ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:৪৯ এএম
ছবি : সংগৃহীত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির ভেতরের মাঠে চলছিল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন ছবির প্রদর্শনী। চলতি মাসের মধ্যভাগে অনুষ্ঠিত প্রদর্শনী ঘুরে দেখছিলেন প্রিয়া হিজড়া। ছবিগুলোর দিকে আঙুল তুলে প্রিয়া বললেন, এখানে আমাদের কোনো ছবি নেই। কত ছবি আছে। শুধু আমরা নেই।
প্রিয়া হিজড়া জানালেন, ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্টÑ গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রতিদিন রাত ১১টা পর্যন্ত হাসপাতালেই সময় কাটত তার।
শুধু তিনি নন, সহযোদ্ধা ছিলেন আরও পাঁচজন। গুরুমা মুক্তা হিজড়া, হাবিবা, নদী, বৈশাখী ও মুগ্ধ। টিভির খবরে ছাত্রদের আন্দোলন দেখে কুয়াকাটায় অনুষ্ঠান ছেড়ে ১৫ জুলাই ঢাকায় আসেন তারা।
বাধা পেরিয়ে আহতদের পাশে
প্রিয়া হিজড়া বলেন, ১৬ জুলাই হাসপাতালে আমরা ৬ জন যাই। সেখানে আমাদের প্রশ্ন করা হয় ‘কে পাঠিয়েছে তোমাদের’, কেন আসছো? পরিচালকের রুমে গিয়ে আমরা চেঁচামেচি করি। এখনও তার রুমের একটা জানালার কাচ ভাঙাÑ সেটা আমরা ভেঙেছি। ১৮ জুলাই প্রচুর লাশ আসতে শুরু করে। একমাত্র ঢাকা মেডিকেলেই তিনটা মর্গ আছে। মর্গগুলোয় ১৮ জুলাই আসা লাশের ওপর রাখা হয় ১৯ ও ২০ জুলাই আসা লাশগুলো। আহতদের চিকিৎসা দিয়ে শেষ করতে পারে না ডাক্তাররা। সেসব ভিডিও আমার কাছে আছে। এক পুলিশ আমার ফোন চেক করে সেই ফোনটা ভেঙে দেয়। একটা সময় হাসপাতালের ব্ল্যাড ব্যাংকের রক্ত ফুরিয়ে আসে। একেকজনের কয়েক ব্যাগ ব্লাড প্রয়োজন। সে সময় আমরা হিজড়ারা ৩৬ ব্যাগ ব্লাড দিয়েছিলাম। এ ছাড়া ৭৩০ ব্যাগ ব্লাড জোগাড় করি।
রোজগার ছিল না দুই মাস
আন্দোলনের আরেক সহযোদ্ধা নদী হিজড়া জানান সে সময়ের আর্থিক টানাপড়েনের কথা। তিনি বলেন, দুই মাস টাকা তুলতে পারিনি। তার আগেও কিছু রীতির কারণে টাকা তোলা বন্ধ ছিল। হাতে জমানো যা ছিল, তা দিয়েই আহতদের সেবা দিই আমরা। এমনও হয়েছেÑ না খেয়েও রাত পার করেছি।
হিজড়াদের ওই দলটির পক্ষ থেকে ৩ লাখ টাকাও নগদ উত্তোলন করা হয়। ওই টাকা দিয়ে ওষুধ কেনা, অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মরদেহ পরিবারের কাছে পাঠানোর খরচও দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, রক্তের জন্য সিলিকন ব্যাগ সরবরাহও করেছিলেন তারা। এ ছাড়া করেছেন রক্তদাতাদের জন্য পানি ও জুসের ব্যবস্থা।
গণঅভ্যুত্থানের পরও পাইনি অধিকার
প্রিয়া হিজড়া বলেনহিজড়াদের সংখ্যা ৪ লাখ ৬৬ হাজার ৩২২। আমাদের গণনা অনুযায়ীই শুধু নয়, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের কাছে তালিকা আছে। তিনি আমাদের এই গণনায় সহযোগিতা করেছিলেন। যেখানে ঢাকায় আছে ২৫ হাজার হিজড়া। তাহলে ১২ হাজারের বাইরে এত হিজড়া জনগোষ্ঠী কি এই দেশের নাগরিক না? আমার নামই আদমশুমারিতে নেই। আমি কি নাগরিক না? সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের ৬০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়, এ টাকায় কী হয় বলেন। আমি বলেছি, একটা পেটিকোট বানাতেই লাগে ৫০০ টাকা। তাহলে এই অল্প টাকায় কী করা যায়?
সংস্কার ভাবনায় হিজড়াদের অধিকার
সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবমান উন্নয়নে উপবৃত্তি, ভাতা, প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ-উত্তর সেবা প্রদান করা হয়। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায়, ৬ বছর ধরে তাদের প্রশিক্ষণ-উত্তর ভাতা ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়নি।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ভিক্ষুক, চা শ্রমিক ও হিজড়া) শাহ জাহান বলেন, সরকারি বরাদ্দ নেই। ৬ বছর ধরে বরাদ্দ না থাকায় প্রশিক্ষণোত্তর ভাতা দেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু ৬০০ টাকা ভাতা দিচ্ছি। ট্রেনিং দিচ্ছি। সামনের বাজেটে সরকার বরাদ্দ দিলে আমরা ভাতা দেব।
রাষ্ট্র সংস্কারে নারী বিষয়ক কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। কমিশনের প্রধান নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা ও মানবাধিকারকর্মী শিরীন পারভীন হক। হিজড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে সরকারের ভাবনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এত কমিশন করে সরকার তো কাজ করতে পারবে না। শিশুদের নিয়ে, বৃদ্ধদের নিয়ে কমিশন নেই। তাদের কী কী প্রয়োজন, সেই প্রস্তাব সরকারকে দিতে হবে। শিশুরা যেমন নিজেদের কথা বলতে পারবে না, তাদের নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলবে। হিজড়া কমিউনিটি থেকে তাদের নিয়ে কী কী চাওয়াÑ সেসব নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। তাদের দাবিনামা উপস্থাপন করবে।
মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, জেন্ডার ইস্যুতে এই সরকার খুব একটা মনোযোগ দিচ্ছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন জেন্ডারের সমঅধিকারÑ সেটাও হচ্ছে না। নারী বিষয়ক কমিশন আছে যদিওÑ হয়তো সেখান থেকে কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হবে নারীদের জন্য। কিন্তু সামগ্রিকভাবে জেন্ডার পার্সপ্রেক্টিভ থেকে দেখা হচ্ছে না।