বিসিএস
ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৪ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৫ এএম
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছয়টি বিসিএস ক্যাডারে পুলিশে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের আমলনামা নতুন করে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিশেষ করে ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে আট তথ্যের সন্ধানে অধিকতর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে তদন্তের বিষয়ে সিদ্ধান্তের পর যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। যথাযথ ব্যবস্থা নিতে গত ২০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে পুলিশের বিশেষ শাখাকে (এসবি)। সে অনুযায়ী পুলিশের এসবি শাখা থেকে তাদের শিক্ষাজীবনের রাজনৈতিক দর্শন, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক তথ্য সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া শুরু হয়েছে।
শুধু তাই নয়, নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আরও চারটি বিসিএসে (৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম) নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের সম্পর্কেও খোঁজখবর নেওয়ার। নির্দেশনা অনুযায়ী পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায় কাউকে লিখিত বা মৌখিক পরীক্ষায় কোনো সুবিধা দেওয়া হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) মূল্যায়নের এ দায়িত্ব পেয়েছে। এ খবরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরির অপেক্ষায় থাকা প্রার্থীদের মধ্যে।
সূত্র জানায়, গত জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ২৮, ৩৫, ৩৬, ৩৭, ৪০ ও ৪১তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে। প্রশ্ন ওঠে তাদের রাজনৈতিক দর্শন ও আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে। এমন প্রেক্ষাপটে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ জানানো হয়। সে অনুযায়ী উল্লিখিত ছয়টি বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের আটটি তথ্য যাচাই-বাছাই (ভেরিফিকেশন) করা হবে। রাজনৈতিক পরিচয়, পারিবারিক তথ্য ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাজনীতিতে ভূমিকা ইত্যাদি পর্যালোচনা করে দেখা হবে। অন্তত সহকারী পুলিশ সুপার পদমর্যাদা রয়েছে, এমন কর্মকর্তাকে দিয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রেখে এ ব্যাপারে দ্রুত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে কর্মকর্তার নাম, জন্ম তারিখ, জাতীয় পরিচয়পত্র, সচল একাধিক ফোন নম্বর, ই-মেইল, ফেসবুক, টিআইএন নম্বর এবং পাসপোর্ট নম্বর সংযুক্ত করতে বলা হয়েছে। এদিকে যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে, তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে পুলিশ সুপার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার পদোন্নতি পেয়ে চাকরি করছেন। বিশেষ করে ২৮ ব্যাচের (২০১০ সাল) নিয়োগ পাওয়া পুলিশ কর্মকর্তারা এক যুগের বেশি চাকরি করে পুলিশ সুপার হিসেবে জেলায় পদায়ন হওয়ার প্রত্যাশায় ছিলেন। পুলিশ অধিদপ্তর থেকে পদায়নপ্রাপ্তদের খসড়া তালিকাও করা হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ২৮ ব্যাচসহ আরও ৫ ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। নতুন করে তদন্ত ও তথ্য যাচাইয়ের খবর ছড়িয়ে পড়ায় অন্য পাঁচ ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যেও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
কী আছে এসবির চিঠিতে
তদন্ত সংক্রান্ত এসবির চিঠিতে বলা হয়েছে, গোপনীয় প্রতিবেদনে কর্মকর্তা যে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন তার নাম, শিক্ষাবর্ষ ও অধ্যয়নের বিষয় এবং অবস্থান/আবাসিক হলের তথ্য দিতে হবে। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার তথ্য ছাড়াও প্রার্থী অন্য জেলায় অধ্যয়ন করে থাকলে সংশ্লিষ্ট জেলায় যোগাযোগ করে তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে। রক্ষিত মূল ভেরিফিকেশন নথি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম সংগ্রহ করে পুনরায় অধ্যয়নকালীন রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এছাড়া কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন করে বন্ধুর নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর, সংশ্লিষ্ট থানার রেকর্ড (সিডিএমএসের তথ্য) যাচাই করে দিতে হবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। প্রার্থীর রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি জঙ্গি বা মৌলবাদী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা সম্পর্কেও তথ্য দিতে হবে। প্রার্থী সম্পর্কে এলাকার স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং তার সমসাময়িক বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে জানাতে হবে।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এক যুগ আগে চাকরি পাওয়া কর্মকর্তাদের সম্পর্কে যাচাই-বাছাইয়ের উদ্দেশ্য কী? এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে যদি কাউকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়, তাহলে পরে আদালতে সিদ্ধান্তটি কতটা টিকবে বলা মুশকিল। তবে রাজনৈতিক পরিচয়ের প্রভাব খাটিয়ে চাকরি নিয়ে থাকলে অথবা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকলে, চাকরির আগে-পরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিয়ে থাকলে ব্যবস্থা নেওয়াই সমীচীন। এক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারে সরকার।’
সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র বলছে, মূলত বিগত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া’ ক্যাডার কর্মকর্তাদের খুঁজে বের করার কৌশল হিসেবেই এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিগত সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানাভাবে সাবেক সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমেও এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাভাবেই এই নেতাকর্মীরা সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) আনুকূল্য পেয়েছিলেন বলে চাউর রয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘনিষ্ঠরা মনে করছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিযোগও তুলেছে।
এ বিষয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেম প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এখনই এ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। কমিশন এখনও পূর্ণাঙ্গ হয়নি বলে অনেক সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা সম্ভব নয়। কমিশনের কোরাম ছাড়া সভা করা যাচ্ছে না। কমিশনের সভার কোরাম পূর্ণ হতে কমপক্ষে সাতজন হতে হয়। কমিশনের সভায় বসে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, গণমাধ্যমকে সে বিষয়ে জানানো হবে।’