শুভ জন্মদিন
সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রকাশ : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৩৮ এএম
আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১১:৪০ এএম
নিজরে আঁকা শিল্পকর্মের সামনে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের শিল্পজগতের মহীরুহ, মুক্তচিন্তার প্রতীক রফিকুন নবী। ‘রনবী’ নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। আজ ২৮ নভেম্বর ৮১ বছরে পা দিলেন বরেণ্য এই শিল্পী। শুভ জন্মদিন, শিল্পী রনবী।
শুধু একজন চিত্রশিল্পীই নন, রনবী একজন শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক ও কার্টুনিস্ট। সময়ের এই সাহসী পর্যবেক্ষক তার সৃষ্টিতে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজ, রাজনীতি এবং মানবজীবনের গভীর বাস্তবতা।
রফিকুন নবী জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ২৮ নভেম্বর লালমাটির বরেন্দ্রভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে। বাবা রশীদুন নবী ছিলেন পুলিশ অফিসার এবং মা আনোয়ারা বেগম ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। বাবার বদলি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জনপদে কেটেছে তার শৈশব। ফলে শৈশবেই তিনি সুযোগ পেয়েছেন এ দেশের প্রকৃতি ও বৈচিত্র্যময় জনজীবনকে কাছ থেকে দেখার। এই অভিজ্ঞতা তার শিল্পীসত্তার বিকাশেও বড় ভূমিকা রেখেছে।
রফিকুন নবীর চিত্রকর্মে প্রকৃতি, মানুষ এবং গ্রামীণ জীবনের অন্তর্গত সৌন্দর্য মূর্ত হয়ে ওঠে। নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, পশুপাখি এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাপন তার ছবিতে অনন্যরূপে ধরা পড়ে। তার প্রথম দিকের কাজগুলোতে রয়েছে জলরঙের অসাধারণ ব্যবহার; যেখানে নদী, নৌকা, খোলা আকাশ এবং প্রকৃতির প্রশান্তির গভীর প্রকাশ ঘটেছে।
পরবর্তী সময়ে তেলরঙ ও অ্যাক্রিলিকের মাধ্যমে রনবী তার সৃষ্টিতে আরও শক্তিশালী বার্তার প্রকাশ ঘটান। তার ছবিতে রঙ, রেখা এবং আকারের মধ্য দিয়ে কায়িক শ্রমে আনন্দিত মানুষের সংগ্রাম ও বিশ্রামের মুহূর্তগুলো ফুটে ওঠে। মহিষ ও ছাগল তার ক্যানভাসে বারবার ফিরে আসা অনুষঙ্গ। এগুলো শুধু প্রকৃতির অংশ নয় বরং বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট এবং তাদের সঙ্গে প্রাণিকুলের নিবিড় সম্পর্কের প্রকাশ।
রফিকুন নবীর সৃষ্টিযজ্ঞের অন্যতম সংযোজন হলো তার বিখ্যাত কার্টুন চরিত্র ‘টোকাই’, যা ১৯৭৮ সালে প্রথম প্রকাশ পায়। টোকাই সমাজের নিম্নবর্গের প্রতিনিধিত্বকারী অবহেলিত শিশু, তবে তার দৃষ্টিভঙ্গি ব্যতিক্রমী এবং গভীর। এ কার্টুনের মাধ্যমে রফিকুন নবী সমাজ ও রাজনীতির সমালোচনায় সাহসী ভূমিকা পালন করেন। টোকাইয়ের কৌতুক ও ব্যঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকে গভীর বার্তা, যা ক্ষমতাসীন শাসকদের অন্যায়, দুর্নীতি এবং সমাজের ত্রুটিগুলোকে বিদ্রূপ করে। সে সমাজের অনাচার ও অবিচারের তীব্র সমালোচক এবং তার কৌতুকপ্রবণ মন্তব্যে মানুষের মনে নতুন চিন্তার খোরাক জোগায়। টোকাই এক অর্থে জাগ্রত বিবেক, যে বাস্তবতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সদা প্রতিবাদী। বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যে এমন চরিত্র এর আগে দেখা যায়নি। তাই তো টোকাই শুধু কার্টুন নয়, বরং বাংলার শিল্প-ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়।
রফিকুন নবী তার সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেন। কামরুল হাসান, জয়নুল আবেদিন, এবং কাইয়ূম চৌধুরীর মতো গুণী শিল্পীদের সান্নিধ্যে তিনি নিজস্ব একটি শিল্পভাষা তৈরি করেন, যা আজও অনন্য। তার চিত্রকলায় একধরনের ইতিবাচকতা ও জীবনের প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়। তিনি কখনও দুঃখকে প্রশ্রয় দেননি। বরং তার সৃষ্টিতে আনন্দ, উল্লাস এবং জীবনের সৌন্দর্য উদযাপিত হয়। একই সঙ্গে তার চিত্রকর্মে প্রতিবাদও প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে শিল্পীর আশাবাদী মন রঙ-রেখা-ফর্মে রঙিন করে তুলেছে বর্গাকার ক্যানভাস। সামাজিক ও রাজনৈতিক চেতনা রফিকুন নবীকে সাম্যবাদী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী করে তুলেছে এবং তিনি তার সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে মানুষের মুক্তি কামনা করে চলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ (তৎকালীন ঢাকা আর্ট কলেজ) থেকে চিত্রকলায় উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের পর সারাটা জীবন কাটিয়েছেন চারুকলা অনুষদের শিক্ষক হিসেবে। শুধু আঁকার কৌশল নয়, একই সঙ্গে তার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে শিল্প-মন গড়ে দিয়ে অবদান রেখেছেন শিল্পের সৃজনশীলতার ধারাবাহিক বিকাশে।
রফিকুন নবী শুধু একজন শিল্পী নন, বরং বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির এক অনন্য পথিকৃৎ। তার সৃষ্টি আমাদের শেখায় কীভাবে জীবনের সুন্দরকে উপলব্ধি করতে হয়, সমাজকে নতুন দৃষ্টিতে দেখতে হয়। তার টোকাই চরিত্র এবং নিসর্গের প্রতি ভালোবাসা আমাদের শিল্পচর্চায় নতুন দিশা দেখিয়েছে।
এই ৮১ বছরে এসে রফিকুন নবী জীবনবাদী, সাহসী এবং মানবিক চেতনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার সৃষ্টিকর্ম এবং ভাবনা শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয় বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও এক অনন্য অনুপ্রেরণা।