সরেজমিন নীলক্ষেত
আসাদুজ্জামান তপন
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ ১০:১১ এএম
গ্রফিক্স : প্রবা
বছরের শুরুতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই পেয়ে থাকে শিক্ষার্থীরা। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবার তাতে ছন্দপতন ঘটেছে। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ পেরুলেও সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেনি।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের সব পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়া হবে। চাহিদা অনুযায়ী এ বছর মোট ৪০ কোটির বেশি পাঠ্যবই ছাপানোর কথা রয়েছে। এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ১৮ কোটি এবং গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি বই। সে হিসাবে প্রায় ৭০ শতাংশ বই এখনও শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেনি।
উদ্ভূত পরস্থিতিতে কবে নাগাদ শতভাগ বই হাতে পাওয়া যাবে তা নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা শঙ্কা আর সংশয়ের মধ্যে পড়েছেন। আর তাদের এই সংশয় ও উৎকণ্ঠার সুযোগ নিচ্ছেন বইয়ের কালোবাজারিরা। বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে বিনামূল্যের বই। ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ একাধিক জায়গায় পাঠ্যবই উদ্ধার এবং গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডও (এনসিটিবি) পাঠ্যবই কালোবাজারির সত্যতা স্বীকার করছে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ড. একেএম রিয়াজুল হাসান বলেছেন, ‘বই ছাপানোর জন্য নিবন্ধিত প্রেসগুলোর সংশ্লিষ্টতা ছাড়া বোর্ডের বই কালোবাজারে যাওয়ার কথা নয়। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
রাজধানী ঢাকার নীলক্ষেত, বাংলাবাজারসহ সারা দেশের সুযোগসন্ধানী বই ব্যবসায়ীরা অবৈধ উপায়ে বই জোগাড় করে তা বিক্রি করছে। সন্তান যাতে বইয়ের অভাবে প্রতিযোগিতামূলক লেখাপড়ায় পিছিয়ে না পড়ে সেই বিবেচনায় অভিভাবকরাও অনেকটা উচ্চদামে বাজার থেকে বই কিনে নিচ্ছেন। আর বইয়ের কালোবাজারিরা এই সুযোগে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
রাজধানীর নিউমার্কেটের উল্টোপাশে নীলক্ষেতের বইয়ের মার্কেট যেকোনো ধরনের বই সরবরাহে বরাবরই শীর্ষে। কোনো বই দেশের আর কোথাও পাওয়া না গেলেও নীলক্ষেতে গেলে একটা সমাধান মেলে। বইয়ের কালোবাজারিতেও এই মার্কেটকে অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র ধরা হয়।
বিনামূল্যের বই না পেয়ে অভিভাবকরা এখানে ভিড় করছেন এবং পেয়েও যাচ্ছেন। বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি রোধে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইতোমধ্যে এই মার্কেটে অভিযান চালিয়েছে। তারপরও এখানে পাঠ্যবই বিক্রি বন্ধ হয়নি। বিক্রির কৌশল পাল্টেছে মাত্র।
নীলক্ষেত এলাকায় টানা দুদিন সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রির অভিনব পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে। পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
নীলক্ষেত এলাকার আরেকটি প্রচলিত নাম বইবাজার। এখানে ইসলামিয়া মার্কেট, আদর্শ মার্কেট, বাকুশাহসহ আশপাশের চারটি মার্কেটে রয়েছে পাঁচ শতাধিক বইয়ের দোকান। এতদিন বিক্রেতারা দোকানে বসেই বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি করতেন। সম্প্রতি অভিযানের পর পাল্টে গেছে বেচাকেনার ধরন।
ক্রেতারা কোনো দোকানে গিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই আছে কি না জানতে চাইলে এক কথায় জানিয়ে দেওয়া হয় ‘নেই’। ক্রেতারা এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ছুটে বেড়ান। সবখানে একই জবাবÑ ‘নেই’। তবে এটা হলো বাহ্যিক চিত্র। কারণ ততক্ষণে ক্রেতাকে টার্গেট করে ফেলেছেন বিক্রেতারা। তারা কিছুক্ষণ নজরদারি করে আগে নিশ্চিত হয়ে নেন যে ক্রেতা কোনো সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কি না।
বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর বিক্রেতা ধরা দেন। ক্রেতার পাশে গিয়ে নিচু স্বরে বলেন, ‘এভাবে খুঁজে পাঠ্যবই পাবেন না। বাজার পরিস্থিতি ভালো না। কী বই লাগবে আমাকে বলেন।’
এরপর চলে দরকষাকষি। দুপক্ষের সমঝোতা হলে ক্রেতাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মিনিট পাঁচেক পরই ফিরে আসেন ওই ব্যক্তি। বিনিময় হয় টাকা আর পলিথিনে মোড়ানো বই। ক্রেতার মুখে হাসি ফোটে, আর মুহূর্তেই চোখের আড়াল হয়ে যান ওই বিক্রেতা।
নীলক্ষেত এলাকায় সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে এভাবেই ছদ্মবেশে ভাসমান বিক্রেতাদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিক্রি করতে দেখা যায়।
পাঠ্যবই বিক্রিতে গোপনীয়তা অবলম্বনে ভিন্ন পন্থাও চোখে পড়ে। ইসলামিয়া মার্কেটের দুই নম্বর গলিতে আরাফাত বুক হাউসে এই প্রতিবেদক কথা বলেন মালিক এবি সিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, তৃতীয় শ্রেণির ২০২৫ সালের চারটি বই দেওয়া যাবে। দাম পড়বে এক হাজার টাকা। তবে টাকা দিয়ে ক্রেতাকে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে। দোকানের লোক বই পৌঁছে দেবে।
পাশের রাফি বুক সেন্টার, বরিশাল বুকসহ বেশ কয়েকটি দোকানে গিয়ে পাঠ্যবই চাইলে একইভাবে জানানো হয়Ñ বই আছে, টাকা দিলে পৌঁছে দেওয়া হবে।
বাকুশাহ মার্কেটের লাইনে অবস্থিত রিয়া বুক হাউসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এই প্রতিবেদককে দোকানের ভেতরে থাকা একজন ডাকাডাকি শুরু করেন। বলেনÑ ভাই, কী লাগবে? এই প্রতিবেদক দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির বোর্ডের বই আছে কি না জানতে চাইলে তিনি ২০২৪ সালের ফুল সেট বই দেখান। চলতি ২০২৫ সালের নতুন বই আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আছে কি না দেখতে হবে। একটু দাঁড়ান।’
প্রতিবেদককে দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে ওই ব্যক্তি মার্কেটের ভেতরে চলে যান। এরপর আরেক ব্যক্তি এসে দোকানে ঢোকেন। আর সামনে দাঁড়ানো ক্রেতারূপী প্রতিবেদককে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। অপরদিকে আরেকজন এসে ক্রেতার সঙ্গে কারও যোগাযোগ হচ্ছে কি না বা আশপাশে কেউ আছে কি না তা পর্যবেক্ষণ করেন। এভাবে পাঁচ-সাত মিনিট কেটে যায়।
এবার প্রথম কথা বলা অল্পবয়সি দোকানি খালি হাতে ফিরে এসে বলেন, ‘বই আছে, নিতে চাইলে পাবেন।’ দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তৃতীয় শ্রেণির ছয়টি বইয়ের জন্য ২৫০০ এবং দ্বিতীয় শ্রেণির তিনটি বইয়ের জন্য ১৫০০ টাকা লাগবে।’
প্রতিবেদক তাতে রাজি হয়ে বইগুলো আনতে বললে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি এগিয়ে আসেন। বলেনÑ ‘হবে না ভাই, বই নাই।’
বোঝা গেল ওই ব্যক্তি ক্রেতারূপী এই প্রতিবেদককে সন্দেহ করেছেন।
গত সোমবার ও বুধবার নীলক্ষেত এলাকা ঘুরে এরকম অনেক দৃশ্যই চোখে পড়েছে। গত কদিন ধরে নীলক্ষেত এলাকার বইয়ের দোকানগুলোতে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সব ক্রেতাই যেন তাদের কাছে সন্দেহজনক। তাই নজরদারি ছাড়া বই বিক্রি করছেন না এখানকার দোকানিরা।
বাবুল নামে এক বই বিক্রেতার সঙ্গে গতকাল দুপুরে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, ‘ভাই, সাংবাদিক আর গোয়েন্দাদের কারণে আমরা আতঙ্কে আছি। ছাপাখানা ও কিছু স্কুলশিক্ষকের কাছ থেকে দালালের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আমরা এসব বই কিনেছি।’
তিনি বলেন, ‘শাসনের নজরদারির কারণে এখন পরিস্থিতি একটু অন্যরকম। বইগুলো বিক্রি করতে সমস্যা হচ্ছে। বইয়ের ক্রেতা পরিচয়ে আসা ব্যক্তিরাও কোনো সংস্থার লোক কি না তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। এ কারণে আমরা দোকানদাররা ভাসমান বিক্রেতাদের মাঠে নামিয়েছি। কারণ বইগুলো এখনই বিক্রি করতে না পারলে লোকসানে পড়তে হবে। কেননা আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে হয়তো ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল থেকেই বই পেয়ে যাবে।’
কোন শ্রেণির বইয়ের দাম কত জানতে চাইলে বাবুল জানান, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির এক সেট বইয়ের দাম পড়বে দুই হাজার টাকা। আর ষষ্ঠ থেকে নবম-দশম শ্রেণির বইয়ের দাম পড়বে তিন হাজার পাঁচশ থেকে চার হাজার টাকা।
সাংবাদিক পরিচয়ে কথা হয় নীলক্ষেতের মল্লিক বুক হাউসের মালিক এহসান মল্লিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বই না থাকার কারণে অনেক ক্রেতাই ফিরে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা স্কুলেও বই পাচ্ছে না। আর এটাকেই সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছেন অসৎ বই ব্যবসায়ীরা। মাঝেমধ্যে যে অভিযান চালানো হচ্ছে সেটাকে প্রহসন বলা চলে। অভিযান চালিয়ে জরিমানা কেন, এ ধরনের অপরাধের কারণে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে ফৌজদারি আইনে মামলা হওয়া উচিত। মামলা হলে তদন্তেই বেরিয়ে আসবে কারা এই অসৎ কারবারের সুযোগ করে দিচ্ছে।’
কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাপাখানা থেকেই এসব বই বাজারে আসছে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী।
শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যা বলছেন
আজিমপুর নিউ পল্টন লাইন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘আমার স্কুলে চাহিদার তুলনায় অনেক কম বই এসেছে। আবার যেগুলো পাওয়া গেছে সেগুলোর কাগজ ও ছাপার মান খুবই নিম্ন।’
ধানমন্ডির এএফ ট্রিনিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মনির হোসেন বলেন, ‘চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিসহ বেশ কয়েকটি শ্রেণির একটি বইও এখনও হাতে পাইনি। অথচ চাহিদার চেয়ে বেশি বই নিয়ে কোনো কোনো স্কুল কর্তৃপক্ষ কালোবাজারে বিক্রি করে দেয়। এরকম অভিযোগ থাকলেও এনসিটিবির পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না।’
এখনও পাঠ্যবই হাতে না পাওয়ায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শাখার দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী তানজিম চৌধুরী পূর্ণতার মন খারাপ। এই শিশুশিক্ষার্থীর অভিব্যক্তি, ‘বই না পাওয়ায় পিছিয়ে পড়ছি। তাড়াতাড়ি বই হাতে পেলে পড়ালেখায় এগিয়ে থাকতাম। এখন তো বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে পড়ছি। কারণ ওদের বাবা নাকি মার্কেট থেকে বই কিনে দিয়েছে।’
সাউথ পয়েন্ট স্কুল, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া শাখার তৃতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র আহমেদ বিন মুনির ও তাহমিদ বিন মুনির দুই ভাইয়ের কণ্ঠেও একই আক্ষেপ। তাহমিদ বিন মুনির বলল, ‘বই না পাওয়ার কারণে পিডিএফ ফরম্যাট থেকে একটি বই প্রিন্ট করিয়েছি। বাবা বলেছে, সব বই প্রিন্ট করাতে অনেক টাকা লাগবে। তাই স্কুল থেকে বই পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। অথচ আমার কয়েক বন্ধুর বাবা নাকি বই জোগাড় করে দিয়েছেন। তাহলে বই ছাড়া আমরা পিছিয়ে পড়ব না!’
এই দুই শিশু শিক্ষার্থীর অভিভাবক মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘এভাবে বেশি সময় পার হয়ে গেলে সন্তানদের পড়ালেখার অনেক ক্ষতি হবে। এর প্রভাব পরবর্তীতে পরীক্ষাগুলোর ফলাফলেও পড়বে। আর তাতে সন্তানের মনোবল ভেঙে যাবে।’
বই সংকটের কারণ
বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই তুলে দিতে না পারার কারণ খুঁজতে রাজধানীর মাতুয়াইলে একটি ছাপাখানায় গিয়ে দেখা যায়, রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা পাঠ্যবই ছাপানোর চুক্তি থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। চুক্তি ভঙ্গ করে সেখানে পাঠ্যবইয়ের কাজ বন্ধ রেখে অন্য অর্ডারের কাজ করা হচ্ছে।
ছাপাখানার একপাশে দেখা গেল প্রাথমিকের কিছু বই স্তূপ করে রাখা আছে। সেখান থেকে একটি বই হাতে নিয়ে দেখা যায়, কাগজ ও ছাপা অতি নিম্নমানের। ওই ছাপাখানার এক শ্রমিক জানান, ৭০ গ্রামের কাগজে ছাপানোর কথা থাকলেও বইগুলো ছাপা হচ্ছে ৪০ থেকে ৬০ গ্রামের কাগজে।
বই ছাপানোর কাজ পাওয়া মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান লেটার অ্যান্ড কালার লিমিটেডের প্রতিনিধি একেএম রাশেদুজ্জামান বলেন, ‘পাঠ্যবই ছাপায় বিলম্ব হওয়ার কারণ অনেক। কার্যাদেশ ও প্রিন্ট অর্ডার আগে হলেও পরিমার্জনের পর বইগুলোর সফট কপির সিডি দেওয়া হয় দেরিতে। তারপর আবারও সেগুলো প্রত্যাহার করে নতুন সিডি দেওয়া হয়েছে। তাই বেশ কিছুদিন বসে থাকতে হয়েছে।’
কাগজ সংকটও বই ছাপানোর কাজে বিঘ্ন ঘটার আরেকটি বড় কারণ বলে জানান তিনি। বলেন, পাঠবই ছাপানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ৮৫ শতাংশ ব্রাইটনেস সমৃদ্ধ পাল্পের কাগজ। কিন্তু মাত্র পাঁচটি পেপার মিল এই মানের কাগজ সরবরাহ করছে। তারা চাহিদামাফিক কাগজ সরবরাহ করতে পারছে না। ২৪ টন কাগজ অর্ডার দিয়ে পেয়েছি মাত্র পাঁচ টন।’
যা বলছে এনসিটিবি
পাঠ্যবই ছাপা ও সরবরাহে ঘাটতির জন্য এনসিটিবি দুষছে ছানাখানাগুলোকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির সূত্র বলছে, পাঠ্যবই সংকটের নেপথ্যে রয়েছে মূলত মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। মুদ্রণের কাজ পাওয়ার পর তাদের দায়িত্ব ছিল অন্য কাজ না করে শুধু বই ছাপানো। কিন্তু তারা সেটি না করে বই ছাপানো বন্ধ রেখে অন্য অর্ডারের কাজ করছে। এ কারণেই তারা নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়াও মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আগের সরকারের আমলের মতো যেনতেন মানের বই এনসিটিবিকে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই তুলে দিতে না পারার এটিও একটি কারণ।
চলতি মাসের মধ্যে বই দিতে না পারলে মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানিয়েছেন এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান ড. একেএম রিয়াজুল হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী এ বছর মোট ৪০ কোটির বেশি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। তার মধ্যে এ পর্যন্ত ছাপা হয়েছে ১৮ কোটি বই। তা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ১৪ কোটি। বই বিতরণের এই পরিমাণ চাহিদার প্রায় ৩০ শতাংশ। দ্রুতই শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে। সে লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক তদারকি চলছে।’
তিনি বলেন, ‘মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে যেনতেন মানের বই গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বিগত সরকারের সময় এদের কাছে এনসিটিবি নতি স্বীকার করেছিল। তখন নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে চলত সব। কিন্তু এখন তা সম্ভব হচ্ছে না।’
বিনামূল্যের বই কালোবাজারে বিক্রি প্রসঙ্গে রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘বই ছাপানোর জন্য আমাদের নিবন্ধিত যে প্রেসগুলো আছে তারাই এই কাজ পেয়েছে। সুতরাং তাদের কাছ থেকেই তো এগুলো কালোবাজারে যাওয়ার কথা। সাধারণ প্রেসে এটা ছাপা হওয়ার কথা না।’
তিনি বলেন, ‘শুধু নীলক্ষেত বা বাংলাবাজারে নয়, ঢাকার বাইরেও এই বই বিক্রি হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। যারাই দায়ী থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
ইন্টারনেটে পিডিএফ ফরম্যাটে বই প্রকাশের ব্যাপারে এনসিটিবির এক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইন্টারনেটে ছাড়ার অর্থ এই নয় যে, কেউ সেটা বই আকারে মুদ্রণ করে বাণিজ্য করবে। যেহেতু সরকার বা এনসিটিবি নির্ধারিত সময়ে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে ব্যর্থ হয়েছে, সে কারণেই পিডিএফের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যারা বই পায়নি তারা যাতে করে পিছিয়ে না পড়ে, পিডিএফ থেকে প্রিন্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে, সে উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে।
এই র্কমর্কতা জানান, চুক্তি অনুযায়ী বই সরবরাহ করতে না পারলে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করার পরিকল্পনা আছে এনসিটিবির। যারা সঠিক সময়ে কাজ শেষ করবে তাদেরকে ভবিষ্যতে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্তও আছে।
উল্লেখ্য, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা গত ১৫ জানুয়ারি দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় রাজধানীর নীলক্ষেতে বই মার্কেটে অভিযান চালান। এ সময় কয়েকটি লাইব্রেরিতে বিনামূল্যের পাঠ্যবই পাওয়া যায়। চায়না বুক হাউস, মিজি বুক হাউস, বইয়ের দেশ-২, মামুন বুক হাউসসহ কয়েকটি লাইব্রেরি থেকে বিনামূল্যের পাঠ্যবই উদ্ধার করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। পরে সেসব দোকানের মালিকদের এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়।