× ই-পেপার প্রচ্ছদ সর্বশেষ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি শিক্ষা ধর্ম ফিচার ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

বিদায় ২০২৪

গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা

প্রবা প্রতিবেদক

প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:০২ এএম

আপডেট : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১০:৫৯ এএম

গণঅভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশের যাত্রা

মুক্তিযুদ্ধ -পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৯০ সালের পর আরও এক অনন্য বছর হয়ে দেখা দিয়েছে ২০২৪ সাল। ছাত্র-জনতার অমিত শক্তির দুর্নিবার পুনঃপ্রকাশ ঘটেছে এই বছর। পৃথিবীর দিনপঞ্জিতে অভ্যুদয় ঘটেছে এমন এক জুলাই মাসের, যা কি না ৩৬ দিনের। এ সময় ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সহিংসতা ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। পতন ঘটে সংসদীয় গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ধরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা, কর্তৃত্ববাদী থেকে ক্রমশ ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠা এক রাজনৈতিক শক্তির। ৫ আগস্ট দেশত্যাগ করতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। জুলাইয়ের শুরুতে শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ কোটা সংস্কার আন্দোলনের সূত্র ধরে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঘটে এই গণজাগরণ।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু বিভিন্ন গণবিরোধী পদক্ষেপ ও কার্যক্রম, নেতাকর্মীদের লাগামহীন অগণতান্ত্রিক ও সন্ত্রাসী তৎপরতা এবং অর্থনেতিক দুর্বৃত্তায়ন ও লুটপাট, বিশেষত ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে সুপরিকল্পিতভাবে দিনের ভোট নির্বাচনের আগের রাতেই গোপনে সম্পন্ন করে সরকার গঠনের ঘটনায় দলটি দ্রুতই জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। আওয়ামী লীগ সরকারের অপশাসন, বিশেষত দীর্ঘ দেড় যুগের রাজনৈতিক দুঃশাসন ও দুর্বৃত্তায়ন, অর্থনৈতিক লুটপাট বিশেষত অর্থ পাচার, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণহীন ও কার্যকারণহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে চরমভাবে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমন করতে গিয়ে সরকার হত্যা-সহিংসতার পথ বেছে নিলে জনগণ রাজপথে নেমে আসে। বিশেষত ১৬ জুলাইয়ে বিভাগীয় শহর রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে পুলিশ প্রকাশ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করার পর পরিস্থিতি সরকারের পুরোপুরি বিপক্ষে চলে যায়। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মানুষ রাজপথে নেমে আসতে থাকে। মধ্য জুলাইয়ের এ হত্যার প্রতিবাদে এবং সরকার পতনের একদফা দাবিতে শুরু হয় নতুন আন্দোলন। যার মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান। ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার, দেশ ছেড়ে পালাতে হয় তাকে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে অলিখিতভাবে চলে আসে সামরিক বাহিনী। তাদের এবং কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ যুক্ত প্রয়াসে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে যাত্রা শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাংলাদেশ গঠনের নানা প্রয়াস নেয় তারা। গঠন করা হয় বেশ কিছু সংস্কার কমিশনও।

কতটুকু আস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার 

ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের সফল পথিকৃৎ এবং বাংলাদেশে প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয় অর্জনের সুবাদে ড. ইউনূসের শুধু দেশের জনগণের মধ্যেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও রয়েছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা। সেই সুবাদে তার নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও বিভিন্ন মহলে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। সরকার গঠনের পর তিনি যে সংস্কারের ঘোষণা দেন এবং সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করেন, সে উদ্যোগও জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পায়। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলনের একপর্যায়েই ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ দাবির কথা জোরেশোরে উঠে এসেছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর এই সংস্কারের বিষয়টি নতুন এক মাত্রা পায় এবং এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারের উদ্দেশ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়। পরবর্তী সময়ে গঠন করা হয় আরও ছয়টি কমিশন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ নারী অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন, স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ও সংস্কার করার মধ্য দিয়ে ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের’ ওপর গুরুত্বারোপ করে। ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বাস্তবায়নে’ ইতোমধ্যে গঠিত হয়েছে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। এই কমিটি নিজেদের রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবি না করলেও পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, কার্যত এটি একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠনের বিষয়টিকে সবাই ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখলেও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে এই সংস্কার প্রক্রিয়ার ধীরগতিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমে বিএনপি, পরবর্তী সময়ে জামায়াতে ইসলামীও ইতোমধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রগুলোতে দ্রুত সংস্কার শেষ করে তাড়াতাড়ি নির্বাচন সম্পন্ন করার দাবি জানিয়েছে। নির্বাচন কবে হবে, সে সম্পর্কে একেক উপদেষ্টার একেক বক্তব্যের ফলে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানা সংশয়।

বলা অত্যুক্তি হবে না, জুলাই অভ্যুত্থান যে আশা জাগিয়েছিল, নানা কারণে সেই আশা হোঁচট খেতে চলেছে। বিশেষত ব্যাপক জনসমর্থন থাকার পরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতা জনগণকে হতাশ করেছে এবং এই হতাশা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এই সরকার গঠনের পর পরই শুরু হয় ‘মব জাস্টিস’, যার ফলে বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। বিচার অঙ্গনে ঘটে একাধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দানকারীরা পাচার করা অর্থ দ্রুত ফিরিয়ে আনার এবং দুর্নীতি-অনিয়মে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এই আশাবাদ কার্যকরের গতি ক্রমশই মন্থর হয়ে পড়ছে। ‘বাংলাদেশের বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের যাত্রায়’ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্বে যে পাঁচটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল, যা অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল, তাও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকার গঠন করেছিল পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে সমন্বয় কমিটি’। কিন্তু এক ধরনের ‘মব জাস্টিসে’র মুখে সরকারকে সে কমিটিও মাত্র ১৩ দিনের মাথায় ২৯ সেপ্টেম্বর বাতিল করতে হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতেও পড়েছে অশুভ কালো থাবা। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পোশাক শিল্পকারখানা বন্ধ থাকায় এবং বেতন-মজুরি ঠিকমতো পরিশোধ না করায় এই খাতে কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে দেখা দেয় ব্যাপক অসন্তোষ। যা রাজপথকেও উত্তপ্ত করে তোলে। 

এমন পরিস্থিতিতে অতীতের বিভিন্ন সরকার যেমন মূল সংকট থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নমুখী করার জন্যে স্পর্শকাতর সব ইস্যুতে দায়িত্বহীন মন্তব্য করে ও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে রাখতেন, বর্তমান সরকারের অনেক দায়িত্ববান ব্যক্তিকেও তেমন আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। এসব কারণে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঘিরে জনগণের মধ্যে ইতোমধ্যে এক ধরনের আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে বলা চলে।

সংবিধান বাতিল বনাম সংবিধান সংস্কার

বছরের শেষ দিকে এসে রাজনৈতিক অঙ্গনে সর্বাধিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে এই প্রশ্নÑ জুলাই-আগস্টের ঘটনাপ্রবাহকে কোন প্রকরণে ফেলা হবে? কেউ কেউ এটিকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করতে চাইলেও প্রথম থেকেই সাধারণ জনতার কাছে এই ঘটনাপ্রবাহ বিবেচিত হয়ে আসছে ‘গণঅভ্যুত্থান’ হিসেবে। এই আন্দোলনে যুক্ত একাংশ বছরের শেষ প্রান্তে এসে এটিকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রদান করতে চলেছেন। যদিও এ আন্দোলনের সাবেক গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাতসহ অনেক সংগঠকই এটিকে ‘বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করার বিরোধিতা করছেন।

সর্বাধিক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে ‘সংবিধান’ও। রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে যারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করে আসছেন তারা শুরু থেকেই সংবিধান সংস্কারের কথাও বলে আসছেন। গণঅভ্যুত্থানের পর এই দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে এবং সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশনও গঠিত হয়। সরকারের প্রজ্ঞাপিত গেজেট অনুযায়ী গত ৬ অক্টোবর গঠিত কমিশনটি সংবিধান পর্যালোচনা ও মূল্যায়নের পর সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ করবে। এদিকে এর পরের মাস নভেম্বরেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কের পক্ষ থেকে পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়, যার প্রথম দফা দাবিই হলো ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিল। লাখ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত মুক্তিযুদ্ধের পথ বেয়ে পাওয়া এই সংবিধানকে সংগঠনটির পক্ষ থেকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘মুজিববাদী সংবিধান’ হিসেবে। বলা হচ্ছে, ‘ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নাৎসি বাহিনীর মতো অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করা হবে। এই লেখা যেদিন প্রকাশিত হচ্ছে, সেদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ ঘোষণার কথা রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গত ২৯ ডিসেম্বর জানানো হয়েছে, জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা একটি বেসরকারি উদ্যোগ। এটার সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো সম্পর্ক। এ বক্তব্য নিয়েও দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেননা, উপদেষ্টা পরিষদে বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা রয়েছেন, যাদের সঙ্গে ওই সংগঠনের সুস্পষ্ট সম্পর্ক ছিল বা নানা মাত্রায় এখনও রয়েছে।

প্রসঙ্গত, বাহাত্তরের সংবিধান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সমালোচনা রয়েছে। যখন সরকারে যে রাজনৈতিক দল থাকে, সেই দল ছাড়া সকলেই বিশেষত এ সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর নিরঙ্কুশ ক্ষমতার ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাহীনতার সমালোচনা করে থাকেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কাটাছেঁড়াও শুরু থেকেই সমালোচিত হয়ে আসছে। কিন্তু সংবিধানে একটি নতুন সংস্কার আনার মাধ্যমেই এর সমাধা সম্ভব। এমন প্রেক্ষাপটে তাই সংবিধানের ‘কবর’ রচনার মতো বক্তব্যকে মূলত একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তির বক্তব্য হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। যার ফলে শেষ পর্যন্ত সংবিধানকে ঘিরে একাত্তরপূর্ব পাকিস্তান পর্যায়ের মতোই সাংবিধানিক সংকট দেখা দিতে পারে।

পররাষ্ট্র, অপপ্রচার ও শেখ হাসিনা প্রত্যর্পণ

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের বিশেষ ভাবমূর্তির কারণে এবং সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে পশ্চিমা শক্তির কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথম থেকেই তেমন কোনো নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে সেখানে অবস্থান করায় বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এখনও নানা দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘গণহত্যা’র দায়ে শেখ হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারত সরকারের কাছে তাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে। কিন্তু দুই দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকার পরও এক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতির আশা আছে বলে মনে হচ্ছে না। এমনকি সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও গত ২৯ ডিসেম্বর সেরকম ইঙ্গিতই দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, দুই দেশের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ যেকোনো অনুরোধ এই চুক্তির আওতায় বিবেচিত হবে না, আর ভারত এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রকৃতির’ অনুরোধ হিসেবেই বিবেচনা করবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত থেকে অনেকেই মনে করছেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। অন্যদিকে, সাম্প্রদায়িক হামলার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি, ভারতে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানো, সীমান্তে বিএসএফের বিতর্কিত ভূমিকা, সেভেন সিস্টার্স ইস্যু, ভিসা প্রদান ইস্যু ইত্যাদি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কেও ফাটল দেখা দিয়েছে। ভারতের বিশেষত কয়েকটি গণমাধ্যমের ভূমিকায় অনেকের মধ্যেই দেখা দিয়েছে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এবং বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক হামলার সূত্রে ভারতের মূল ধারার বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপতথ্য ছড়াতে থাকেন। তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে অপতথ্যের প্রবাহের পরিসংখ্যান’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে দেখায় যে, অপতথ্যের প্রবাহ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। আর তা ছড়াচ্ছে বিশেষত ভারতের গণমাধ্যম থেকে। ফলে ভারতবিদ্বেষও বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাড়ে আগের চেয়ে। তবে গত ৯ ডিসেম্বর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের পর দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত মিলছে বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা।

বছরের একেবারে শেষ দিকে গত ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে হোয়াইট হাউস থেকে ফোনালাপ করেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেইক সুলিভান। সরকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সকল ধর্মাবলম্বীসহ নাগরিকদের নিরাপত্তা দেখতে চায়।

রাজনীতির মেরুকরণ ও জামায়াতে ইসলামী ইস্যু

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভবান মনে হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীকে। জুলাই আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে গত ১ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার এই দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দীর্ঘদিন এ রাজনৈতিক দলটি নিষিদ্ধ করার দাবি থাকলেও এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেটি বাস্তবায়ন করায় জনগণ এ সিদ্ধান্তকে দেখে সংশয় ও সন্দেহের চোখে। তবে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত ২৮ আগস্ট সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। তবে এর আগেই যেভাবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিত্বকে সরকারি পর্যায়ে গ্রহণ করা হতে থাকে, সেটিকেও জনগণ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রথম পর্যায়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত মিললেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে বর্তমানে তাদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ছে বলেই মনে হয়। গত ২৩ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা বলেছেন, ‘দেশে পরীক্ষিত দুটি দেশপ্রেমিক শক্তি আছে; এর একটি সেনাবাহিনী আরেকটি জামায়াতে ইসলামী।’ এ বক্তব্যের পর দেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের পর জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি দলের ‘আওয়ামী লীগকে ক্ষমা করে দিলাম’ জাতীয় বক্তব্যও অনেকের কাছে মনে হয়েছে অতিশয়োক্তি ও ঔদ্ধ্যতপূর্ণ।

পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মুক্তি ঘটেছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার, মামলা এবং শাস্তি থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে তাকে। বিএনপির অপর নেতা তারেক রহমানের মামলাও প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে জোরেশোরে অংশগ্রহণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অভ্যুত্থানের পর জাতীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হবে, এ দলের ভবিষ্যৎ-ই বা কী, তা নিয়েও রয়েছে নানা মুনির নানা মত। প্রসঙ্গত, ধর্মনিরপেক্ষতাই বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ধারা। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই আওয়ামী লীগ কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে সরে আসছিল। যার ফলে দলটির অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতে বা আগামী নির্বাচনের আগেই ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নতুন কোনো শক্তিশালী দল গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকেও এক্ষেত্রে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

নির্বিচার হত্যা : তদন্ত, মামলা ও বিচার কার্যক্রম

জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরতে ও বিচারকার্য পরিচালনার জন্য সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে (আইসিটি) পুনর্গঠিত করেছে। তবে বেশ কয়েক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও এ অভ্যুত্থানে হতাহতের চালচিত্র যথাযথভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনটির বিভিন্ন সংগঠকের বক্তব্য অনুযায়ী, এ সময় দুই হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা শহীদ হয়েছে। সংগঠনটির স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটি জানিয়েছে, আন্দোলনে নিহত হয়েছে ১৫৮১ জন। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) এ অভ্যুত্থানে ৭১৭ জন নিহতের তালিকা প্রকাশ করেছে। সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর এ আন্দোলনে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের প্রথম ধাপের একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’। তালিকায় রয়েছে ৮৫৮ জন নিহত এবং সাড়ে ১১ হাজার আহত ব্যক্তির নাম।

এই আন্দোলন ও অভ্যুত্থানকালীন সময়ের হত্যাকাণ্ড ও সহিংস ঘটনাগুলো সম্পর্কেও অবশ্য সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত রয়েছে। যা জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টিও করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ১৪ অক্টোবর জানিয়েছে, গণঅভ্যুত্থানকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেসব ছাত্র-জনতা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে তাদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনার জন্য কোনো মামলা করা যাবে না। তাদের গ্রেপ্তার বা হয়রানিও করা যাবে না।

গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও নেতার নামে। দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল থেকে শেখ হাসিনার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। বছরের শেষ প্রান্তে এসে গত ২৮ ডিসেম্বর সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এক সংলাপে অংশ নিয়ে জানান, আগামী বিজয় দিবসের আগেই জুলাই-আগস্টে সংঘটিত ‘গণহত্যা’র বিচারকাজ সম্পন্ন হবে। একই অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামও জানান, ট্রাইব্যুনালে প্রধান অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সবার বিচারই আগামী এক বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আহ্বানে জুলাই-আগস্টে হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তদন্তে পরপর দুবার ঢাকা এসেছে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী দল। প্রথমে এসেছে আগস্টের শেষ দিকে, পরে আবার সেপ্টেম্বরে। এ তদন্ত দল অনুসন্ধান করছে বাংলাদেশে ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাগুলো। জাতিসংঘের স্বীকৃত পদ্ধতি অনুযায়ী সরকারের কাছে মোট ১৬ ধরনের তথ্য চেয়েছে এ দল। প্রথমবার গত ১২ সেপ্টেম্বর দলটি ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তথ্য দিতে বলে। সরকার এতে ব্যর্থ হওয়ায় অক্টোবরে পুনরায় তারা এক চিঠিতে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু তাতেও ব্যর্থ হয়েছে সরকার। যদিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দাবি করছে, জাতিসংঘকে সম্প্রতি তথ্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কবে দিয়েছে, কী কী তথ্য দিয়েছে, সে ব্যাপারে কেউ মুখ খুলছেন না। জাতিসংঘের এই তদন্ত দল তথ্যানুসন্ধানের স্বার্থে একাধিকবার দেশের বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করারও অনুরোধ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু তাতে কোনো সাড়া মেলেনি। তবে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশে আসার পর এ তদন্ত দলটি চার সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন জেলা সফর করে মাঠপর্যায় থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। জাতিসংঘের এই তথ্যানুসন্ধান আগামী দিনের রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

নানারকম মত বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া থাকলেও এতে কোনো সংশয় নেই যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন আশাবাদের জন্ম দিয়েছে। আবার তেমনি তা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের আশঙ্কাও তৈরি করেছে। সামনের দিনগুলোয় রাজনৈতিক দল ও শক্তিগুলোর মেরুকরণই বলে দেবে, এ অভ্যুত্থানের ফলে জনগণের মুক্তির পথ কতটুকু প্রশস্ত হয়েছে, রাজনীতি কতটুকু ইতিবাচক হয়ে উঠেছে।

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মোরছালীন বাবলা

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা