× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

সহজে আসেনি বিজয়, কিশোরগঞ্জ জেলার সশস্ত্র যুদ্ধের খণ্ডচিত্র

মধ্যাঞ্চলীয় ব্যুরো

প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৮:১২ এএম

আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:৫৯ পিএম

কিশোরগঞ্জের বরইতলা স্মৃতিসৌধ। প্রবা ফটো

কিশোরগঞ্জের বরইতলা স্মৃতিসৌধ। প্রবা ফটো

মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে যেন শত সহস্র শব্দসৈনিক ছুটে আসে। তৈরি করে অশ্রু, ঘাম, রক্ত আর সংগ্রামী চেতনায় মাখা মুক্তির মিছিল। যার কোনো শেষ নেই। কত ত্যাগ, রক্ত, স্বজন হারানো বেদনার পাশাপাশি সশস্ত্র যুদ্ধের এক বিশাল ভান্ডার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। তবে এ স্বাধীনতা ও বিজয়ের আনন্দ সহজে আমাদের জীবনে আসেনি।

একটি জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, রণাঙ্গনে তাদের ভূমিকা ও সশস্ত্র যুদ্ধের ঘটনা বর্ণনা করলে কত কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে বাঙালির জীবনে স্বাধীনতা ফিরেছে তার কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে। কিশোরগঞ্জ জেলার বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সশস্ত্র যুদ্ধের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের কৃষক, শ্রমিক তথা মুক্তিপাগল আপামর জনসাধারণ কীভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

১৯৭১-এর মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিফৌজের একটি দল কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের কালিকাপ্রসাদ স্টেশনের অদূরে একটি রেলসেতু ধ্বংস করে দেয়। এতে ভৈরব-কিশোরগঞ্জ রেল যোগাযোগ বিঘ্নিত হয়।

জুলাইয়ে গচিহাটা রেলস্টেশনের কাছে মাইন পেতে গেরিলারা একটি সৈন্যবাহী ট্রেন বিধ্বস্ত করে। এতে দুই চালক, ১০ পাঞ্জাবি পুলিশ ও ২০ পাক সেনা নিহত হয়।

২ আগস্ট। গেরিলা যোদ্ধারা সরারচর রেলস্টেশনে হামলা চালিয়ে সিগন্যাল বোর্ড ও টেলিগ্রাফ যন্ত্র ধ্বংস করে দেয়। পরে পাক বাহিনী স্থানীয় জনগণের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে।

৭ থেকে ১৬ আগস্ট । কটিয়াদী অ্যাম্বুশ। এটি কিশোরগঞ্জ জেলায় সর্ববৃহৎ যুদ্ধ। নরসিংদী জেলার বেলাবোয় জয়লাভ করার পর হানাদার বাহিনী বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ৭ আগস্ট থেকে মুক্তিবাহিনী তাদের চলাচল কড়া পর্যবেক্ষণে রাখে। ১৬ আগস্ট পাক বাহিনী মোটর ল-যোগে কটিয়াদী যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী আগে থেকেই অ্যাম্বুশ পেতে বসে ছিল। গুলির আওতায় আসামাত্র চারদিক থেকে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে দেন তারা। সাঁড়াশি যোদ্ধা হাবিলদার আকমল আলীর নেতৃত্বে এ যুদ্ধে কয়েকটি ল ডুবে যায়। দু-তিনটি পালিয়ে যায়। আক্রমণে ১৩৪ পাক সেনা নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে বিশেষ সাহসের পরিচয় দেন।

১৪ আগস্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বাজিতপুর থানা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত হয়।

৪ অক্টোবর। গেরিলা যোদ্ধারা কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ সড়কের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

২১ অক্টোবর । মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের হটিয়ে দিয়ে বাজিতপুর থানা দখল করে ফেলে। এ সময় সংঘর্ষ শেষে অস্ত্রসহ ১৭ রাজাকার বন্দি হয়। কিছু গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জের আটটি থানা পাক হানাদারমুক্ত হয়।

নভেম্বর-ডিসেম্বরেই মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে চারদিক থেকে ব্যাপক গেরিলা আক্রমণ শুরু করে হানাদার ও রাজাকারদের কোণঠাসা করে ফেলে। ৪ অক্টোবর গেরিলা যোদ্ধারা কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রোডের টেলিযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। ২১ অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের হটিয়ে বাজিতপুর থানা দখল করে নেন। এ যুদ্ধে ১৭ জন রাজাকার বন্দি হয়।

১ নভেম্বর পাক বাহিনী গচিহাটায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। পাল্টা আঘাতে ১৫ পাক সেনা নিহত হয়। ৫ নভেম্বর ১০টি থানা পাক সেনা মুক্ত হয়। কিশোরগঞ্জ সদরে পাক বাহিনী প্রায় অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। গেরিলা যোদ্ধাদের দুঃসাহসিক আক্রমণে পাকুন্দিয়া ও হোসেনপুরে ২৪ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গেরিলারা কিশোরগঞ্জ-গৌরীপুর ও কিশোরগঞ্জ-ভৈরবের মধ্যবর্তী রেলসেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেন এবং রেলপথ উপড়ে ফেলে রেল যোগাযোগ অচল করে দেন। ময়মনসিংহ রোডের সেতুগুলোও মুক্তিফৌজ মাইন দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়।

১০ নভেম্বর লাখী বাজারে অ্যাম্বুশ পেতে গেরিলারা ৭ খানসেনা খতম ও ১৭ জনকে আহত অবস্থায় বন্দি করেন। ১১ নভেম্বর হোসেনপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে ২৪ জন অনিয়মিত পাক সেনা ও ১৫ জন পাঞ্জাবি পুলিশ নিহত হয়। ৭৯টি রাইফেলসহ প্রচুর গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়। ১৪ নভেম্বর মুক্তিফৌজের অ্যাম্বুশে পড়ে কিশোরগঞ্জে ৬ পাক সেনা নিহত হয়। ১৮ নভেম্বর শহরতলি শোলাকিয়ায় রাজাকার ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রসহ ৫ রাজাকারকে বন্দি করেন। ওইদিন হোসেনপুরেও ১৪ রাজাকার বন্দি হয়।

২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী গচিহাটা-যশোদল এলাকার প্রায় দুই মাইল রেললাইন উপড়ে ফেলে এবং রেলপথ কেটে মাঠের সমান করে দেয়। পাক বাহিনী ফের লাইন চালুর চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনী তা ব্যর্থ করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জ শহরে থেকে আগত পাক সেনাদের ওপর প্রবল গোলাবর্ষণ করলে এবারও পাক বাহিনী পালিয়ে যায়।

২২ থেকে ২৫ নভেম্বর চারদিকে একযোগে তুমুল যুদ্ধ শুরু করে দামাল মুক্তিসেনারা এবং জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়। ২৫ ও ২৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা শহরের ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। শহরের উপকণ্ঠ প্যারাভাঙ্গায় পাক সেনাদের সঙ্গে এক সম্মুখযুদ্ধে খায়রুল জাহান বীরপ্রতীক শহীদ হন।

ওইদিনই মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জকে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি ও গেরিলা আক্রমণে বিপর্যস্ত, ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পাক হানাদার বাহিনী ৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ থেকে চলে যায়। কিন্তু তাদের তাঁবেদার দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস, মুজাহিদ বাহিনী কিশোরগঞ্জ সদরকে আরও ১২ দিন পাকিস্তান বানিয়ে রাখে।

কিশোরগঞ্জে রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। চল্লিশের দশক থেকেই এখানে সাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির প্রাধান্য ছিল। মোনায়েম খান, নূরুল আমিন থেকে শুরু করে ’৭১-এ এদের দোসর দালালরা বক্তৃতা-বিবৃতিতে ও স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে অত্যন্ত তৎপর ছিল। জামে এমদাদিয়া, হয়বতনগর নুরানি মাদরাসা ছিল রাজাকার ও আলবদরদের শক্ত ঘাঁটি।

অবশেষে সব উৎকণ্ঠা ও প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১৭ ডিসেম্বর দুপুর থেকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিতে দিতে মুক্তিবাহিনী শহরে প্রবেশ করে। ক্যাপ্টেন চৌহানের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীও সেদিন কিশোরগঞ্জে আসে। মুক্তিযোদ্ধা, মিত্রবাহিনী আর জনতার উচ্ছ্বাস-উল্লাসের প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে কিশোরগঞ্জের মুক্ত আকাশে। পাক হানাদার ক্যাম্প জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ‘মুক্ত’ কিশোরগঞ্জে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ায় কিশোরগঞ্জের মুক্তিসেনা ও জনতা। 

কিশোরগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনমেজর এটিএম হায়দার বীর-উত্তম, সিরাজুল ইসলাম বীরবিক্রম, শহীদ খায়রুল জাহান বীরপ্রতীক, শহীদ চিশতী, শহীদ সেলিম, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহফুজ, নুরুল ইসলাম বীরপ্রতীক, মতিউর রহমান বীরবিক্রমসহ অনেকেই।

’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। কিন্তু এ বিজয়ের দিনও কিশোরগঞ্জের মুক্তিপাগল জনগণ বিজয়ের আনন্দ থেকে বিরত ছিল। অজানা আশঙ্কায় ছিল তারা। দেশের মানুষ বিজয়ের আনন্দ উদযাপনের এক দিন পর ১৭ ডিসেম্বর বিজয় আসে কিশোরগঞ্জে। বিজয় দিবসেও এখানে পাক বাহিনীর দোসরদের সঙ্গে দামাল মুক্তিসেনাদের প্রচণ্ড লড়াই হয়, ঝরে রক্ত। ১৭ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ মুক্তদিবসে মুক্তিযোদ্ধারা ১০ জন কুখ্যাত রাজাকারকে খতম করেছিলেন।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: protidinerbangladesh.pb@gmail.com

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: pbad2022@gmail.com

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: pbonlinead@gmail.com

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: pbcirculation@gmail.com

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা