অরক্ষিত রেল ক্রসিং
প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৫ এএম
আপডেট : ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:০৫ এএম
আখাউরা-সিলেট রেলপথের ভানুগাছ রেলওয়ে স্টেশনের পাশেই অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং। ছবি : সাদিকুর রহমান সামু
বাংলাদেশ রেলওয়ের দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা রেলপথে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে দুর্ঘটনা। ঘটছে প্রাণহানি। আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। তারপরও বিষয়টি যেন সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না। রেল কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রে ক্রসিং-সংশ্লিষ্ট সড়কগুলোর তদারক সংস্থা এলজিইডি ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
সারা দেশে রেলপথে মোট ক্রসিং আছে ২ হাজার ৮৫৬টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬১টিরই অনুমোদন নেই। আবার ১ হাজার ৪৯৫টি বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে ৬৩২টি ক্রসিংয়েই গেটম্যান নেই।
রেলওয়ে সূত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। এমন অনেক ক্রসিং তৈরি হয়েছে যেগুলোর পরিসংখ্যান রেল কর্তৃপক্ষের নথিতে নেই। পাকা সড়ক যোগাযোগ বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়ছে অননুমোদিত রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা। ওদিকে অনুমোদন আছে এমন অনেক ক্রসিংয়েই গেট ও গেটম্যান নেই। আবার অনেক স্থানেই অনুমোদিত ক্রসিংয়ে সাবধানতার সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
অক্টোবর, ২০২৪ রোড সেফটি ফাউন্ডেশন (আরএসএফ) প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ বছরে সারা দেশে রেলের ১ হাজার ২২৮টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৪০৩ জন নিহত ও ১ হাজার ২৬৯ জন আহত হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, রেলওয়ের বৈধ-অবৈধ রেলক্রসিংগুলোর ৮৪ শতাংশই অরক্ষিত। রেল দুর্ঘটনায় যত প্রাণহানি ঘটে, সেগুলোর ৮৯ শতাংশই ঘটেছে অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের কারণে।
অরক্ষিত রেল ক্রসিং ও এর ভোগান্তি আর শঙ্কার চিত্র তুলে ধরে সারা দেশ থেকে সরেজমিন প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এর স্থানীয় অফিস ও প্রতিনিধিরা।
চট্টগ্রামে ৯ শতাধিক ক্রসিংয়ে গেটম্যান ও ব্যারিয়ার নেই
চট্টগ্রাম অফিস জানায়, রেললাইনের ওপর দিয়ে ডাবল লেনের সড়ক। সেই সড়কের এক পাশে ব্যারিয়ার ফেলা হয়েছে। অন্য পাশ দিয়ে অবাধে চলছে গাড়ি। ট্রেন আসা নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই মানুষজনের। রেল ক্রসিংয়ের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তির তা থামানোর গরজও নেই। চট্টগ্রামের কদমতলী রেল ক্রসিংয়ের এই দৃশ্য স্থানীয় সবারই পরিচিত।
পূর্বাঞ্চল রেলের চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ১৩৭টি লেভেল ক্রসিং গেট আছে।
রেলের সর্বশেষ প্রকাশিত ওয়ার্কিং টাইম টেবিলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিভাগে মোট চার ক্যাটাগরির ১৩৭টি লেভেল ক্রসিং আছে। এর মধ্যে স্পেশাল ক্যাটাগরির ১৭টি, ‘এ’ ক্যাটাগরির ৮টি, ‘বি’ ক্যাটাগরির ৩২টি, ‘সি’ ক্যাটাগরির ৭৩টি ও ‘ডি’ ক্যাটাগরির ৬টি। এর বাইরেও শত শত অবৈধ রেল ক্রসিং আছে। বৈধ অনেক রেল ক্রসিংয়ে লোকবল নেই। চট্টগ্রামের বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে ৯ শতাধিক ক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান নেই, নেই ব্যারিয়ার।
রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, অনেক অবৈধ রেল ক্রসিং আছে। বিভিন্ন এলাকায় অনেক প্রভাবশালী মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে রাতারাতি ক্রসিং তৈরি করে নেয়। এসব অবৈধ ক্রসিংয়ে রেলের লোকবল নেই। পূর্বাঞ্চলে স্থায়ী প্রায় চারশ গেটম্যানের পাশাপাশি ১ হাজার ৩৮ জন অস্থায়ী গেটম্যান কাজ করে।
তবে অভিযোগ আছেÑ রেলের লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যানদের অনেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। দুই বছর আগে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে খৈয়াছড়া এলাকায় রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাসে থাকা ১১ জন নিহত হয়, যারা সবাই ছাত্র। ওই দুর্ঘটনার সময় গেটম্যান অনুপস্থিত ছিলেন।
বগুড়ায় ৭০ কিলোমিটারে অনুমোদনহীন ক্রসিং ২১টি
বগুড়া অফিস জানায়, উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ জনপদ বগুড়ায় শহরসংলগ্ন এলাকা ও গ্রামে পাকা সড়কের সংখ্যা যত বাড়ছে অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংয়ের সংখ্যাও তত বাড়ছে। মারণফাঁদ হয়ে উঠছে অনুমোদিত কিন্তু গেটম্যানবিহীন (প্রহরী ছাড়া) লেভেল ক্রসিংগুলো।
বগুড়ায় মিটারগেজ সেকশনের ৭০ কিলোমিটার রেলপথে ২১টি অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এ ছাড়া অনুমোদন রয়েছে কিন্তু গেটম্যান নেইÑ এমন লেভেল ক্রসিং রয়েছে আরও ১০টি। এসব লেভেল ক্রসিং যেন মারণফাঁদ হয়ে উঠেছে। এসব ক্রসিং পার হতে গিয়ে দিনে-রাতে ট্রেনে কাটা পড়ে একের পর এক ঘটে চলেছে প্রাণহানি। তারপরও রেলওয়ে এবং রেললাইন অতিক্রম করা সড়কগুলোর তদারক সংস্থা এলজিইডি, পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বিকার।
রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, সান্তাহার জংশন স্টেশন থেকে সোনাতলা পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটার মিটারগেজ রেলপথে মোট ৫১টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি রেলওয়ের প্রকৌশল শাখার অধীনে। বাকি ২১টি রেলওয়ে ট্রাফিক বিভাগের নিয়ন্ত্রণে।
ওইসব লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে ১৮টিতে গেটম্যান রয়েছে। বাকি ৩৩টির মধ্যে ১০টিতে গেটম্যান নেই। এর পাশাপাশি শহর ও গ্রাম এলাকায় পাকা সড়ক সম্প্রসারণের কারণে আরও অন্তত ২১টি স্থানে অনুমোদন ছাড়াই লেভেল ক্রসিং গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ১৩টির অবস্থান এলজিইডির মালিকানাধীন কাঁচা-পাকা সড়কে।
গেটম্যানবিহীন অননুমোদিত ক্রসিংয়ে যানবাহন পারাপার হতে গিয়ে হরহামেশাই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদেরও।
ময়মনসিংহে অরক্ষিত ক্রসিংয়ে এক বছরে মৃত্যু ৪৯
ময়মনসিংহ অফিস জানায়, ময়মনসিংহ রেলওয়ের আওতায় ৪৪টি রেল ক্রসিং রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। এগুলোতে কোনো গেটকিপার না থাকায় প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত এক বছরে ৪৯ জন মানুষ ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।
তবে এসব রেল ক্রসিং অবৈধ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। তারা বলেছে, অবৈধ রেলক্রসিং বন্ধে বারবার চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায়নি।
ময়মনসিংহ জংশন থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ, জামালপুর-ময়মনসিংহ, ময়মনসিংহ-নেত্রকোণা ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল করে। ময়মনসিংহ রেলওয়ের আওতায় ৩২টি রেল ক্রসিং রয়েছে সংরক্ষিত অবস্থায়। এগুলোতে নিয়মিত গেটকিপার রয়েছে। আর ৪৪টি রেল ক্রসিং রেল কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে। ফলে এগুলোতে গেটকিপার নেই। অরক্ষিত এসব ক্রসিংয়ে প্রায়ই ট্রেনে কাটা পড়ে মানুষ মারা যাচ্ছে।
গত বছর ৪৯ জন মানুষ মারা গেছে ট্রেনে কাটা পড়ে। এ ছাড়া রেললাইন ঘেঁষে অবৈধভাবে দোকানপাট গড়ে তোলায় অসতর্ক অবস্থায় মানুষ কাটা পড়েÑ এমন অভিযোগ রয়েছে।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে থানার ওসি আক্তার হোসেন জানান, রেললাইন ঘেঁষে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব কারণে ও অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে গত এক বছরে ৪৯ জন মানুষ ট্রেনে কাটা পড়েছে।
ময়মনসিংহ রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যত্রতত্র রেল ক্রসিং চালু হয়েছে। এসব কারণে প্রায় সময় অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। অবৈধ এসব রেল ক্রসিং বন্ধে বারবার উদ্যোগ নিলেও এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির বাধার কারণে বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।’
গাজীপুরে অর্ধশত অরক্ষিত রেল ক্রসিং
গাজীপুর প্রতিবেদক জানান, গাজীপুরে ১৪টি রেলওয়ে স্টেশনে শতাধিক লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদনহীন ক্রসিংয়ের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। টঙ্গী-নরসিংদী-শ্রীপুর রুটে রাজস্ব খাত দ্বারা পরিচালিত রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৯টি। এ প্রকল্পের আওতায় আরও ২১টি রেল ক্রসিং রয়েছে। অনুমোদনহীন রেল ক্রসিংগুলোতে সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানিয়েই দায় সেরেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশন হতে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার রেলপথের অধিকাংশ ক্রসিং অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ের কোনোটিতে গেট ব্যারিয়ার আছে, কোনোটিতে নেই। থাকলেও সেগুলো ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। আবার কোনোটিতে গেট আছে, গেট ব্যারিয়ার আছে, কিন্তু গেটম্যান নেই।
গাজীপুর-যমুনা সেতু রেললাইনের গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘিয়া রেল ক্রসিংয়ে একটি সাইনবোর্ড দিয়ে দায় সেরেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া কালিয়াকৈর উপজেলার ভান্নারা, মৌচাক, কালামপুর এলাকার বেশ কয়েকটি রেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে।
এসব রেল ক্রসিংয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে গাজীপুরের টঙ্গীর আরিচপুর, বউবাজার, মধুমতী রেলগেট, বনমালা রেলগেট, হায়দরাবাদ, শ্রীপুর, বনখরিয়া ও কালামপুরে। এসব ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় প্রতিবছর অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি ঘটে।
লালমনিরহাট ডিভিশনে ১৯৩৯ ক্রসিংয়ের মধ্যে গেট ও গেটম্যান আছে ৪১৩টিতে
রংপুর অফিস জানায়, লালমনিরহাটে রেলওয়ে ডিভিশনে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এই ডিভিশনে থাকা লেভেল ক্রসিংগুলোর ৭৯ শতাংশ অরক্ষিত থাকায় গত তিন বছরে সৈয়দপুর রেলওয়ে জেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে ২৫১ জন। সংকট নিরসনে অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে গেট তৈরিসহ গেটম্যান নিয়োগে উদ্যোগের কথা জানিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
রংপুর রেলওয়ে ডিভিশন সূত্রে জানা যায়, লালমনিরহাট রেলওয়ে ডিভিশনের আওতায় রেলপথ রয়েছে ৫৪০ কিলোমিটার। এই দীর্ঘ রেলপথে ক্রসিং রয়েছে ১ হাজার ৯৩৯টি। এর মধ্যে গেট ও গেটম্যান রয়েছে মাত্র ৪১৩টিতে। গেট রয়েছে কিন্তু গেটম্যান নেইÑ এমন রেল ক্রসিংয়ের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৬টি। গেট ও গেটম্যান উভয়ই নেইÑ এমন রেল ক্রসিং রয়েছে ৩৬০টি।
লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগ অরক্ষিত থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে, শীত মৌসুমে ও রাতের বেলায় ক্রসিংগুলোতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে রেলের গতি অনুমান করতে না পেরে অনেকে রাস্তা পারাপার হতে গিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে।
সৈয়দপুর রেলওয়ে জেলার আওতায় উত্তরের ৫ জেলায় গত ২০২২ সালে ৯২ জন, ২০২৩ সালে ১০১ জন ও ২০২৪ সালে ৫৮ জন ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কাউনিয়া জংশনের আওতায় সড়কগুলোর ১২টি লেভেল ক্রসিংয়ের বেশিরভাগেই নেই গেট। কয়েকটিতে চলছে জোড়াতালি দিয়ে।
এ ব্যাপারে রংপুর বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপককে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। তবে রংপুর রেলওয়ে স্টেশন সুপারিনটেনডেন্ট শংকর গাঙ্গুলী বলেন, ‘রেলের অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংকে সুরক্ষিত করতে গেট নির্মাণ ও গেটম্যান নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। আশা করছি, রংপুরে দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে।’
রাজশাহীতে অরক্ষিত ২৫টি রেল ক্রসিংয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল
রাজশাহী অফিস জানায়, অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের কারণে রাজশাহীতে ঘটছে ছোট-বড় ট্রেন দুর্ঘটনা। রাজশাহী নগরীর কোর্ট স্টেশন এলাকা, কাটাখালী এলাকা, পুঠিয়ার বেলপুকুর থেকে বাঘার আড়ানী পর্যন্ত রেললাইনের গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোর অধিকাংশেই নেই গেটম্যান। এতে প্রায়ই ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। ফলে অনেক সময় রাজশাহীর সঙ্গে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ট্রেন বন্ধ থাকছে। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এই রুটে এমন অন্তত ২৫টি অরক্ষিত রেল ক্রসিং রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে এসব অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে পূর্ণ তথ্য থাকলেও তাদের তা নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সাধারণ যাত্রী ও যানবাহন চালকদের মাঝেও রয়েছে অসচেতনতা।
ঠাকুরগাঁওয়ে ৫৫টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯টিতে রয়েছে গেটম্যান
ঠাকুরগাঁও প্রতিবেদক জানান, ঠাকুরগাঁওয়ে দ্রুতগতির আন্তঃনগর রেলসেবা বৃদ্ধি হলেও সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পায়নি রেল ক্রসিংয়ের গেট ও গেটম্যানের সংখ্যা। ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে রেল দুর্ঘটনা। অধিকাংশ রেল ক্রসিংয়ে নেই কোনো গেট কিংবা গেটম্যান। শুধু টাঙানো আছে সাবধান বাণী, তাও আবার সব ক্রসিংয়ে নেই। এর ফলে ক্রসিংগুলোতে মৃত্যুঝুঁকি আর রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। কিন্তু রেল বিভাগের জোরাল পদক্ষেপ নেই।
রেল বিভাগ অনুমোদিত জেলার ৫৫টি রেলগেটের মধ্যে মাত্র ৯টিতে রয়েছে গেট আর গেটম্যান। বাকি ৪৬টি রেলগেটে কোনো গেটম্যান নেই। সেগুলোতে আছে কেবল ক্রসিংয়ের দুপাশে জনসাধারণের জন্য সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড। এগুলো ছাড়াও জেলায় রেল বিভাগের অনুমোদনবিহীন রেলগেট আছে ১০টিরও বেশি, যেগুলোতে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিও নেই।
ঠাকুরগাঁও রোড রেলওয়ে স্টেশনমাস্টার আখতারুল ইসলাম বলেন, ‘এসব দুর্ঘটনার জন্য পঞ্চগড়-ঢাকা রুটে আন্তঃনগর ট্রেন বৃদ্ধিকে দায়ী করা যাবে না। রেল বিভাগের অনুমোদনবিহীন রেলগেট নির্মাণ দায়ী। তবে ইতোমধ্যে সরকারের রাস্তা নির্মাণকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় ও সমস্যা সমাধানের জন্য রেল বিভাগ উদ্যোগ নিয়েছে।’
রাজবাড়ীতে ৩৬টি অরক্ষিত রেল ক্রসিং
রাজবাড়ী প্রতিবেদক জানান, জেলার পাঁচটি উপজেলার ওপর দিয়ে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, বেনাপোল, টুঙ্গিপাড়াসহ বিভিন্ন রেলরুটে চলাচল করে ট্রেন। এসব রেলপথের ওপর দিয়ে ৫৭টি বৈধ ও অবৈধ রেল ক্রসিং রয়েছে। অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের কারণে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
রাজবাড়ী রেলওয়ে থানা সূত্রে জানা গেছে, রাজবাড়ী জেলা অংশের রেলপথে বিভিন্ন স্থানে ৫৭টি রেলক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে বৈধ ৪৩টি। ২১টিতে প্রতিবন্ধক ও গেটম্যান থাকলেও কম গুরুত্বপূর্ণ ২২টিতে কোনো প্রতিবন্ধক ও গেটম্যান নেই। অবৈধ ১৪টি রেলক্রসিং সম্পূর্ণ অরক্ষিত। স্থানীয়রা যাতায়াতের সুবিধার্থে এগুলো তৈরি করেছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছে, রেল ক্রসিংগুলোতে কোনো প্রতিবন্ধক না থাকায় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পাকশীর সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ রেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করে আসা হচ্ছে। এখনও তা অব্যাহত আছে।’
কিশোরগঞ্জে অরক্ষিত রেল ক্রসিং ৭৩টি
মধ্যাঞ্চলীয় অফিস জানায়, কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্যে প্রায় ৬২ কিলোমিটার রেলপথে মোট ১০৩টি রেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে অনুমোদিত ৩০টি লেভেল ক্রসিংয়ে গেট ও গেটম্যান রয়েছে। অনুমোদনহীন বাকিগুলোর ৭৩টিই অরক্ষিত। এসব ক্রসিংয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে যানবাহন ও মানুষজন। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে মৃত্যু।
কিশোরগঞ্জ-করিমগঞ্জ সড়কের শুরুতেই রেল ক্রসিং, গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে গেট ও গেটম্যান থাকলেও ঠিকঠাক গেট নামানো-ওঠানো যায় না। এতে করে ঝুঁকি নিয়ে এই ক্রসিং পার হতে হয় যানবাহন ও মানুষজনকে।
সরেজমিনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা ইছারসুর, কোনামাঠি, কালিকাবাড়ী, কানিকাটাসহ ভিন্ন স্থানে গিয়ে একই চিত্র দেখা যায়। রেল ক্রসিংয়ে গেট বা গেটম্যান কেউই নেই, ঝুঁকি নিয়ে চলছে মানুষসহ যানবাহন।
রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (কার্য) শেখ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রতিদিনের বাংলাদেশকে জানান, অবৈধ রেল ক্রসিংগুলো বন্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ শিগগির ব্যবস্থা নেবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংয়ে গেট ও গেটম্যান নিয়োগ দেওয়া হবে।
অরক্ষিত ক্রসিংয়ে শঙ্কা নিয়ে চলাচল
জয়পুরহাট প্রতিবেদক জানান, ঘটনাটি ২০০৬ সালের। ওই বছরের ১১ জুলাই সকাল ১০টার কিছু সময় পর অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ট্রেন-বাসের দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মারা যায় ৩২ জন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও কয়েকজন প্রাণ হারায়। এতে ওই দুর্ঘটনায় মোট ৪০ জন বাসযাত্রী প্রাণ হারায়। এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল জয়পুরহাটের আক্কেলপুর পৌর শহরের আমুট্ট লেভেল ক্রসিংয়ে।
এরপরও ১০ বছর অরক্ষিত থাকে ওই লেভেল ক্রসিং। পরে ২০১৭ সালের দিকে সেখানে প্রতিবন্ধকতার গেট নির্মাণ করা হয়। নিয়োগ দেওয়া হয় লোকবল।
এমনিভাবে প্রায় সময়ই কোনো না কোনো অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। এতে যানবাহনের ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষের নজরে এলেও উদাসীনতায় থাকা হচ্ছে দিনের পর দিন। শুধু নানা সতর্কবার্তা লেখে দেওয়া রয়েছে। কোথাও সেই সতর্কবার্তাও নেই।
রেলওয়ের তথ্য বলছে, জয়পুরহাট জেলার আওতায় আক্কেলপুরের ছাতিয়ানগ্রাম থেকে পাঁচবিবির আটাপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৪৬ দশমিক ২ কিলোমিটার রেলপথের ওপর দিয়ে অনেকগুলো সড়ক রয়েছে। এসব সড়কের ওপর রেলের অনুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে ১৪টি। এর মধ্যে ৯টি লেভেল ক্রসিংয়ে প্রতিবন্ধকতা ও লোকবল রয়েছে। আর ৫টি লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত রয়েছে। সেগুলোতে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।
অনুমোদন ছাড়া আরও ৬টি লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। রেলওয়ের এই তথ্য ছাড়া আরও কিছু এলাকায় লেভেল ক্রসিং রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ প্রতিবেদক জানান, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেলপথে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই পথে ২৬ বার ট্রেন আসা-যাওয়া করে। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে সড়কের সংযোগ স্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতে নেই কোনো ব্যারিয়ার ও গেটম্যান। দূর থেকে ট্রেন আসতে দেখলেই স্থানীয়রা ডাক দিয়ে পথচারীদের সাবধান করে। তারপরও মাঝেমধ্যেইে ক্রসিংগুলোতে ঘটছে দুর্ঘটনা।
পঞ্চগড়ে ৮টি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং গেট
পঞ্চগড় প্রতিবেদক জানান, পঞ্চগড় জেলায় ১৭ কিলোমিটার রেলপথে রয়েছে ৯টি লেভেল ক্রসিং, যার ৮টিতে নেই কোনো গেট বা গেটম্যান। অরক্ষিত এসব লেভেল ক্রসিংয়ে ঝুঁকি থাকলেও নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দুর্ঘটনা ঘটলেও টনক নড়ে না কর্তৃপক্ষের। এক পাশে রেললাইনের ওপর দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটছে ট্রেন, অন্য পাশ দিয়ে সেই লাইন দিয়ে পারাপার হচ্ছে মানুষসহ বিভিন্ন যানবাহন। তবে জীবনের ঝুঁকি থাকলেও নেই কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা।
অনেক ক্রসিংয়ের পাশে বিদ্যালয়, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকলেও নামমাত্র নোটিস টানিয়ে দায়িত্ব সারছে রেল কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে ঢাকা-পঞ্চগড় রুটে তিন জোড়া, পঞ্চগড়-রাজশাহী রুটে এক জোড়া এবং পঞ্চগড়-সান্তাহার রুটে এক জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে।
রেলওয়ের লালমনিরহাট বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক মো. আব্দুস সালাম বলেন, ‘যেখানে আমাদের অথরাইজড গেট থাকে সেখানে আন-অথরাইজড গেটও আছে। আবার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অনুমোদনহীনভাবে ক্রসিং তৈরি করে ফেলেছে। সেগুলোতে গেটম্যান দেওয়া যায় না।’
রাজশাহীতে অরক্ষিত ২৫টি রেল ক্রসিংয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল
রাজশাহী অফিস জানায়, অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের কারণে রাজশাহীতে ঘটছে ছোট-বড় ট্রেন দুর্ঘটনা। রাজশাহী নগরীর কোর্ট স্টেশন এলাকা, কাটাখালী এলাকা, পুঠিয়ার বেলপুকুর থেকে বাঘার আড়ানী পর্যন্ত রেললাইনের গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোর অধিকাংশেই নেই গেটম্যান। এতে প্রায়ই ঘটছে রেল দুর্ঘটনা। ফলে অনেক সময় রাজশাহীর সঙ্গে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ট্রেন বন্ধ থাকছে। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এই রুটে এমন অন্তত ২৫টি অরক্ষিত রেল ক্রসিং রয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষের কাছে এসব অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ের বিষয়ে পূর্ণ তথ্য থাকলেও তাদের তা নিয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। সাধারণ যাত্রী ও যানবাহন চালকদের মাঝেও রয়েছে অসচেতনতা।
চারঘাট (রাজশাহী) প্রতিবেদক জানান, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ১০ কিলোমিটার রেলপথে অরক্ষিত রেল ক্রসিংয়ে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এগুলোতে কোনো গেটম্যান নেই, রাখা হয়নি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা।
উপজেলার সরদহ ও নন্দনগাছী স্টেশন হয়ে দিনে ও রাতে মিলে প্রায় ২৫টি ট্রেন চলাচল করে। এখানকার ১০ কিলোমিটার রেলপথে প্রায় ১২টি রেল ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে শুধু চারঘাট-রাজশাহী মহাসড়কের হলিদাগাছী এবং চারঘাট-পুঠিয়া রোডে নন্দনগাছী রেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান রয়েছে। বাকি ১০টি ক্রসিং অরক্ষিত।