× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

৯৭ কোটি টাকার প্রকল্পে ৭৪ কোটিতেই নয়ছয়

আরমান হেকিম

প্রকাশ : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২৫ এএম

আপডেট : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:৩৯ এএম

প্রবা গ্রাফিক্স

প্রবা গ্রাফিক্স

অনিয়ম-দুর্নীতির মচ্ছবে পরিণত হয়েছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সম্ভাব‍্য সমীক্ষা ছাড়াই নেওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। এক দশকে অর্ধেক কাজও হয়নি। অথচ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল তিন বছর। নিজের খেয়াল-খুশিমতো ড্রয়িং-ডিজাইন পরিবর্তন করেছেন প্রকল্প পরিচালক। ৯৭ কোটি টাকার প্রকল্পটির ৭৪ কোটি টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অবস্থায় প্রকল্পের ব‍্যয় আরও ৮০ কোটি টাকা বৃদ্ধি করতে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট উইংয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, সম্ভাব্য সমীক্ষা ছাড়া প্রকল্প নিলে সেটার সঠিক কোনো রোডম্যাপ থাকে না। ফলে কাজ করতে গিয়ে যেখানে আটকায় সেখানে আবার নতুন করে ডিজাইন ও পরিকল্পনা করতে হয়। এছাড়া মনগড়াভাবে নানা পরিবর্তনও আনা হয়। এ প্রকল্পটির ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। এই সুযোগ নিয়ে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরাও খেয়াল-খুশিমতো বিল করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। নতুন করে যে ৮০ কোটি টাকা লাগছে, সেটি দুর্নীতি ও সমীক্ষা না করার খেসারত।

সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের ওপর মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. কাইয়ুম আরা বেগমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় প্রস্তাবের ওপর নানা ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। 

জানতে চাইলে শিক্ষা উইংয়ের যুগ্ম প্রধান রাহনুমা নাহিদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘প্রকল্পটি নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ইউজিসিতে ডিও লেটার দিয়েছিলেন। এখন তারা (বিশ্ববিদ্যালয়) নতুন করে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে প্রথম সংশোধনীর প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আমরা পিইসি সভায় আমাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছি। দুদকের মামলা ও মন্ত্রীর ডিও লেটারের বিষয়ে জবাব চেয়ে প্রকল্পটি ফেরত পাঠিয়েছি। তারা জবাব দিলে পরবর্তী পদক্ষেপে যাওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু প্রকল্পটিতে নানা বিতর্ক রয়েছে, সেজন্য আমাদের পর্যবেক্ষণ ছিল প্রকল্পের সংশোধনী না এনে নতুন প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হোক।

তিন বছরের কাজ গড়াচ্ছে ১২ বছরে

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া হয় প্রকল্পটি। এটির মেয়াদ ছিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে না পারায় বেশ কয়েকবার মেয়াদ বাড়িয়ে সবশেষ ২০২৫ সাল পর্যন্ত করা হয়। কিন্তু ১০ বছর পার হলেও কাজ শেষ করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। বর্তমানে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় ৮০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৭৮ কোটি টাকা করতে বলেছে। প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৯৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাশাপাশি মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচ দফা সময় বাড়িয়ে সাড়ে ৩ বছরের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট সময় লাগছে সাড়ে ১২ বছর।

প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে ড্রয়িং ও ডিজাইন পরিবর্তন, কিছু অঙ্গের ব্যয় ও পরিমাণ বৃদ্ধি এবং কিছু অঙ্গে গণপূর্ত বিভাগের রেট শিডিউল পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন পদ্ধতি অনুযায়ী ২৫ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে প্রাক্কলিত ব্যয় সম্পন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প নেওয়ার আগে আবশ্যিকভাবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার কথা। কিন্তু এ প্রকল্পে সেটি করা হয়নি। অর্থাৎ আইন লঙ্ঘন করেই প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। 

পিইসি সভা সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির নানা অনিয়ম ও ও ত্রুটি-বিচ্যুতির বিষয়ে বৈঠকে প্রশ্ন তোলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো সদুত্তর মেলেনি। এ কারণে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের সুপারিশ করেনি কমিটি। সভায় চলমান প্রকল্পটির বিস্তারিত কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছে। সেগুলো পেলে নতুন করে আবারও পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্র জানায়, প্রকল্পের অনুমোদিত ডিপিপিতে প্রধান তিনটি অঙ্গের যে ড্রয়িং বা ডিজাইন ছিল, সেই অনুমোদিত ড্রয়িং, ডিজাইন পরিবর্তন করে পরিবর্তিত ড্রয়িং ও ডিজাইন অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। পরিবর্তিত ডিজাইনে অনুমোদিত ডিপিপিতে উল্লিখিত ড্রয়িং ও ডিজাইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে, যা প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) কোনো সভায় উত্থাপন করা হয়নি বা এ বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এটি নিয়মের ব্যত্যয়।

প্রকল্প পরিচালকের দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে কাজ হয়নি অর্ধেকও। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৪৭ শতাংশ। 

প্রকল্প বাতিল করতে ডিও 

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত প্রকল্পটির চতুর্থ দফা মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব ২০২২ সালে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় ইউজিসি। তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান ওই বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার পাঠান। ওই পত্রে সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকা অনুযায়ী কাজ অসমাপ্ত রেখে প্রকল্পটি সমাপ্ত ঘোষণা করা এবং প্রকল্পের অসমাপ্ত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য নতুন একটি প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ দেন তিনি। একই সঙ্গে ইউজিসি এবং আইএমইডির সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে এ প্রকল্পের টেন্ডারসহ বাস্তবায়ন পর্যায়ে নানা ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও পরামর্শ দেন সাবেক মন্ত্রী। কিন্তু এগুলো মানা হয়নি।

৭৪ কোটি টাকার দুর্নীতির অনুসন্ধান

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ৭৪ কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্প পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক একেএম নূর-উন-নবী, তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জাহাঙ্গীর আলম ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হাবিব অ্যান্ড কোং বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল, ড. ওয়াজেদ মিয়া রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণে ৭৪ কোটি ১০ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৯ টাকা বরাদ্দ করা হয়। তবে ছাত্রী হলের ১০ তলা ভবনের জায়গায় শুধু পাঁচতলা পর্যন্ত কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া ইনস্টিটিউটের ১০ তলা ভবনের বদলে তিনটি ভবনের আংশিক কাজ হয়েছে, যার মধ্যে একটি পাঁচতলা ও দুটি দোতলা। স্বাধীনতা স্মারক প্রকল্পেও অনিয়ম হয়েছে।

দুদকের তদন্তে দেখা যায়, প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে। ম্যাট ফাউন্ডেশনের কংক্রিটের মূল্য প্রতি ঘনমিটার ১০ হাজার ৯৭০ টাকা থাকার কথা থাকলেও তা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়। এছাড়া দরপত্র প্রক্রিয়ায় গাণিতিক ভুল দেখিয়ে প্রথম সর্বনিম্ন দরদাতাকে বাদ দেওয়া হয়।

সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসারে ৩০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের চুক্তির জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। তবে এই প্রকল্পে সেই অনুমোদন নেওয়া হয়নি। স্বাধীনতা স্মারক নির্মাণে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও অনুমোদন ছাড়াই ১ কোটি ৬ লাখ টাকা ব্যয়ে আংশিক কাজের চুক্তি করা হয়।

এছাড়া পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তিন কিস্তিতে ৮৪ লাখ ২৪ হাজার টাকা ক্যাশ চেকে পরিশোধ করা হয়, যার অনুমোদনের কোনো নথি পাওয়া যায়নি। দুদক এই পুরো প্রকল্পকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছে।

জানতে চাইলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শওকত আলী বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানকে আমরা সহযোগিতা করছি। প্রকল্প বাস্তবায়নের অনেক নিয়ম-নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে। প্রকল্পটি ৯৭ কোটি টাকার ছিল। পরে এটা বাড়িয়ে ১৭৮ কোটি টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেটি মন্ত্রণালয় আটকে দেয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ঠিকাদারকে কাজের চেয়ে অতিরিক্ত ১৫ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, যা নিয়মবহির্ভূত। ঠিকাদার কোনো কাজই সম্পন্ন করেননি।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা