কর্মশালায় বক্তারা
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৩২ পিএম
আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৪৭ পিএম
বুধবার রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ, কোম্পানির কূটকৌশল ও গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালার আয়োজন করা হয়। প্রবা ফটো
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ধূমপানের হার সবচেয়ে বেশি। তারপরের স্থানে যথাক্রমে রয়েছে ভারত, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার রাষ্ট্রীয় ঘোষণার পরও এটি কমানো সম্ভব হচ্ছে না কোম্পানিগুলোর কূটকৌশলের কারণে।
বুধবার (৫ জানুয়ারি) ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ, কোম্পানির কূটকৌশল ও গণমাধ্যমের করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর বিএমএ মিলনায়তনে এ কর্মশালাটির আয়োজন করে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রগতির জন্য জ্ঞান (প্রজ্ঞা) এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া অ্যালায়েন্স (আত্মা)। এতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের অর্ধশত সাংবাদিক অংশ নেন।
আলোচনায় অংশ নেন বিসিআইসির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এডিটর সাজ্জাদুর রহমান, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি দৌলত আকতার মালা, আত্মার কনভেনর লিটন হায়দার, কো-কনভেনর নাদিরা কিরণ ও মিজান চৌধুরী, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের। কর্মশালায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করন মো. হাসান শাহরিয়ার ও মেহেদি হাসান।
প্রবন্ধে বলা হয়, প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার নিয়ে সবশেষ গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোবাকো সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৬ শতাংশ ধূমপান করে, ভারতে এ হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ধূমপানের হার ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং পাকিস্তানিদের মধ্যে ধূমপান করেন ১৯ দশমিক ১ শতাংশ।
কর্মশালায় বলা হয়, শক্তিশালী আইন করে তামাকের ব্যবহার কমানোর সুযোগ রয়েছে, কিন্তু তামাক কোম্পানিগুলোর কূটকৌশলের কারণে তরুণরা ধূমপানে জড়িয়ে পড়ছে।
সেমিনারে বলা হয়, বিশ্বে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর সর্ববৃহৎ কারণ হচ্ছে তামাক। তামাকের কারণে বিশ্বে বছরে ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তামাকের আর্থ-সামাজিক, পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ক্ষতিও ব্যাপক। তামাকের বহুমাত্রিক ক্ষয়-ক্ষতি রোধে সরকারসমূহ ২০০৩ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ডব্লিওএইচও ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষর করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) ২০২৪ সালের প্রতিবেদনের হিসেবে বিশ্বে ২০০০ সালের তুলনায় ২০২২ সালে প্রাপ্তবয়ষ্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাকের ব্যবহার কমেছে ৩৬ শতাংশ। শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করলে এ হার আরও বাড়বে।
কর্মশালায় আরও বলা হয়, বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম দেশ হিসেবে ২০০৩ সালে এফসিটিসি স্বাক্ষর করে এবং ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস করে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করা হয়। দেশে ২০০৯ সালে ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাকের ব্যবহার ছিল ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০১৭ সালে ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে আসে। অর্থাৎ ৮ বছরে তামাক ব্যবহার কমেছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে এখনও ৩ কোটি ৭৮ লাখ (৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ) প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করেন। ১৩-১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯ দশমিক ২ শতাংশ (জিএসএইচএস ২০১৪)। তামাক ব্যবহারজনিত রোগে বছরে ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। পঙ্গুত্ববরণ করেন আরও কয়েক লাখ মানুষ।
কর্মশালায় জানানো হয়, সম্প্রতি আইন সংশোধনকে বাধাগ্রস্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলো অর্থ এবং আইন উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়েছে। সেখানে তারা আইন সংশোধন হলে সরকারের রাজস্ব হারানোসহ বেশকিছু ভিত্তিহীন তথ্য তুলে ধরেছে দুটি কোম্পানি। এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৫ সালে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হওয়ার পর পরবর্তী দুই অর্থবছরে সিগারেট খাতে রাজস্ব আয় বেড়েছে যথাক্রমে ১৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ এবং ৩৭ দশমিক ৫২ শতাংশ। একইভাবে, ২০১৩ সালে সংশোধনীর পরবর্তী দুই অর্থবছরে সিগারেট খাতে রাজস্ব আয় বেড়েছে যথাক্রমে ২৫ দশমিক ৫১ শতাংশ এবং ৪৬ দশমিক ৫২ শতাংশ।
বক্তারা বলেন, এফসিটিসির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার জন্য ২০২১ সালে আইন শক্তিশালীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আইন প্রণয়নে তামাক কোম্পানি ও তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো গোষ্ঠীর পরামর্শ বা মতামত গ্রহণ এফসিটিসি আর্টিকেল ৫ দশমিক ৩ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তা ছাড়া প্রতিবছর জাতীয় বাজেটকে প্রভাবিত করতে সিগারেট কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনকে ব্যবহার করে থাকে। মালিকদের অর্থায়নে বিড়ি শ্রমিকরা মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে বিড়ির মূল্য না বাড়ানোর আন্দোলন করে। এছাড়া সুবিধাভোগীদের দিয়ে কলাম ও নিবন্ধ প্রকাশ, ডিও লেটার প্রদান ইত্যাদি কূট-কৌশল অবলম্বন করে কোম্পানিগুলো।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘তামাকমুক্ত দেশ গড়তে হলে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। টোব্যাকো কোম্পানিগুলোকে শক্ত করে ধরতে হবে। তা ছাড়া এসব কোম্পানিতে সরকারি অংশ প্রত্যাহার ও সচিবদের এসব কমিটি থেকে বাদ দিতে হবে।’
রিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তামাক নিয়ে রাষ্ট্রের পলিসি হচ্ছে ২০৪১ সালে আমরা তামাকমুক্ত দেশ গড়ব। এ পলিসি করেও কেন নতুন করে কোম্পানি করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে? কোম্পানি করার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।’
দৌলত আকতার মালা বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণে নতুন সমস্যা তৈরি হয়েছে। সেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সরকারিভাবে আইন তৈরিতে কী ধরনের পরিবর্তন আসছে তা নিয়ে রিপোর্ট করা দরকার। আর যারা রাজস্ব কমবে বলে তথ্য দিচ্ছে তাদের গবেষণা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। আর নীতি নির্ধারকদের আটকাতে আইনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।’
এস এম জুবায়ের বলেন, ‘তামাক কোম্পানির সঙ্গে আমাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা তারা মানুষ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করছে। আর আমরা মানুষকে বাঁচানোর জন্য কাজ করছি।’