বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০০:৪৮ এএম
আপডেট : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৭ এএম
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে সোমবার মহাখালীতে সড়কের পর রেলপথ অবরোধ করে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। প্রবা ফটো
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে টানা কয়েক দিন ধরে অনশন ও সড়ক অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা।
সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) তারা বিকাল থেকে কলেজসংলগ্ন মহাখালীতে সড়কের পাশাপাশি রেললাইনও অবরোধ করেন। এতে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন জেলায় রেলস্টেশনে আটকে পড়ে ট্রেন।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং রাজধানীর অভ্যন্তরীণ সড়কে যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এতে সীমাহীন ভোগান্তিতে পড়েন মানুষজন। কয়েক দিন ধরেই দফায় দফায় অবরোধের কারণে রাজধানীবাসী বিরক্ত-ক্ষিপ্ত হচ্ছিলেন। গতকাল যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। মহাখালীর ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। অবশেষে ‘নীরবতা’ ভেঙে রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্তৃপক্ষ।
গতকাল রাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের আশ্বাসের পর সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসেন শিক্ষার্থীরা। সাত দফা দাবির মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা ছাড়া বাকি ছয় দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। এর পরেই অনশন ভাঙার পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথ থেকে সরে আসেন শিক্ষার্থীরা।
সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ষষ্ঠ দিনের মতো আন্দোলনে নেমে শতাধিক শিক্ষার্থী তিতুমীর কলেজের গেট থেকে মিছিল নিয়ে মহাখালীতে গিয়ে প্রথমে সড়কপথ অবরোধ করেন। এর কিছুক্ষণ পর সড়কের পাশাপাশি মহাখালী রেলক্রসিংয়ে অবস্থান নিয়ে রেলপথ বন্ধ করে অবরোধ করেন তারা।
দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দেন শিক্ষার্থীরা। তবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের এই দাবির বিষয়ে এই কয় দিনেও আলাপ-আলোচনা করা বা ইতিবাচক কোনো সাড়া দিতে দেখা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ‘নীরবতায়’ নজিরবিহীন ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। সড়ক ও রেলপথ অবরোধের কারণে এই দিন চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। অনেকেই প্রকাশ্যে ক্ষোভ ঝেড়েছেন সরকার ও আন্দোলনকারীদের ওপর। অবশ্য যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের পাশাপাশি চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
টানা ৬ দিনের আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সরাসরি যোগাযোগ করা না হলেও সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনরতদের ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে গতকাল সরকারের দুজন উপদেষ্টা গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তারা বলেন, এই মুহূর্তে হয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। এজন্য জনভোগান্তি যেন না হয়, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। আশা করি ভালো কিছু হবে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন সরকারের এক উপদেষ্টা।
সরেজমিন দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে টানা ষষ্ঠ দিনের মতো রাজপথে আন্দোলন করছেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তারা মহাখালী থেকে গুলশানগামী সড়ক বন্ধ করে দেন। এতে সড়কের উভয় পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেওয়া মানুষেরা ভোগান্তিতে পড়েন।
অন্যদিকে জাহাঙ্গীর গেট থেকে মহাখালী যাওয়ার রাস্তা বন্ধ থাকায় এই পথে চলাচল করা হাজারো মানুষ হেঁটে চলাচল করছেন এই পথে। কেউ শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে, কেউ মালামাল হাতে নিয়ে হাঁটছেন। সাইকেল, মোটরসাইকেল ঠেলে নিয়ে রেললাইন পার হচ্ছেন। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সি মানুষ ভোগান্তিতে ক্লিষ্ট। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা এসেছিলেন মনোয়ারা বেগম। তিনি প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, বাসে এসে মহাখালীতে নেমেই দেখি রাস্তা বন্ধ। তাই ব্যাগ কাঁধে নিয়েই হাঁটতে হচ্ছে। বাস কোথা থেকে পাব, আর কীভাবে যাব তা জানি না।
অন্যদিকে প্রায় একই সময়ে যশোর থেকে ঢাকায় বোনকে ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসা জাহাঙ্গীর আলমও ক্ষোভ ঝেড়েছেন। বোন আকলিমা আক্তারের কেমোথেরাপি শেষ তাকে নিয়েই বাড়ি ফেরার কথা। কিন্তু দুপুরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে দেখেন সড়কে কোনো যানবাহন চলছে না। জাহাঙ্গীর বলেন, শিক্ষার্থীরা রাস্তা আটকে রেখেছে। কোনো যানবাহন না পেয়ে হেঁটেই রওনা হয়েছি। বোনের অনেক কষ্ট হচ্ছে কিন্তু উপায় নেই।
শুধু সড়কপথের যাত্রীরাই নয়, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের কারণে এই দিন রেলপথের যাত্রীরাও পড়েছিল চরম ভোগান্তিতে। বিকাল সাড়ে ৩টার পর থেকেই টঙ্গী জংশন হয়ে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কমলাপুরসহ বিভিন্ন স্টেশনে বেশ কয়েকটি ট্রেন আটকে যাওয়ায় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। কমলাপুরের স্টেশন মাস্টার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, মহাখালীতে রেললাইন অবরোধের পর বিকাল পৌনে ৬টা পর্যন্ত ছয়টি ট্রেন আটকে গেছে। একইভাবে ঢাকায় প্রবেশ করবে এসব ট্রেনও বিভিন্ন স্টেশনে আটকে আছে। ফলে সারা দেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে আছে এবং বিভিন্ন স্টেশনে স্টেশনে ট্রেন আটকে আছে। সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫টি ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে। তেজগাঁও, ক্যান্টনমেন্ট ও বিমানবন্দর স্টেশনসহ বিভিন্ন স্টেশনে আটকা পড়েছেন হাজারো যাত্রী।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে; আমারও নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। তারা লোকজনকে অতিষ্ঠ করে ফেলছে। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের রেললাইন থেকে জনগণই তুলে দেবে।
এর আগে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ বলেন, সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এই মুহূর্তে হয়তো অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। এজন্য জনভোগান্তি যেন না হয়, সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। আশা করি ভালো কিছু হবে।
সিনিয়র শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়ের বলেন, ‘আলাদাভাবে তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে হবে। দেশে এমন আরও কলেজ আছে। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা যে দাবি জানাচ্ছি তা যৌক্তিক দাবি নয়। এখন পর্যন্ত তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবির যৌক্তিকতা নেই।’
এই প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক সেলিম জাহান জানান, কোনো দাবি তুললে বিবেচনায় রাখা দরকার যে, সে দাবি মেটানোর মতো সংগতি বা সম্পদ রাষ্ট্র, সরকার বা প্রতিষ্ঠানের আছে কি না এবং এটিও দেখতে হবে দাবি যেন জনগণের কষ্টের, দুর্গতির বা ভোগান্তির কারণ না হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ক্ষোভ ঝেড়েছেন অনেকেই : ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার ফেসবুকে পোস্ট করে লেখেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি ৭ কলেজ/তিতুমীর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে সরকার পড়েছে উভয় সংকটে। যেখানে একীভূতকরণের মাধ্যমে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কমানোর সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। অন্যদিকে জনভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মেরিনা নাসরিন নামে একজন ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেছেন, তিতুমীর কলেজ কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ভার্সিটি হওয়ার যোগ্য? মিনিমাম লজ্জা থাকলে এই দাবি করতে পারে? গুটিকয়েক ছাত্র মিলে যাতায়াতের চৌদ্দটা বাজাচ্ছে। প্রশাসন এখনও শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না কেন? রেললাইন থেকে দরকার হইলে চ্যাংদোলা করে এদেরকে সরান।
যা বলছে প্রশাসন
ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপকমিশনার ডিসি মোহাম্মদ তারেক মাহমুদ বলেন, জনদুর্ভোগ না হয় এমন কর্মসূচি দিতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেছিলাম। আজ তারা কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় মহাখালী রেলগেটে এসে বসে পড়েছেন। আমরা তাদের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। অন্যদিকে কোনো প্রকার সহিংসতা কিংবা বিশৃঙ্খলা এড়াতে মহাখালী রেলগেট এলাকায় বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) চার প্লাটুন সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। রেলগেটের বিপরীত পাশে অবস্থান নিয়েছেন বিজিবি সদস্যরা। এ ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শিক্ষার্থীদের চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছেন পুলিশ সদস্যরা। প্রস্তুত রাখা হয়েছে জলকামান।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতে চায় মন্ত্রণালয়
এদিকে ষষ্ঠ দিনের মাথায় এসে তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলনে নামা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এজন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গতকাল সন্ধ্যায় তিতুমীর ক্যাম্পাসে অবস্থান করছিলেন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (কলেজ শাখা) যুগ্ম সচিব নুরুজ্জামান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো মেনে নেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় খুবই আন্তরিক। তাদের যেসব দাবি রয়েছে সেগুলো নিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বসে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে, কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু সমাধান করা যায়।’ তবে বাকি ছয় কলেজসহ দেশের বড় কলেজগুলো যেন আন্দোলনে নেমে না যায়, সেজন্য এই মুহূর্তে তিতুমীর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণার দাবির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো কিছু বলেননি এই কর্মকর্তা। নির্বাচিত সরকার আসা পর্যন্ত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা। শিক্ষক প্রতিনিধি, ছাত্র প্রতিনিধি ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই কমিটি নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বলে জানানো হয়।
মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে অনশন ভাঙলেন শিক্ষার্থীরা, নতুন করে সাত দিনের আল্টিমেটাম
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি অনশন চালিয়ে যাওয়া তিতুমীর শিক্ষার্থীরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের পর অনশন ভাঙেন। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসের পর দাবি আদায়ের জন্য সাত দিনের আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন স্থগিত করে সড়ক ও রেলপথ থেকে সরে আসেন শিক্ষার্থীরা।