ফারুক আহমাদ আরিফ
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:৪৫ এএম
টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ প্রতিনিয়তই বাড়ছে। যেমন, কোনো একজন ব্যক্তি হয়তো একাধিকবার পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। আবার বাধা দিলে বিক্রেতাকে দেওয়া হচ্ছে হুমকি। এতে করে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকে পণ্য বিক্রির কার্যক্রম সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে এসব চিত্র দেখা গেছে।
গত ২০ নভেম্বর থেকে তেল, চাল ও ডালের সঙ্গে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রিও শুরু করে টিসিবি। নিত্যপ্রয়োজনীয় এসব পণ্য কিনতে ভিড় করেন স্বল্প আয়ের মানুষ। তবে প্রথম দিন অনেকেই পণ্য পাননি। এতে ক্রেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এদিন বেলা ৩টায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ পাশে ট্রাক সেলে দেখা যায় অসংখ্য মানুষের জটলা। পণ্য বিক্রিতে হট্টগোল ও বিশৃঙ্খলাও চোখে পড়ে। কিছু সময়ের জন্য বিক্রি বন্ধও রাখা হয়। মুস্তাফিজুর রহমান নামে এক ক্রেতা বলেন, ৪ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি, লাইন সামনে আগায় না। বাইরে থেকে লোকজন এসে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। অথচ যারা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তারা পণ্য পাচ্ছে না। অজিত কুমার নামের অপর ক্রেতাও একই অভিযোগ করেন।
সকালে এসে বেলা সোয়া ৩টা পর্যন্ত পণ্য কিনতে পারেননি নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সকালে লাইনে দাঁড়িয়েছি, কিন্তু পণ্য পাচ্ছি না। লাইনের বাইরে থেকে লোকজন এসে পণ্য নিয়ে যাচ্ছে। এরা পরিচিত লোকদের আগে পণ্য দেয়। আমরা লাইন ধরেও পাচ্ছি না।
উল্লেখ্য, টিসিবির ট্রাক সেলে প্রতি লিটার ১০০ টাকা করে জনপ্রতি দুই লিটার সয়াবিন তেল, প্রতি কেজি ৬০ টাকা করে দুই কেজি মসুর ডাল, ৩০ টাকা কেজি দরে ৫ কেজি চাল এবং কেজি ৪০ টাকা করে ৩ কেজি আলু বিক্রি করা হচ্ছে। এতে মোট ৫৯০ টাকায় ৪টি পণ্য মিলছে। তবে এসব পণ্য কেনার জন্য প্রতিটি জায়গায় দীর্ঘ সারি চোখে পড়লেও ঘাটতির কারণে তাদের সবাই পণ্য কেনার সুযোগ পান না।
ট্রাক সেলের বিক্রেতা রুবেল রাব্বি বলেন, তেল, চাল ও ডালের সঙ্গে ৪০ টাকা ৩ কেজি করে আলুও দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে মানুষের ভিড় বেশি হচ্ছে। আমরা ৩৫০ জনের পণ্য পাই, কিন্তু মানুষ আসে ৬০০ থেকে ৭০০ জন। পরিমাণ না বাড়ালে সবাই পণ্য পাবেন না।
তিনি আরও বলেন, স্থানীয়দের অনেকেই লাইনে দাঁড়াতে চান না। তারা জোর খাটিয়ে পণ্য নিয়ে যান। আজকে আমার ৩ বোতল তেল নিয়ে গেছে। আগে ভোটার আইডি কার্ড বা রেশনিং কার্ড দিয়ে পণ্য দেওয়া হতো। তাতে বিশৃঙ্খলা কিছুটা কম হতো। এখন সেই নিয়ম না থাকায় একই লোক একাধিকবার এলেও আমরা বুঝতে পারি না।
এ সমস্যা সমাধানের জন্য অমোচনীয় কালি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে চান মিয়া নামে এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, শহরের মানুষকে তো চিনে রাখা যায় না। তাই কে কতবার পণ্য নিল তা বোঝা যাবে না। পণ্য দেওয়ার সময় যদি অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হয় তাহলে একজন একাধিকবার এলে ধরা পড়ে যাবে। তা ছাড়া টোকেন দেওয়ার সময় প্রথমে ৫০ জন করে ১০০ নারী ও পুরুষকে ভাগ করে দেওয়া যায়। এদেরকে দেওয়া শেষ হলে পরে আরও ১০০ জনকে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে দিলে প্রায় সবাই পণ্য পেতে পারে। এখন একবারে অনেক টোকেন দিয়ে দেওয়া হয়, এতে সমস্যা তৈরি হয়।
অনিশ্চিত অপেক্ষা
গত ২১ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টায় তেজগাঁওয়ের কলমিলতা বাজারের পাশের ফুটওভার ব্রিজের নিচে দেখা যায় ২০-২৫ জন নারী-পুরুষের জটলা। এরা বসিলা, মহাখালী ও বাসাবো থেকে এসেছেন টিসিবির পণ্য কিনতে। তাদের মধ্যে ফয়জুল হক নামে এক বয়স্ক ক্রেতা জানান, সকাল ৯টার দিকে তিনি এসেছেন। বেলা ১১টা বাজলেও টিসিবির গাড়ি দেখা যায়নি। বাসাবো থেকে ফরিদা আক্তার আরও সকালে এসে বসে আছেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত গাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এখানে গাড়ি আসবে এ বিষয়ে আপনারা নিশ্চিত কি না তা জানতে চাইলে ক্রেতারা জানান, গাড়ি আসবেই এমন খবর তাদের কাছে নেই। তারা মূলত এসে বসে থাকেন। কোনো দিন গাড়ি আসে, কোনো দিন আসে না। অনেক দিন এমন হয় যে তাদের খালি হাতেই ফিরতে হয়। সেদিনের টিসিবি তালিকা পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদক উপস্থিত লোকজনকে জানান, আজ এখানে কোনো গাড়ি বরাদ্দ নেই, পাশের সংসদ ভবনের সামনের এলাকায় গাড়ি আছে। তখন তারা সেদিকে পা বাড়ান।
হাতে লিখে দেওয়া হচ্ছে সিরিয়াল নম্বর
গত রবিবার দুপুরে সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের পাশে ট্রাকে পণ্য বিক্রি পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে কথা হয় লালবাগ থেকে আসা বরুণ কুমার ও প্রদীপ দাসের সঙ্গে। বরুণ জানান, তার এলাকায় পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি বন্ধুদের কাছে জেনেছেন সচিবালয় ও সেগুনবাগিচার আশপাশে পণ্য বিক্রি হয়। তাই এখানে এসেছেন। কেরানীগঞ্জ থেকে এসেছেন চান মিয়া। তিনি দুপুর পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছেন। এখানে দেখা যায়, দুজন নারী সিরিয়াল নিয়ে ঝগড়া করছেন। একপর্যায়ে ঝগড়া চুলোচুলিতে পরিণত হয়। উপস্থিত লোকজন ঝগড়া থামানোর চেয়ে বরং তা যেন উপভোগ করছিলেন। একপর্যায়ে বিক্রেতার ধমকে ঝগড়া থামে।
সেখানে হাতের মধ্যে নম্বর লিখে দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে বিক্রেতার সহকারী শাকিল হোসেন বলেন, কাগজে লেখা সিরিয়াল নিয়ে অনেকেই বাসায় চলে যায়। পরে তারা যখন এসে দেখায়, এটা তাদের সিরিয়াল তখন উপস্থিত অন্যদের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি হয়। তার চেয়ে হাতে লিখে দিই, সেই সিরিয়াল অনুযায়ী পণ্য দিই। এখানেও অনিয়ম হয়। কেউ কেউ নিজেই নম্বর লিখে নিয়ে আসে।
এদিন সাফওয়ান ট্রেডার্সের হয়ে পণ্যগুলো বিক্রি করছিলেন ম্যানেজার ফারুক আহমেদ। তিনি বলেন, আমরা এসেই প্রথমে হাতে কলম দিয়ে সিরিয়াল লিখে দিই। তারপর মোবাইলে ভিডিও করি। এরপর পণ্য দেওয়া শুরু করি। এতে কিছুটা অনিয়ম ঠেকানো যায়।
পণ্য পাওয়ার জন্য সকাল ৭টায় ট্রাক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন মেসার্স শহীদুল্লাহ ট্রেডার্সের মালিক মো. শহীদুল্লাহ। গত সোমবার তার পণ্য বিক্রি করার কথা ছিল কারওয়ান বাজারে ওয়াসা ভবনের পাশে। দুপুর পৌনে ২টায় তার মোবাইলে কল দিলে তিনি বলেন, দেড়টার দিকে মাল পেয়েছি। আসতে ১০-১৫ মিনিট লাগবে। সোয়া ২টা থেকে তিনি পণ্য দেওয়া শুরু করেন। প্রতিবেদকের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পণ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে এক দিন আগে টিসিবির হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তালিকা দেওয়া হয়। পরের দিন টাকা জমা দিতে হয়। তৃতীয় দিন পণ্য পাওয়া যায়। সাড়ে তিনশ মানুষকে পণ্য দিতে হলে ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জমা দিতে হয়।
সপ্তাহে কতদিন পণ্য বিক্রি করতে পারেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে কোনো নিয়ম নেই। কর্তৃপক্ষ যাকে যতদিন খুশি পণ্য দিতে পারে। তিনি বলেন, যদি একটা নিয়ম করা হতো একেকজন ব্যবসায়ী সপ্তাহে ২-৩ দিন পণ্য পাবেন তাহলে ভালো হতো।
পণ্যবোঝাই ট্রাক প্রগতি ইন্স্যুরেন্সের পূর্ব পাশে এসে দাঁড় করালে দেখা যায় অনেক ক্রেতার ভিড়। তাদের বেশিরভাগই নারী। এসব ক্রেতার মধ্যে পূর্ব নাখালপাড়া থেকে আসা রাশেদা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। রাশেদা বলেন, আমার বাসার পাশেই টিসিবির গোডাউন। সেখানে গিয়ে জেনেছি আজ কারওয়ান বাজারে পণ্য দেওয়া হবে। সকাল ১০টায় এসে অপেক্ষায় আছি। গাড়ি এসেছে ২টার সময়। কখন বাসায় যাব বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, এসব পণ্য মহল্লার দোকানগুলোতে দিয়ে মানুষ ভাগ করে কার্ড দিলে এত সময় নষ্ট হতো না। এক দিন পণ্য কিনতে এলে সারাটা দিন নষ্ট হয়ে যায়।
গত মঙ্গলবার যাত্রাবাড়ী থেকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের পাশে পণ্য কিনতে আসেন মফিজুল হক। দুপুর সাড়ে ১২টায় তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, দেড় ঘণ্টা যাবৎ লাইন ধরে রেখেছি। তবে এখানে সিরিয়াল কম। সেগুনবাগিচা থেকে আসা আব্দুস সালাম বলেন, তুলনামূলকভাবে এখানে বিশৃঙ্খলা কম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আকবর এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা খুরশেদ আলম বলেন, আমরা প্লাস্টিকের নম্বরযুক্ত কার্ড দেই। তারপরও পণ্য বিক্রিতে বিশৃঙ্খলা হয়। আমাদের পর্যাপ্ত মাল থাকার পরও মানুষ ঝগড়া করে।
আগে থেকে বিক্রির স্পট জানানো হয় না যে কারণেÑ
কবে কোথায় ট্রাকে পণ্য বিক্রি হবে সে তথ্য আগেভাগে না জানানোর কারণে দূর-দূরান্ত থেকে এসেও পণ্য না পেয়ে ফিরে যেতে হয় অনেক ক্রেতাকে। এর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে টিসিবির আঞ্চলিক কার্যালয়ের যুগ্ম পরিচালক ও মুখপাত্র মো. হুমায়ুন কবির বলেন, ইতঃপূর্বে আমরা এক দিন আগেই টিসিবির ওয়েবসাইটে কোন এলাকায় গাড়ি যাবে তা জানিয়ে দিতাম। এতে দেখা গেছে, একই ব্যক্তি বারবার পণ্য নিয়ে যান। তাদের জন্য অন্য ক্রেতারা পণ্য পান না। এজন্য আর আগে থেকে এলাকা জানানো হয় না। আমরা যেসব স্থানে গাড়ি পাঠাই সেখানকার স্থানীয় বা আশপাশের লোকজন যাতে পণ্য কিনতে পারেন, এজন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঢাকার ১৭০টি স্থানের মধ্যে প্রতিদিন ৫০টি স্থানে পণ্য দেওয়া হয়। ১৩ থেকে ১৫টি স্থানে হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খলা হওয়ায় সেসব স্থান বদল করা হয়েছে। প্রত্যেক ডিলার যাতে নিয়মিত পণ্য পায় সেজন্য তাদের নিয়ে সিরিয়াল করা হয়।
জনবল সংকটে টিসিবি
নাম না প্রকাশের শর্তে টিসিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, মুক্তবাণিজ্য চুক্তির কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। ১৯৮৬ সালে আমাদের জনবল ছিল ১ হাজার ৩০০। বর্তমানে জনবল আছে মাত্র ১৪৬ জন। প্রধান কার্যালয় ছাড়াও সারা দেশে আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে ১৪টি। এ ছাড়া সারা দেশের ৮ হাজার ২৫০ ডিলারের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিজস্ব চারটি ও ভাড়ায় ১১টি গুদামে পণ্য মজুদ করছে সংস্থাটি। এত অল্প লোক দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছে।
১৯৭২ সালে টিসিবি গঠনকালে কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটাবে ও প্রয়োজনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করবে। কিন্তু মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে টিসিবিকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে টিসিবির আইন পরিবর্তনের আহ্বান জানান ওই কর্মকর্তা।
স্বেচ্ছাসেবক দেবে ক্যাব
ভোটার আইডি ও রেশনিং কার্ড দেখিয়ে আগে পণ্য কেনা হতো। তাতে একই ব্যক্তি একাধিকবার পণ্য নিতে পারত না। বর্তমানে সে নিয়ম নেই। কী করলে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করা যাবে তা জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, এক্ষেত্রে নাগরিক সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ যে এলাকায় পণ্য বিক্রি হবে সেখানকার স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা নেওয়া দরকার। তারা ট্রাকের কাছে গিয়ে একটি তালিকা করবে। সেই অনুযায়ী পণ্য বিক্রি হবে। সমাজে অসংখ্য মানুষ আছে যারা এ ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তাদের সহযোগিতা নিতে হবে। তা ছাড়া সরকার চাইলে ক্যাবের সদস্যরাও প্রতিটি বিক্রয় স্থানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করবে। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে আমরা প্রতিটি ট্রাকে স্বেচ্ছাসেবক দিতে রাজি আছি।