বিশ্ব ক্যানসার দিবস আজ
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:১৩ এএম
ফাইল ফটো
পিরোজপুরের বাসিন্দা হামিদা বেগম ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন দীর্ঘ সময় ধরে। বড় ছেলে শাহীনুরের সঙ্গে চিকিৎসা নিতে রাজধানীর মহাখালীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এসেছেন। শাহীন বলেন, কেমোথেরাপি দিতে হচ্ছে মাকে। কিন্তু এখানে পদে পদে হয়রানির শিকার হয়। চার-পাঁচ মাস আগ থেকেই সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। চিকিৎসক রেডিওথেরাপি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু এখানে মেশিনগুলোও বারবার নষ্ট হয়ে যায়। একে তো সিরিয়ালের ঝামেলা তারপর আবার মেশিন নষ্ট।
তিনি বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে কোথাও থাকতেও অনেক খরচ। অসুস্থ মাকে নিয়ে যেভাবে-সেভাবে থাকাও তো যায় না।
এ গল্প শুধু হামিদা বেগম ও তার ছেলে শাহীনের নয়, দেশের ক্যানসারে আক্রান্ত প্রায় সবার একই ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
জরায়ু মুখ ক্যানসারে আক্রান্ত রোজিনা ইসলাম। হাসপাতালে এসেছেন তার ১২ বছর বয়সি মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি বলেন, আমার শরীর ভালো নয়। মেয়েটা ছোট। এদিকে হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি। এখনও চিকিৎসা শুরু হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সরেজমিন গত রবিবার হাসপাতালটিতে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই ফজরের আজানের পর এসে সিরিয়াল দিয়েও পেছনে পড়ে আছেন। শত শত মানুষ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেউবা মেঝেতে বসে আছেন।
বহির্বিভাগে সিরিয়ালের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ভুক্তভোগী ফাহিম আহমেদ জানান, বহির্বিভাগে দুপুর ২টার মধ্যে চিকিৎসক দেখাতে হয়। তবে রোগীর ফাইল দুপুর ১২টার মধ্যে জমা দিতে হয়। এ কারণে অল্প সময়ে এত রোগীর সিরিয়াল শেষ হয় না।
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের ভোগান্তির এই চিত্র দীর্ঘদিনের। নানা অভিযোগের পর এতদিনেও কোনো সুরাহা হয়নি। এরই মধ্যে আজ ৪ ফেব্রুয়ারি পালিত হচ্ছে বিশ্ব ক্যানসার দিবস। ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়। এ বছরের প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘ইউনিটি বাই ইউনিক’।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে এখন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বাড়ছে বাংলাদেশে। এত বিপুলসংখ্যক রোগীর চিকিৎসার চাপ সামলাতে পারছে না দেশের বিদ্যমান চিকিৎসা খাত। বৈশ্বিক ক্যানসার গবেষণা জার্নাল ল্যানসেট অনকোলজির ২০২৪ সালের ডিসেম্বর সংস্করণে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৫ লাখ। ২০৪০ সালের মধ্যে যা ২১ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা কম-বেশি ১০ লাখের কাছাকাছি। ২০৪০ সালের মধ্যে তা ১৪ লাখে উন্নীত হবে।
বাংলাদেশের ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অনকোলজিস্ট ক্লাবের এক গবেষণায় দেখা গেছে, রোগীর অনুপাতে ক্যানসারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত রেডিওথেরাপি সুবিধা বাংলাদেশেই সবচেয়ে কম। দেশের প্রায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ ক্যানসার রোগী রেডিওথেরাপি সুবিধা নিতে পারছেন। যেখানে প্রতিবেশী ভারতে এ হার ৪২ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় এ হার ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ। এ ছাড়া পাকিস্তান ও নেপালে এ হার যথাক্রমে ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ ও ২৬ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে ক্যানসারের চিকিৎসা সুবিধা অপর্যাপ্ত। আর এর এক-তৃতীয়াংশই ঢাকাকেন্দ্রিক। বাংলাদেশে রেডিওথেরাপিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আছে মোট ২৪টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। এর ১৫টি সরকারি ও নয়টি বেসরকারি হাসপাতালে। এ ছাড়া আরও আটটি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে রেডিওথেরাপি সুবিধা আনার কাজ চলমান রয়েছে। বাংলাদেশে রেডিয়েশন অনকোলজিস্টের সংখ্যা ২৫০। মেডিকেল অনকোলজিস্ট আছেন ২২ জন। পেডিয়াট্রিক অনকোলজিস্ট আছেন ৪৭ জন। আর মেডিকেল ফিজিসিস্ট আছেন ৭০ জন, রেডিওথেরাপি টেকিনোলজিস্টের সংখ্যা ১১৫ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে একটি ক্যানসার কেন্দ্র দরকার। সেই হিসাবে দেশে ক্যানসার কেন্দ্রের প্রয়োজন ১৭০টি। তবে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে আছে ৩০টিরও কম। এসব ক্যানসার হাসপাতালের অধিকাংশই আবার রাজধানীকেন্দ্রিক। হাসপাতালের পাশাপাশি রয়েছে যন্ত্রপাতি সংকটও। কেমোথেরাপি কেন্দ্রও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। এ ছাড়া এ বিপুলসংখ্যক রোগীর সেবায় মাত্র তিনশর আশপাশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। নেই ক্যানসার শনাক্তকরণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা।
পর্যাপ্ত সেবার অভাবে সচ্ছলদের অধিকাংশ বিদেশমুখী হলেও যে পথে যেতে পারেন না নিম্নআয়ের মানুষ। ভোগান্তি ও আর্থিক কারণে অনেকেই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসা নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। জটিল আকার ধারণ করলে অনেকে শেষ মুহূর্তে চিকিৎসা নেন।
ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে নষ্ট যন্ত্রপাতি
বাংলাদেশে ৩০০টি রেডিওথেরাপি মেশিনের প্রয়োজন হলেও রয়েছে মাত্র ৩৭টি। জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৬টি রেডিওথেরাপি মেশিনের মধ্যে দুটি ভালো ছিল। তা দিয়ে কোনোভাবে কাজ চলছিল। কিন্তু গত রবিবার বাকি দুটি মেশিনও নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানা যায়। এই মেশিনগুলো দিয়ে ২০০ রোগীকে সেবা দেওয়া হয়। রেডিওথেরাপি বন্ধ থাকায় রোগীদের ভীষণ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। সেবা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে মানুষ।
ক্যানসার ইনস্টিটিউটে ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির কোর্স সম্পূর্ণ করা হয়, যা প্রাইভেট হাসপাতালে শেষ করতে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ টাকা লাগে। সাধারণত সার্ভিক্যাল ক্যানসারে ২৫টি রেডিওথেরাপি, ব্রেস্ট ক্যানসারে ১৫ এবং মস্তিষ্কের ক্যানসারের জন্য প্রয়োজন হয় ২৫টি রেডিওথেরাপির।
তাই নিম্নআয়ের মানুষের এই হাসপাতাল ছাড়া সেবা নেওয়ার আর কোনো উপায় নেই। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের কাছ থেকে জানা যায়, মেশিনে প্রায়ই সমস্যা হয়। মেরামত করা হলেও তা ফের নষ্ট হয়ে যায়।
হাসপাতালে অপেক্ষা করছিলেন হুসেনা বেগম। ঢাকার বাইরে থেকে এখানে এসে দীর্ঘদিন ধরে রেডিওথেরাপি নিচ্ছেন তিনি। তবে এখন শোনেন মেশিন নষ্ট। ঢাকায় বাসা ভাড়া করে থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। তিনি বলেন, কবে আমার কোর্স শেষ হবে আর এই অপেক্ষার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব। টাকা-পয়সা নেই, এর মধ্যে হাসপাতালে নানা ঝামেলা লেগেই থাকে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, দুই-তিন বছর ধরে বিভিন্ন ধাপে হাসপাতালের ৪টি রেডিওথেরাপি মেশিন বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। যে দুটি দিয়ে কাজ হয় সেগুলোও নষ্ট। মেরামতের জন্য কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
অনকোলজি ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. এমএ হাই বলেন, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ক্যানসার চিকিৎসা চালানোর যন্ত্রপাতি অপ্রতুল। সরকারি হাসপাতালে লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিন আছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটে, সেগুলোও নষ্ট। দেশে নামমাত্র মলিকুলার স্টাডির জন্য গবেষণাগার রয়েছে হাতে গোনা। ফলে পরীক্ষার জন্য রোগীর দেহ থেকে সংগৃহীত সেল পাঠাতে হয় ভারতে।