাশি দেশে প্রচলিত আছে বিভিন্ন জাতিসত্তার আলাদা আলাদা নিজস্ব ভাষা। ভাষার এই বৈচিত্র্য দেখা মেলে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রত্যেকেই আমরা কোনো না কোনো ভাষায় কথা বলি। এই ভাষা বৈচিত্র্যময়ের দিক থেকে একজন মানুষ যখন নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলে তখন সেই ভাষা নিজের প্রাণ যেভাবে ফিরে পায় তা অন্য ভাষাতে ফিরে পায় না। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে বাংলাদেশের ভাষাগত বৈচিত্র্য এথ্নোলগ-এর ২১তম সংস্করণ (২০১৮) অনুসারে বাংলাদেশে ৪১টি ভাষা প্রচলিত আছে সবকটি ভাষাই জীবিত।
তার মধ্যে দক্ষিণ-পূর্বদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামে মোট ১১টি নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর বসতি রয়েছে। যাদের ভাষা ব্যবহার প্রায়ই বিলুপ্তির পথে। এরা হচ্ছেন চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, খুমি, বম, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া ও ম্রো। এই জাতিসমূহের মধ্যে বেশিরভাগই নিজস্ব ভাষার বর্ণমালা থাকলেও ব্যবহার খুবই সীমিত পরিসরে। ছোটবেলা থেকে পাঠ্যপুস্তকে বাংলা ভাষায় অধ্যয়নের কারণে নিজস্ব মাতৃভাষায় কথা বলাসহ লিখিতভাবে ব্যবহার না হওয়ার কারণে এইসব জনগোষ্ঠীর ভাষা রক্ষা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি চাকমা সম্প্রদায়। যাদের ভাষা রক্ষায় নোয়ারাম চাঙমা সাহিত্য সংসদ নিজেদের ভাষায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, লিখিতভাবে ব্যবহারের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ভাষার রক্ষায় নিজেদের মাতৃভাষাকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। চাকমা সম্প্রদায়ের পাশাপাশি মারমা, ত্রিপুরা, খেয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা ও অন্যান্য জাতিসমূহ নিজেদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিলুপ্তপ্রায় ভাষার সংখ্যা মোট ১৪। তন্মধ্যেÑ
রেংমিটচ্য :
বান্দরবানে বসবাস করা ম্রো জনগোষ্ঠীর ‘রেংমিটচ্য’ ভাষা প্রায় বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এই ‘রেংমিটচ্য’ ভাষায় কথা বলতে পারাদের মধ্যে জীবিত আছেন মাত্র ছয় জন। ‘রেংমিটচ্য’ জানা এই মানুষরাও মূলত ম্রো ভাষায় কথা বলে থাকেন। এই ছয় জন সবাই একই এলাকার বাসিন্দা না হওয়া কারণে এই ভাষা চর্চার সুযোগও তাদের তেমন হয় না। এই বিপন্ন ভাষা রক্ষা করতে না পারলে, এ মানুষগুলোর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে আরেকটি ভাষা। তবে লেখক ইয়াঙান ম্রো বিলুপ্তপ্রায় এই ‘রেংমিটচ্য’ ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই ভাষার শব্দভাণ্ডার নিয়ে একটি বই প্রকাশ করেছে। কিন্তু নিজস্ব বর্ণমালা না থাকায় ‘মিটচ্য তখক’ নামের এই বইটিতে রেংমিটচ্য ভাষার উচ্চারণ ম্রো শব্দের পাশাপাশি লেখা হয়েছে বাংলা শব্দের মাধ্যমে।
শৌরা :
‘রেংমিটচ্য’ ভাষার মতো রাঙামাটির সাজেক ইউনিয়নে ‘শৌরা’ নামে একটি ভাষাও বিলুপ্তির ধারের প্রান্তে। এই ভাষায় কথা বলে মাত্র পাঁচ জন। এদের মৃত্যুর পর চিরতরে হারিয়ে যাবে এই শৌরা নামক ভাষা।
কন্দ :
বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় ‘কন্দ’ সম্প্রদায়ের ভাষার নাম কুইÑ যা এই ভাষায় কথা বলতে পারেন মাত্র চার জন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি।
খারিয়া :
অপরদিকে শ্রীমঙ্গলে মংরাবস্তিতে প্রায় ১০০-এরও বেশি পরিবারের মাতৃভাষা খাড়িয়া। কিন্তু এ ভাষায় স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারে মাত্র ২ জন। ২০২০ সালে খাড়িয়াদের ওপর একটি সমীক্ষা করে বাংলাদেশে ৪১টি খাড়িয়া গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়। গ্রামবাসীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোডা-ভাষী গ্রামগুলো হচ্ছেÑ
কোডা :
রাজশাহী বিভাগের কুন্দং এবং কৃষ্ণপুর। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কোডা বাংলার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে গেছে। দুয়েক জন প্রবীণদের মুখে কিছু কোডা শোনা গেলেও তরুণদের সবাই বাংলাতেই কথা বলেন।
মুণ্ডারি :
বাংলাদেশে মুণ্ডারি ভাষার ব্যবহার দেখা যায় সাধারণত খুলনার কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে, ডুমুরিয়া এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর, দেবহাটা ও তালা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। সুন্দরবন-সংলগ্ন নদী পাড়ের গ্রামগুলোর এই আদিবাসীরা এখন কদাচিৎ মুণ্ডা ব্যবহার করে। পাবনার ঈশ্বরদীর তরুণ মুণ্ডাদের অনেকেই প্রথম দিকে জানত না যে, তাদের নিজস্ব একটি মাতৃভাষা ছিল।
কোল :
আলাদা মুণ্ডা ভাষা হলেও কোল এবং কোডাকে মুণ্ডারির মিশ্র ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩১ থেকে ১৮৩২ সালে কোলরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব, আঞ্চলিক সীমাবদ্ধতা, শিক্ষিত শ্রেণির সমর্থনের অভাব এবং নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের অভাবে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
মালতো :
পাবনার ঈশ্বরদীর দাশুড়িয়া ইউনিয়নের মাড়মি পল্লীর অধিবাসীদের প্রথম ভাষা হলো মালতো। এ ছাড়া নাটোর, রাজশাহী ও নওগাঁ জেলায়ও রয়েছে মালতোদের বসবাস। বর্তমানে জীবিকার উদ্দেশ্যে লেখালেখির যাবতীয় কাজ বাংলায় হওয়ায়, কথা বলার সময়েও কমে গেছে এই ভাষার ব্যবহার।
খুমি :
বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার আদিবাসীরা এই ভাষা ব্যবহার করে। আরাকানীয় (বর্তমান রাখাইন, যা মিয়ানমারের একটি অঞ্চল) এবং বর্মি ভাষার বিস্তর প্রভাব এই ভাষার ওপর। বান্দরবানের রুমা, থানচি এবং রোয়াংছড়িতে খুমিদের বসবাস দেখা মেলে।
চাক :
বাংলাদেশে বান্দরবান আলিকদম উপজেলায় চাকদের বসবাস দেখা যায়। যাদের ভাষা হলো চাক। শাল বিভাগভুক্ত এই ভাষাটি সাক নামেও পরিচিত। ১৩ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কাদু জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদাভাবে পরিচিতি লাভ করে চাকরা। ১৪ শতকে তাদের রাজ্য আরাকানিরা দখল করলে তারা পার্বত্য চট্রগ্রামে প্রবেশ করে। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ের ছড়া অঞ্চলগুলোই এখন এই চাকদের নিবাস। সুরপ্রধান চাক ভাষা-সাহিত্যে বেশ সমৃদ্ধ হলেও লেখায় তেমন প্রচলন না থাকায় এখন বিপন্ন হতে চলেছে।
পাংখোয়া :
ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ব্যবহৃত কুকি ভাষার নাম পাংখোয়া, যা পাংখু, পাংখোয়া বা পাং নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে পার্বত্য রাঙামাটির সাজেক উপত্যকা থেকে বান্দরবানের রুমা সংলগ্ন এলাকায় পাংখোয়া জাতির বসবাস।
খিয়াং :
রাঙামাটির কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা এবং বান্দরবানের থানচি ও রোয়াংছড়িতে বসবাসরত খিয়াং আদিবাসীদের কথ্য ভাষা খিয়াং। বাংলাদেশে খিয়াংরা মূলত দুটি গ্রুপে বিভক্ত- লাইতু ও কংতু। লাইতুরা থাকে সমতলে আর কুংতুরা থাকে পাহাড়ি এলাকায়। এদের বেশিরভাগই বর্তমানে বাস করে রাজকীয় মং সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাই কথ্য রীতিতে আর আগের সেই মৌলিকতা নেই। অবশ্য তা ফিরিয়ে আনার জন্য খুব ছোট পরিসরে হলেও তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ৭টি পাহাড়ি ভাষার শব্দকোষের মধ্যে খিয়াং একটি।
লালেং (পাত্র) :
বাংলাদেশের উপভাষাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত পাত্র বা লালেং ভাষা। এদের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গহিন জঙ্গলে এই ভাষাভাষী লোকদের বসবাস করতে দেখা যায়। এই ভাষার নাম মূলত লালেং ঠার বা লাইয়ুংটার।
লুসাই :
উত্তর-পূর্ব ভারত ও মিয়ানমারের প্রসিদ্ধ একটি ভাষা লুসাই। আসামের লুসাই পাহাড় থেকেই এই ভাষার নামকরণ হয়েছে। বাংলাদেশের রাঙামাটি সদরের বাঘাইছড়ি এবং বান্দরবান সদর ও রুমায় দেখা যায় লুসাইদের গ্রাম।
ভাষার মাসে আমরা ভাষা তাৎপর্য খুঁজি। কিন্তু বিলুপ্তির ধারের প্রান্তে থাকা ভাষাগুলো রক্ষা করার জন্য উদ্যোগী নই বটে। বিলুপ্তি না হওয়ার আগ মুহূর্তে ভাষাবৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব ভাষা ব্যবহারের উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত।
লেখক : উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা, শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়