ঘোষণায় সীমাবদ্ধ দুই উদ্যোগ
ফয়সাল আহম্মেদ
প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০১:০৫ এএম
আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১০:৩৮ এএম
পলিথিনমুক্ত হয়নি বাজার। নেপথ্যে নানা কারণ। প্রবা ফটো
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বাজারে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা নিয়ে সোচ্চার। গত বছরের অক্টোবর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে সুপারশপগুলোতে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। পরের মাস নভেম্বর থেকে বাজারে সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় পলিথিন নিষিদ্ধ
করার বিষয়টি নিয়ে জোর প্রচারেও নামে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা
হাসান বিভিন্ন অনুষ্ঠান-কর্মসূচিতে বিষয়টিতে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব তুলে ধরেন।
নির্দেশনা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। পাশাপাশি কাঁচাবাজার থেকে শুরু
করে পলিথিন কারখানায় চালানো হচ্ছে অভিযান।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ছয় মাসের মাথায় এসে প্রশ্ন উঠেছে এই উদ্যোগের
সফলতা নিয়ে। কেননা পরিবেশদূষণের অন্যতম অনুষঙ্গ পলিথিনে এখনও সয়লাব চারদিক। অবস্থার
কোনোই পরিবর্তন নেই। থেমে নেই এর অবাধ ব্যবহার। সুপারশপে পলিথিনের ব্যবহার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ
করা গেলেও কাঁচাবাজারসহ মাঠপর্যায়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। নির্দেশনা জারির
দুই মাস পার হলেও এর সুফল মেলেনি।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে করণীয় কী? কেন, কিসের জন্য আইন প্রয়োগ
করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না পরিবেশের হুমকি পলিথিনের ব্যবহার।
দেশে পলিথিনের বিস্তার যেভাবে
একটা সময় ছিল যখন বাজার করার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরোনো প্রতিটি মানুষের
হাতেই থাকত পাটের তৈরি ব্যাগ। সদাইপাতি বহনের এর বিকল্পও ছিল না। আর বর্তমান অবস্থা
তার ঠিক উল্টো। বাজারের উদ্দেশ্যে বেরোনো কারও হাতেই ব্যাগের দেখা পাওয়া যায় না। কেউ
তার প্রয়োজনও মনে করে না। কেননা সামান্যতম জিনিস কিনলেও তা বহনের জন্য আছে পলিথিনের
ব্যাগ। দোকানিকে তার জন্য বাড়তি কোনো টাকাও দিতে হয় না।
উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার শুরু হয় বেশ
দেরিতে, আশির দশকে। সে সময় থেকেই দোকানি পণ্য বহনের জন্য ক্রেতাকে কোনো অর্থ ছাড়াই
পরিবেশবিধ্বংসী পলিথিনের ব্যাগ দেওয়া শুরু করে। তবে অল্পদিনের মধ্যেই ব্যবহারের ব্যাপকতা
উন্নত বিশ্বকেও ছাড়িয়ে যায়।
কোনো ধরনের বাধাবিপত্তি ছাড়াই চলছে এর ব্যবহার। আর তাতে করে হুমকির
মুখে পড়েছে পরিবেশ। যত্রতত্র পলিথিন ফেলায় ভরাট হচ্ছে নদী, খাল ও পয়োনিষ্কাশনের নালা।
পলিথিনের ব্যবহার দেশের পরিবেশের জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে যে,
তা নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন সরকার দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, পরিবহন,
মজুদ ও ব্যবহার নিষিদ্ধের আইন প্রণয়ন করে। আর এর মধ্য দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম
দেশ, যেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পলিথিনের ব্যবহার।
আইনের ২৫ ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন
করলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
সেসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। সচেতন
মহলসহ পরিবেশবিদরা এটি ব্যবহার বন্ধে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এলেও থেমে থাকেনি
নিষিদ্ধ পলিথিনের ব্যবহার।
রাজধানীর কাঁচাবাজারের চিত্র
চলতি সপ্তাহে রাজধানীর উত্তরা, বনানী, গুলশান, ভাটারা ও মহাখালী এলাকার
কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা যায়, দোকানিরা আগের মতো ক্রেতাকে পণ্য দিচ্ছেন পলিথিন ব্যাগে।
একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল যে, সরকারের পক্ষ থেকে জারি করা নির্দেশনা সম্পর্কে
তারা জানেন। আইন করে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও তাদের অজানা নয়। কিন্তু সব
জানার পরও আইন বা সরকারের নির্দেশনা মানার ক্ষেত্রে তাদের কোনো আগ্রহ নেই। ক্রেতারাও
সব জেনেশুনেই খালি হাতে বাজারে চলে এসেছেন।
বিক্রেতাদের উল্টো প্র্রশ্নÑ ‘পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে পলিথিনের পরিবর্তে
আমরা কী ব্যবহার করব? ক্রেতা তো বাজারে ব্যাগ নিয়ে আসে না। আমাদেরও পণ্য বিক্রি করতে
হবে। এ অবস্থায় আমরা আইন মানি না, আমরা পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন না, আমরা দায়িত্ব পালনের
ক্ষেত্রে উদাসীনÑ এসব কথা আমাদের বলে লাভ কী? পলিথিনের মতো সহজলভ্য ও সস্তায় আমাদের
বিকল্প দেখাক। আমরা আর দোকানে পলিথিন রাখব না।’
কোনো কোনো দোকানি অবশ্য জানান, তাদের মজুদে থাকা পলিথিনগুলো শেষ হলে
বিকল্প হিসেবে অন্য কিছু ব্যবহার করবেন।
ব্যাগ হাতে বাজারে না আসা সম্পর্কে জানতে চাইলে ক্রেতাদের গড়পড়তা
একই উত্তরÑ আমাদের সমস্যা তো হচ্ছে না। বরাবরের মতো খালি হাতে এসে পণ্য কিনলেই দোকানি
পলিথিন ব্যাগে তা ভরে দিচ্ছেন। সেজন্য আমাদের তো বাড়তি পয়সাও দিতে হচ্ছে না। আর হ্যাঁ,
পরিবেশ সচেতনতার একটি বিষয় আছে। সেক্ষেত্রে বলবÑ প্রথমত, ক্রেতা হিসেবে আমি একা মানলেও
অন্যরা তো সে পথে হাঁটেন না। দ্বিতীয়ত, এসব পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে কীভাবে? সরকার
কেন সেই গোড়ায় হাত দিচ্ছে না। উৎপাদন না হলে তো আপনা থেকেই এর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।
রাজধানীর উত্তরা ১১ নং সেক্টরের কাঁচাবাজারে সবজি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর
একজন ক্রেতাকে সবুজ রঙের পলিথিন ব্যাগে সবজি দিচ্ছিলেন। নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও কেন পলিথিন
ব্যবহার করছেনÑ এমন প্রশ্নে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় প্লাস্টিক
ব্যাগ ব্যবহার করছি। মজুদে থাকা ব্যাগগুলো শেষ হলে আর ক্রেতাকে পলিথিন দেব না।’
উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের আরেক ব্যবসায়ী কুমিল্লা জেনারেল স্টোরের
স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বলেন, ‘পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে বাজারে কোনো
ব্যাগের উপস্থিতি নিশ্চিত করে পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে হবে বাজারে যেন পলিথিন
না থাকে। কিন্তু এর আগেই যদি পলিথিন বন্ধ করা হয় তাহলে আমাদের মতো খুচরা ব্যবসায়ীদের
বিপাকে পড়তে হবে। পলিথিনের বিকল্প হিসেবে কাপড়ের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করা যায় কি না-
এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কাপড়ের ব্যাগ টাকা দিয়ে কিনতে হয়। ক্রেতারা আবার সেটা নিতে
চায় না।’
রাজধানীর ভাটারা এলাকায় কাঁচাবাজার করে ফিরছিলেন বেসরকারি চাকুরে
আকমল হোসেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ
মানুষ চাইবে পলিথিন ব্যবহার করতে। কারণ এটি কষ্ট করে বাসা থেকে নিয়ে আসতে হয় না। পণ্য
কিনলেই দোকানিরা ফ্রি দেন। সরকারকে বিকল্প এমন কিছু বের করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ
পণ্য কিনলে পলিথিনের মতো ফ্রি পেতে পারে।’
রাজধানীর মহাখালী কাঁচাবাজারে মাছ কিনতে আসা মধ্যবয়সি আল-আমীন বলেন,
‘পলিথিন ব্যবহারের বিকল্প এখনও বাজারে নেই। আমি মাছ কিনেছি। আমার কাছে কাপড়ের তৈরি
একটা ব্যাগ আছে। কিন্তু সরাসরি মাছ সেই ব্যাগে নিলে ব্যাগটি নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আগে
পলিথিনে ভরে তারপর আরেকটা ব্যাগে নিতে হয়েছে।’
ব্যতিক্রমী চিত্র সুপারশপে
কাঁচাবাজারে বরাবরের মতোই পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার হলেও সুপারশপগুলোর
চিত্র ব্যতিক্রম। প্রায় প্রতিটি শপেই কোনো পণ্য আর পলিথিনের ব্যাগে সরবরাহ করা হচ্ছে
না।
রাজধানীর সুপারশপগুলোতে এখন পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহারের
প্রবণতা বেড়েছে। ডেইলি শপিং সুপারশপ ভাটারা ব্রাঞ্চের ম্যানেজার মুশতাক জানান, তারা
ক্রেতাকে পণ্যের সঙ্গে পলিথিনের পরিবর্তে নেট বা কাপড়ের ব্যাগ দিচ্ছেন। নেট ব্যাগ
ফ্রি দেওয়া হলেও কাপড়ের ব্যাগের জন্য ক্রেতাকে প্রতি পিসে ১০ টাকা দিতে হচ্ছে। আর সুপারশপগুলোতে
যারা বাজার করতে আসে, তারাও বিষয়টি সহজভাবেই নিচ্ছে।
যা বলছেন পরিবেশবিদরা
পরিবেশবিধ্বংসী পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া উদ্যোগে
বেশকিছু দুর্বলতা দেখছেন পরিবেশবিদরা। তারা বলছেন, বাজারে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজন
কার্যকর পদক্ষেপ। এছাড়া জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পলিথিনের বিকল্প ব্যাগ তৈরির
ওপর জোর দিতে হবে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে।
নগরবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান এ ব্যাপারে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন,
‘বাজারে পলিথিন ব্যাগ বন্ধ করতে হলে সবার আগে পলিথিন কারখানাগুলো বন্ধ করতে হবে। পলিথিন
ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে সহায়তাকারীদের সবার আগে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
পলিথিন কারখানায় অভিযান চালানোর জন্য বর্তমান সরকারকে সাধুবাদ জানিয়ে
তিনি বলেন, ‘যেকোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখতে
হবে। খুচরা দোকানে অভিযান চালিয়ে কোনো লাভ হবে না, যতক্ষণ না এর উৎপাদন বন্ধ হবে। পলিথিন
ব্যাগের ব্যবহার বন্ধ করার ব্যাপারে সরকার যেন কারও দ্বারা প্রভাবিত না হয়Ñ সেটি গুরুত্বপূর্ণ।’
তিনি বলেন, ‘জলাবদ্ধতা থেকে শুরু করে পরিবেশের নানা হুমকির জন্য দায়ী
পলিথিন। মানুষকে পলিথিনের বিকল্পের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে হবে। বিকল্প না থাকলেও পলিথিনকে
বাজারে অ্যালাও করার কোনো সুযোগ নেই। দরকার সদিচ্ছা। পলিথিনের ব্যাপারে সরকারের উচিত
হবে জিরো টলারেন্স নীতি বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে পলিথিনের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণার
মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে।’
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন,
‘পিলিথিনের বিকল্প ব্যবস্থাটা জরুরি। সর্বোপরি সচেতনতা ও আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ ছাড়া
পলিথিনের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’
পানিসম্পদ, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত
বলেন, ‘পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীব্যাপী আন্দোলন চলছে। একটি
বৈশ্বিক আইনি প্রক্রিয়া চলছে সিঙ্গেল ইউজ পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করার। আমাদের দেশে কাঁচাবাজারে
যে পলিথিনগুলো ব্যবহার হয়, সেগুলো বেশি ওজনের পণ্য নিলে ছিঁড়ে যায়। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকাতে
যে ব্যাগগুলো কিনতে হয়, সেগুলোতে বেশি ওজন নেওয়া যায় এবং বারবার ব্যবহার করা যায়। সেখানকার
লোকজন এগুলো ভাঁজ করে বাজারে নিয়ে যায় এবং বারবার ব্যবহার করে।’
তিনি বলেন, ‘বাঙালি কোনো নির্দেশ দিলে মানে না; যতক্ষণ না জোর করে
মানানো হয়। পলিথিন যারা উৎপাদন করছে, সরকারের উচিত তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।
কিন্তু তা বন্ধ করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের লক্ষণ নেই।
অধ্যাপক আইনুন নিশাত আরও বলেন, ‘পলিথিন বন্ধের ব্যাপারে বহুদিন ধরে
বলা হচ্ছে। পলিথিন যারা উৎপাদন করে, তাদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য ব্যবসায় যেতে হবে।
পলিথিন ব্যবহারে জাতির ক্ষতি হচ্ছে, পৃথিবীর ক্ষতি হচ্ছে। সেজন্য পৃথিবী যে নিয়ম করেছে,
আমরা সেটাতেই অগ্রগামী। মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন করতে হবে। তাহলে এর সুফল পাওয়া যাবে।’
পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে প্রচলিত আইনে শাস্তির ব্যবস্থা করার পরামর্শ এই পরিবেশ বিশেষজ্ঞের।