নদী রক্ষা আন্দোলন
ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৮:০৩ পিএম
আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ২২:৩৫ পিএম
উজানে ভারতে ভারতে একতরফা পানি প্রত্যাহারের প্রতিবাদে মঙ্গলবার তিস্তা নদীতে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ। ছবি : প্রবা
স্বাধীনতার ৫৪ বছর ধরে তিস্তা নদীর ভাঙনের সঙ্গে জীবন-জীবিকা নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছেন নদীপাড়ের মানুষ। এবার বুঝি সেই জীবন-যুদ্ধের একটা ফয়সালা হচ্ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে জেগে উঠেছে উত্তরাঞ্চলে পাঁচ জেলায় সাধারণ মানুষ। তাদের মুখে মুখে একটাই স্লোগান- ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’।
‘তিস্তা হামার প্রাণ, তিস্তা হামার জীবন রেখা’ স্লোগানে দুদিন মুখর হয়ে থাকলো তিস্তাপার। সোমবার থেকে টানা ৪৮ ঘণ্টা লাখ লাখ মানুষ এখানে পালন করলেন অবস্থান কর্মসূচি। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা ও নদীভাঙন রোধ এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্বঘোষিত এই কর্মসূচি শেষ হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার।
‘জাগো বাহে-তিস্তা বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের ব্যানারে এই কর্মসূচিতে অংশ নেয় বিএনপিসহ মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো। তিস্তা চুক্তিসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন সমস্যার সমাধান ও দেশের স্বার্থ রক্ষায় ভারতের ওপর চাপ বাড়াতে এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
লালমনিরহাট তিস্তা রেল সেতুসংলগ্ন এলাকায় গত সোমবার কর্মসূচির উদ্বোধন করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সমাপনী দিনে গতকাল ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এতে বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তার বক্তব্যে ছিল রাজনৈতিক দিকনির্দেশনাও।
এ ছাড়া দেশের উত্তরের পাঁচ জেলা- লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও নীলফামারীর ১১ স্থানে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের উপস্থিতিতে সমাবেশ হয়।
এসব কর্মসূচিতে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও ভারতের পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তা। নদীটির পানি ব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতভেদ সৃষ্টি করে আসছে।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে তিস্তা ব্যারাজ পরিকল্পনার মাধ্যমে তিস্তা সংলগ্ন এলাকার কৃষকের উন্নয়নের সূচনা করেন। ১৯৭৭ সালে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে গঙ্গার পানির হিস্যা ৪৫ হাজার কিউসেক করা হয়। বিএম আব্বাস এটি-র নেতৃত্বে বাংলাদেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।
১৯৮৩ সালে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হলেও এর সুনির্দিষ্ট বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারিত না হওয়ায় সমস্যার সমাধান হয়নি। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে দ্বিপক্ষীয় সংকট দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধানে নতুন করে উদ্যোগ নেন। কিন্তু রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য আওয়ামী লীগ ভারত-বিরোধিতার রাজনীতিকে উসকে দেয়। ফলে তিস্তা উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যায়। এবার জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বাবা-মায়ের সেই স্বপ্ন পূরণে নতুন করে উত্তরাঞ্চলের মানুষের পাশে দাঁড়ালেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দিলেন নতুন প্রতিশ্রুতি।
গত ২০০৭ সালে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ সমানভাবে ভাগ করার প্রস্তাব দিলেও ভারত তাতে সম্মতি দেয়নি। ভারত উজানে গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশ অভিমুখে তিস্তার পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে। ২০১১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি, যা সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফাভাবে তিস্তা নদীর পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি পুরোপুরি শুকিয়ে যাচ্ছে।
পানির জন্য বিপাকে পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের তিন কোটি মানুষকে। নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম জেলার রাজাহাট, উলিপুর ও চিলমারী, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া ও পীরগাছা এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে তিস্তা। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার কুড়িগ্রামের রাজারহাট, কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলা।
ভারতের সিকিমে হিমালয়ের সাত হাজার ২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে তিস্তা নদীর সৃষ্টি। প্রায় ২৪০ বছরের পুরোনো নদী তিস্তার সঙ্গে রয়েছে উত্তরের ২৫টি নদীর প্রবাহ। গত ২০১৪ সাল থেকে ভারত সরকার একতরফা তিস্তার পানি প্রত্যাহার করছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে নদীটি একেবারেই শুকিয়ে যাচ্ছে তিস্তা। নদীশাসন না হওয়ায় গত পাঁচ বছরে তিস্তার গতিপথও পরিবর্তন হয়েছে।
পানি সংকটে শুষ্ক মৌসুমে কৃষির প্রয়োজনীয় সেচ দেওয়া নিয়ে বিপাকে পড়েন উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলার কৃষক। পানির অভাবে ফসলের ক্ষেত ফেটে হয় চৌচির। অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত ব্যারাজগুলোর মুখ খুলে দেওয়ায় প্রতিবছরই বন্যায় প্লাবিত হয় এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। খরা মৌসুমে পানি না পাওয়া এবং বর্ষা মৌসুমে অতি প্রবাহের কারণে তিস্তা নদী গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এ অঞ্চলের মানুষের জন্য। এ পরিস্থিতিতে তিস্তাকে ঘিরে উন্নয়ন প্রকল্পে আগ্রহ প্রকাশ করেছে চীন। তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনাসহ নদীকে ঘিরে নানা অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চীনের এ আগ্রহে হঠাৎ নতুন করে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে তিস্তা নদী।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে এই নদীর পার হয়ে উঠবে পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির মতো স্যাটেলাইট শহর। আবার বাংলাদেশের বড় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও হবে বিশ্বের মধ্যে প্রথম।
চীনের হোয়াংহো নদীকে একসময় বলা হতো চীনের দুঃখ। প্রতিবছর ওই নদীর পানি ভাসিয়ে দিতো শত শত মাইল জনপদ। ভেঙে নিয়ে যেত বহু গ্রাম-পথ-ঘাট আর জনপদ। সেই সর্বনাশা হোয়াংহো নদী শাসন করায় (পরিকল্পিত ড্রেজিং) চীনের মানুষের দুঃখ ঘুচেছে। হোয়াংহো এখন হয়ে উঠেছে চীনের কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ।
হোয়াংহোর মতোই এখন বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের ‘পাগলা নদী’ খ্যাত তিস্তা ড্রেজিং করে কয়েক কোটি মানুষের দুঃখ ঘোচানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। তিস্তা নদীকে ঘিরে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন অর্থায়ন করবে। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং চীনের পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না বা পাওয়ার চায়নার মধ্যে ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
মহাপরিকল্পনায় পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার চীনের সেই প্রস্তাবনার আলোকেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেছে।
চীনের প্রস্তাবিত এই ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্যের চাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে ভারত থেকে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত পানি আর প্রয়োজন পড়বে না। নদীর গভীরতা বাড়বে প্রায় ১০ মিটার। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রাম-গঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে।
এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দুপাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষি জমি উদ্ধার ও এক লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছর ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন। নৌবন্দর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনা সম্পর্কে চীনের তৈরি প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সুকিয়ান সিটির আদলে তিস্তার দু’পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প ও পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে সাত থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সরকার। চায়না পাওয়ার কোম্পানি ইতোমধ্যে তিস্তাপাড়ে নির্মিতব্য প্রকল্প বাস্তবায়নে নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করেছে। তিস্তা নদীরপাড়ের জেলাগুলো নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় চায়নার তিনটি প্রতিনিধি দল কাজ করছে।