প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০০:৫৬ এএম
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার সোমবার ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটির প্রতিবেদন দাখিল উপলক্ষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ছবি : সংগৃহীত
শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় মূল্যায়নে ধারাবাহিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন দিয়ে প্রত্যেক শিশুর শিখন-অগ্রগতি যাচাই করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বা এ ধরনের পরীক্ষার পরিবর্তে ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টের (এনএসএ) আদলে (তবে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য) মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে প্রতি বিদ্যালয়কে মান অনুযায়ী সবুজ-হলুদ-লালে চিহ্নিত করা হবে। প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে প্রতি বিদ্যালয়কে সবুজে রূপান্তরিত করা।
প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে এরকম আরও শতাধিক সুপারিশ তুলে ধরেছে পরামর্শক কমিটি।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদের নেতৃত্বাধীন ‘প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটি’ সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন তুলে ধরে।
পরে সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে কমিটির সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন অধ্যাপক মনজুর আহমদ। এ সময় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘পরামর্শক কমিটি যেসব সুপারিশ করেছে, তা মানার নৈতিক দায় আমাদের আছে। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। তাদের কিছু সুপারিশ আমরা নিজেরাই বাস্তবায়ন করতে পারব। কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে অন্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে আমরা চেষ্টা করব। আর কিছু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত দরকার। বর্তমান সরকার শিক্ষকদের জীবনের মানোন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদার উন্নয়নে ইতিবাচক।’
শতাধিক সুপারিশের মধ্যে নির্বাচিত ১৪টি সুপারিশ ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করা হয়। সেগুলো নিচে তুলে ধরা হলো-
বাংলা-গণিতে ৭৫ মিনিটের ক্লাস
প্রাথমিক শিক্ষার মূল লক্ষ্য হিসেবে শিশুদের বাংলা ও গণিতের ভিত্তিমূলক দক্ষতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলা শুধু একটি বিষয় নয়, এটি অন্য সব বিষয়ে প্রবেশের চাবিকাঠি। গণিতে মৌলিক দক্ষতা অর্জিত না হলে শিক্ষার্থীরা শিখনে ক্রমাগত পিছিয়ে থাকবে। এজন্য প্রতিদিন এ দুটি বিষয়ে ৬০ থেকে ৭৫ মিনিট করে শিক্ষণ-শিখন সময় নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
দুই শিফট বাতিল করে এক শিফটের স্কুল
শিখন সময় বাড়ানোর জন্য সব বিদ্যালয়কে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এক শিফটের স্কুলে পরিণত করা প্রয়োজন। পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমে (পিইডিপিএস) অন্তত ৫০ শতাংশ বিদ্যালয়ে ও ১০ বছরের মধ্যে সব বিদ্যালয়ে এক শিফট চালু করা যেতে পারে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত অনূর্ধ্ব ১:৩০ অর্থাৎ, প্রতি ৩০ জন ছাত্র-ছাত্রীর জন একজন শিক্ষক নিশ্চিত করা দরকার।
পিছিয়ে পড়া শিশুদের জন্য করণীয়
পিছিয়ে পড়া শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাসের ভেতরে ও বাইরে নিরাময়মূলক সহায়তা দিতে হবে। এজন্য স্কুল স্থানীয়ভাবে প্যারা-টিচার (শিক্ষা-সহায়ক) নিয়োগ দিতে পারে।
শিক্ষার্থী ও বিদ্যালয় মূল্যায়ন
ধারাবাহিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন দ্বারা প্রত্যেক শিশুর শিখন-অগ্রগতি যাচাই করতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বা এ ধরনের পরীক্ষার পরিবর্তে এনএসএ (ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট)-এর আদলে (তবে সহজে বাস্তবায়নযোগ্য) মৌলিক দক্ষতা জরিপের মাধ্যমে প্রতি বিদ্যালয়কে মান অনুযায়ী সবুজ-হলুদ-লালে চিহ্নিত করা হবে। প্রধান শিক্ষক ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে প্রতি বিদ্যালয়কে সবুজে রূপান্তরিত করা।
দরিদ্র পরিবারের ব্যয় কমানো
যতদ্রুত সম্ভব মিড-ডে-মিল প্রবর্তন, খাতা-কলম-ব্যাগ ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত অতি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য বর্ধিত হারে অর্থ সাহায্য দেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর পেশাগত উন্নয়ন
শিক্ষক ও মাঠপর্যায়ের শিক্ষাকর্মীদের পেশাগত মর্যাদা, পদোন্নতি ও পেশাগত অগ্রগতির ব্যাপারে নির্দিষ্ট আশু পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। প্রস্তাবানুসারে ‘সহকারী শিক্ষক’ পদবি বিলুপ্ত হবে; ‘শিক্ষক’ হিসেবে কর্মজীবনের সূচনার পর ‘সিনিয়র শিক্ষক’ হিসেবে পরবর্তী পদোন্নতি হবে। সেইসঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে প্রাথমিক শিক্ষকসহ বিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো বিবেচনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ উদ্দেশ্যে আশু উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমানে শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে আছেন এবং প্রধান শিক্ষকের জন্য সরকার ১১তম গ্রেড দিয়েছে। প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেডে পদায়নের দাবি উচ্চ আদালতে সমর্থন পেয়েছে, কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে রিভিউ আবেদন করেছে।
সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র মর্যাদা ও উচ্চতর বেতন কাঠামো প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কমিটির অন্তর্বর্তী সুপারিশ: শিক্ষক পদে প্রবেশ ১২তম গ্রেডে, দুই বছর পর স্থায়ীকরণ, আরও দুই বছর পর ১১তম গ্রেডে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি।
প্রধান শিক্ষকের ক্ষেত্রে সুপারিশ
সরকারের রিভিউ আবেদন প্রত্যাহার ও প্রধান শিক্ষকের জন্য দশম গ্রেড নির্ধারণ এবং সব প্রধান শিক্ষক পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ। শিক্ষক এবং প্রধান শিক্ষক নিয়মানুসারে উচ্চতর স্কেল পাওয়ার যোগ্য হবেন। সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ বাড়ানো যেতে পারে এবং সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্য থেকে দায়িত্ব ভাতাসহ পদায়ন করা যেতে পারে।
মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে পদোন্নতিযোগ্য পদসমূহ ও শূন্যপদ আশু পূরণ, সমন্বিত গ্রেডেশন, পারস্পরিক বদলি, আঞ্চলিক অফিস স্থাপন এবং প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সার্ভিস বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।।
দুর্নীতি ও অসদাচরণ নিরোধ
দুর্নীতি, অসদাচরণ ও কর্তব্যে অবহেলা নিরোধের লক্ষ্যে একটি অন্যতম সুপারিশ হলো, অভিযোগ জানানোর জন্য দেশব্যাপী হট-লাইন স্থাপন করা যেতে পারে। সব অভিযোগের নিরপেক্ষ তদন্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে এসব তথ্য নিয়মিত সময়ান্তরে জনসমক্ষে প্রকাশ করা যেতে পারে।
বিকেন্দ্রায়নে পাইলট প্রকল্প
শিক্ষা শাসন ও ব্যবস্থাপনার প্রকৃত বিকেন্দ্রায়নের উদ্দেশ্যে দেশের ১০ জেলার ২০টি উপজেলায় পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় পাইলট প্রকল্প শুরু করা যেতে পারে।
প্রাক-প্রাথমিকের মান ও বিস্তার
চলমান পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার যথাযথ মানোন্নয়ন এবং চার বছরের বেশি বয়সী শিশুদের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমের পাশাপাশি অন্যান্য বিদ্যালয়েও অভিভাবকদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এর বিস্তার প্রয়োজন।
বিদ্যালয়-বহির্ভূত শিশুদের কার্যসূচি
বিদ্যালয়-বহির্ভূত ও ঝরেপড়া শিশুদের কার্যসূচির জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত ও দক্ষ এনজিওদের সহযোগিতার মাধ্যমে কার্যকর মডেল তৈরি করতে হবে।
সুযোগবঞ্চিতদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ
বিভিন্নভাবে সুযোগবঞ্চিত শ্রমজীবী, প্রতিবন্ধী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগের সুপারিশ করা হয়েছে। জেন্ডার ন্যায্যতা ও জলবায়ু অভিঘাত বিষয়ে এবং দুর্গম এলাকার শিশু ও পার্বত্য চট্টগ্রামসহ অন্যান্য অঞ্চলের বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর শিশুদের শিক্ষার সুযোগ বাড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ
শিক্ষকদের প্রি-সার্ভিস শিক্ষা ও যোগ্যতা অর্জন এবং শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের নিরন্তর পেশাগত উন্নয়নের (কন্টিনিউয়াস প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট) সুপারিশ করা হয়েছে।
শিক্ষার সামগ্রিক পরিকল্পনা ও স্থায়ী শিক্ষা কমিশন
সর্বজনীন প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত মানসম্মত বিদ্যালয় শিক্ষার খাত পরিকল্পনা এবং স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের বিষয় সুপারিশ করা হয়েছে।
সমগ্র শিক্ষাখাতের জন্য পরামর্শক পরিষদ
প্রাথমিক শিক্ষা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র শিক্ষাখাতের সংস্কার ও উন্নয়নের জন্য সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার উদ্দেশ্যে শিক্ষা পরামর্শক পরিষদ গঠিত হতে পারে। পরে তা স্থায়ী শিক্ষা কমিশনে রূপান্তরিত হতে পারে।
সুপারিশ প্রতিবেদনের শেষাংশে বলা হয়, শিক্ষা সংস্কারের জন্য কোনো সহজ জাদু সমাধান নেই। প্রস্তাবিত সুপারিশ নিয়ে সরকারকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সময়াবদ্ধ সমন্বিত বাস্তবায়ন কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। পঞ্চম প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কার্যক্রম ও সরকারের বার্ষিক বাজেট হবে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রধান বাহন।
গত অক্টোবরে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা সংস্কারে পরামর্শক কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক মনজুর আহমেদকে। কমিটিতে একজন সদস্যসচিব ও ৭ জন সদস্য ছিলেন।
কমিটির সদস্যরা হলেন- প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও সাবেক সচিব খোন্দকার মো. আসাদুজ্জামান, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সাবেক মহাপরিচালক মো. রফিকুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পিইডিপি-২ এর সাবেক যুগ্ম প্রোগ্রাম পরিচালক চৌধুরী মুফাদ আহমেদ, গণসাহায্য সংস্থার পরিচালক (শিক্ষা) বেগম সামসি হাসান, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইরাম মারিয়াম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহবুব মোরশেদ এবং শিবরাম আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. নূরুল আলম।