পারভেজ খান
প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ০৯:৪৮ এএম
আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৪৪ পিএম
পরিবারের সঙ্গে রাজীবুল আলম ভুইয়া ওরফে রাজীব। ছবি : সংগৃহীত
২৭ নভেম্বর, ২০০৮। ১৬ বছর আগের এক রাত। সময় আনুমানিক ৯টা। রাজধানীর ডেমরার পশ্চিম টেংরা ক্যানেলপাড় এলাকার প্রধান সড়ক ধরে রিকশায় যাচ্ছিলেন দুই যুবক। বড়ভাঙ্গা ক্যানেলপাড় আনোয়ার ভিলার কাছে সেই রিকশার গতিরোধ করে ১০ জন অস্ত্রধারী। কারও হাতে পিস্তল, কারও হাতে রিভলবার। আবার কেউ ধরে আছে ধারালো দেশীয় অস্ত্র। অস্ত্রের মুখে রিকশায় বসে থাকা দুই যুবককে টেনে নামানো হলো। নিয়ে যাওয়া হলো পাশের গলিতে। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। ছিনিয়ে নেওয়া হলো দুজনের হাতে থাকা মোবাইল ফোন। এরপর তাদের একজনকে হাত-পা বেঁধে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে ফেলা হলো। মুখের ভেতর গুঁজে দেওয়া হলো গামছা। সবই ঘটছে বিদ্যুৎগতিতে। ধারালো কিছু দিয়ে এক ঝটকায় তুলে ফেলা হলো ওই যুবকের একটি চোখ। চিৎকার করে উঠলেন মাটিতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত যুবক। মুখে গামছা থাকায় শব্দ বের হলো না। এই দৃশ্য দেখে প্রাণভয়ে ছুটে পালানোর চেষ্টা করলেন অপর যুবক। কিন্তু পারলেন না। তাকে আবার ধরে আনা হলো। বন্ধুর অবস্থা দেখে তখন জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা তার। এবার তার সামনেই বাকি চোখটিও উপড়ে ফেলা হলো প্রথমজনের। পা বাঁধা কোরবানির পশুর মতো মাটিতে দাপাতে থাকলেন তিনি। অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ঘটনাটি দেখছিলেন কয়েকজন। কিন্তু ভয়ে কেউই এগিয়ে আসেননি। এরই মধ্যে একজন চিৎকার করে বললেন, র্যাবকে খবর দাও, ফোন কর। অস্ত্রধারীরা তখন প্রস্তুতি নিচ্ছিল রক্তাক্ত যুবককে পাশের ডোবায় ফেলে দেওয়ার। কিন্তু ‘র্যাব’ শব্দটি শুনে থেমে যায় দুর্বৃত্তরা। দ্রুত পালিয়ে যায় ঘটনাস্থল থেকে। এরপর ছুটে আসেন এলাকাবাসী। তাদের ফোন পেয়ে আসে র্যাব-১০ এর একটি দল। আহত যুবককে নেওয়া হয় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানান, তার দুটি চোখ এমনভাবে উপড়ে ফেলা হয়েছে, এতে করে ভবিষ্যতে আর সেটা প্রতিস্থাপনও সম্ভব নয়। চিরদিনের মতো চোখের আলো নিভে যায় টগবগে সেই যুবকের। তার নাম রাজীবুল আলম ভুইয়া ওরফে রাজীব। পেশা ব্যবসা। স্নিগ্ধা মাল্টিপারপাস নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। ছিল ইট-বালুর ব্যবসা, কয়েকটি টেম্পো আর মাছের খামার।
প্রতিবেদনে এবার যার কথা আসছে তিনি কলেজছাত্রী রীতা নাহার। রাজীবদেরই প্রতিবেশী। রাজীব ভালোবাসেন রীতাকে। রাজীবকে ঘিরে তার হৃদয়ে স্বপ্ন ছিল অনেক। রাজীবকে এলাকার সবাই ডাকত বোম্বের নায়ক বলে। এতটাই সুদর্শন তিনি। রীতা ভাবতেনÑ বিয়ের পর রাজীবকে নিয়ে যখন ঘুরতে বের হবেন, তখন সবাই তাদের দিকে তাকিয়ে বলবেÑ ‘ওই দেখো, বউ নিয়ে আমাদের নায়ক যাচ্ছে।’ কিন্তু ২৭ নভেম্বর রাতের সেই নৃশংসতা নিমেষে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলো রীতার। মা-বাবা, পরিবারের অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী সবাই রীতাকে নিষেধ করলেন রাজীবের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে। রাজীবের জীবন থেকে তাকে সরে যেতে বলা হলো। তাদের ভাষায়Ñ আর যাই হোক তার মতো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক ছাত্রী একজন ‘অন্ধ’কে জেনেশুনে বিয়ে করতে পারে না? কিন্তু রীতা তার নিজের অবস্থানে অনড়। তিনি বললেন, ‘এখন এ রকম একজন অসহায় মানুষকে ফেলে রেখে সরে যাওয়ার সময় নয়। বরং আমি যে রাজীবকে সত্যিকার অর্থেই ভালোবাসি সেটা প্রমাণ করার সময়।’ আর তাই সব বাধা উপেক্ষা করে ওই ঘটনার মাত্র দুই সপ্তাহ পর, ১৪ ডিসেম্বর তিনি বিয়ে করেন রাজীবকে। স্ত্রী হয়ে দাঁড়ান অসুস্থ ও দৃষ্টিশক্তি হারানো রাজীবের পাশে। একই সঙ্গে শপথ নেন, নিজেকে আইনজীবী হিসেবে গড়ে তুলবেন। তারপর লড়াই করবেন স্বামীর ঘটনায় দায়ের করা মামলা নিয়ে। বর্তমানে ১৬ বছর চলছে ওই ঘটনার। সিনিয়র আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে লড়াই করছেন রাজীবের আদরের ‘বউমণি’ অ্যাডভোকেট রীতা নাহার।
মামলা নিয়ে রীতার ১৬ বছরের লড়াই আর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরার আগে সংসার জীবন নিয়ে রীতা-রাজীবের কিছু অনুভূতি তুলে ধরা যাক। গত বুধবার আলাপচারিতার সময় এই প্রতিবেদককে রাজীব বললেন, ‘যখন স্বাভাবিক ছিলাম তখন রীতাকে যেভাবে পেয়েছি এখন তারচেয়ে বেশি আপন করে পাই। সে আমাকে আগলে রেখেছে। আমি কখনও নিজেকে অভাগা মনে করি না। আমার চোখ নেই, তাতে কী? অন্ধত্ব নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই। আমি বরং নিজেকে পৃথিবীর সেরা সৌভাগ্যবান বলে মনে করি। আল্লাহ আমাকে এ রকম একজন স্ত্রী উপহার দিয়েছেন। ওর চোখ দিয়েই আমি সবকিছু দেখতে পাই।’
স্বামী সোহাগী রীতা বললেন, ‘আজ যখন রাজীবকে নিয়ে রাস্তায় বের হই, অনেকেই বলে ওই দেখÑ অন্ধের বউ যায়, কানার বউ যায়। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। এখন আর লাগে না। আমি মনে করি, রাজীব আমার জন্য আল্লাহর সেরা উপহার। ওর মতো এত সুন্দর একটা মন কারও থাকতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। অনেক সুখে আছি। ও আমাকে আদর করে বউমণি বলে ডাকে। এরপরও মাঝে মাঝে খারাপ লাগে কিছু ঘটনায়। রাতে ওর কখনও ঘুম ভেঙে গেলে বলে ওঠে, বউমণি একটু লাইটটা জ্বালাও। পরে নিজেই ভুল বুঝতে পেরে সামলে নেয়। আমিও নিজেকে সামলে নিই এটা ভেবে যে, পৃথিবীর সব আলো তার সামনে জ্বেলে দিলেও কোনো লাভ নেই। ও’ বলে, আলোর কী দরকার? আমিই নাকি তার জীবনের আলো। আমার কষ্ট একটাই। যে কষ্ট বুকে নিয়েই ওই ঘটনার দুই বছর পর রাজীবের বাবা মারা যান। পুলিশ বিভাগে গাড়িচালকের চাকরি করতেন তিনি। কষ্টটা হচ্ছে, এখনও সন্ত্রাসীদের বিচার হয়নি। তবে আমি আশাবাদী, সৃষ্টিকর্তা যখন আমকে এতটা ভালোবাসা দিয়েছেন, নিশ্চয়ই তিনি অপরাধীদের সাজাও দেবেন। সেই আশাতেই নীরব কান্না বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখে এক বুক আশা নিয়ে অপেক্ষায় আছি আমি, রাজীবসহ পরিবারের সব সদস্য। বিচারের প্রত্যাশা আমাদের সবার মাঝেই নিভৃতে কাঁদছে।’
ওই রাতের নৃশংস ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রাজীব জানান, তার ওপর হামলাকারীদের সবাই তাদের এলাকা ও আশপাশের। ওরা চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসায়ী। এদের মাদক ব্যবসা আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রায়ই প্রতিবাদ করতেন তিনি। পুলিশকে খবর দিয়ে ওই সিন্ডিকেটের কয়েকজনকে ধরিয়েও দেন। আর এসব কারণে প্রতিশোধ নিতেই তারা এই ঘটনা ঘটায়। ওইদিন তাদের অস্ত্রের মুখে গতিরোধ করে মাদক ব্যবসায়ী নাসু, তপন, দীন ইসলাম, রোমেল, বিজয়, ইকবাল, রাশেদ, রাজিব, রুবেল ও রিপন। জোর করে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে প্রথমে নাসু তার হাত-পা বেঁধে ফেলে। চিৎকার করলে তার মুখে গামছা ঢুকিয়ে দেয় রাজিব আর রোমেল। মাথা মাটিতে চেপে ধরে রাখে ইকবাল। তিনি কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিজয় ধারালো কিছু দিয়ে তার এক চোখ উপড়ে নিয়ে সেটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে। একইভাবে আরেক চোখ উপড় ফেলে রুবেল।
এরপর আর কী ঘটেছে সেটা আর তার দেখার কথা নয়। ওই ঘটনার পরদিন রাজীবের বাবা শাহ আলম বাদী হয়ে ডেমরা থানায় মামলা করেন। পুলিশ উল্লিখিত ১০ জনকে আসামি করে ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। এরপর গড়াতে থাকে দিন, দিন শেষে মাস, আর মাস শেষে বছর। আসামিদের রাজনৈতিক প্রভাবে আদালতে ফাইলবন্দি হয়ে থাকে মামলা। আদালত সমন জারি করলেও সেটা সাক্ষীদের কাছে পৌঁছে না। বাড়িতে অনেকটা গৃহবন্দি হয়ে থাকে রাজীবের পরিবার। বাড়ি থেকে বের হলেই খুন করা হবে বলে হুমকি আসে। সাক্ষীদেরও হুমকি দেওয়া হয়। রাজীবের পরিবার ও সাক্ষীদের কয়েকজন থানায় জিডিও করেছেন। কিন্তু আসামিরা সে সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এভাবেই চলতে থাকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত। বাদীপক্ষ আদালতে যেতে না পারায় আর সাক্ষীরা ঠিকমতো সমন না পাওয়ায় বিচারকাজ থমকে থাকে। এরই মাঝে রীতা হয়ে ওঠেন অ্যাডভোকেট রীতা নাহার। তার চেষ্টাতে এবং একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় আদালতের প্রসিকিউশন বিভাগের সমন জট খুলতে থাকে। ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে আদালত সাক্ষ্য নেয় রাজীবের। সাক্ষ্য দেওয়ার পরদিনই সন্ত্রাসীরা হামলা চালায় তাদের বাড়িতে। ভাঙচুর করা হয়। ততদিনে রীতা নাহারও আইনজীবী। তিনিও সব বাধা এড়িয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাদীপক্ষের হয়ে মামলার লড়াইয়ে নামেন সিনিয়র আইনজীবী হোসেন আলী খান।
২৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত আদালতে মাত্র ১২ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার সময় সঙ্গে থাকা রাজীবের সেই বন্ধু কৌশিক সরকার লিটনও। ওইদিন তাকেও মারধর করা হয়। আসামিদের মধ্যে নাসু, তপন, দীন ইসলাম, রোমেল ঘটনার পর থেকেই পলাতক। বিজয়, ইকবাল, রাশেদ, রাজিব ও রিপন জামিনে রয়েছে। দীন ইসলাম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। ২০১০ সালের ১৬ মার্চ র্যাবের ক্রসফায়ারে মারা যায় রুবেল। আসামিরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগ আর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ইকবাল ডেমরা থানার ৬৮ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি। এতদিন তারা প্রকাশ্যেই চলাফেরা করেছে। এমনকি প্রায়ই হুমকি দিয়ে গেছে রাজীব-রীতাকে। কিন্তু গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে। তাদের ৯ জনই এখন একাধিক হত্যা মামলার আসামি।