প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন
ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২১ এএম
আপডেট : ০৩ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২১ এএম
ফাইল ফটো
দুর্নীতির জালে আটকে আছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জাতীয় সংস্থাটিকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে থেমে থাকেনি অনিয়ম ও দুর্নীতি। চিকিৎসাসহায়ক সরঞ্জাম কেনার নামে কোটি কোটি টাকার অনিয়ম-দুর্নীতি চলেছে সমানতালে। বিগত সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রী ও তার সহযোগী কর্মকর্তারা পরোক্ষে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটার পর জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভোল পাল্টে বিএনপি-জামায়াত সেজেছেন। তাদের নেতৃত্বে আগের মতোই পরিচালিত হচ্ছে এই ফাউন্ডেশন। সাবেক সরকারের মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তবে সংস্থাটির কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় দেশের অধিকাংশ প্রতিবন্ধী মৌলিক মানবাধিকার, বসবাসের যোগ্য পরিবেশ, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত। রাষ্ট্রীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ বাস্তবসম্মত ও যথেষ্ট নয়। যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তাও নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে তাদের কাছে পৌঁছে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান, পরিবহন, সার্বিক অবকাঠামো, সম্পদের ওপর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগে ঘাটতির কারণে উন্নয়নে প্রতিবন্ধীদের অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিয়মিত তদারকি ও নিরীক্ষা না হওয়ায় প্রতিবন্ধীদের সেবা প্রদান কার্যক্রমেও অনিয়ম-দুর্নীতি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী চিকিৎসাসহায়ক সরঞ্জাম ক্রয়ে অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসাসেবায় ব্যবহৃত অতি নিম্নমানের থেরাপি যন্ত্রপাতি কম দামে কিনে উচ্চ মূল্যে বিল পরিশোধ করার কাগজপত্র দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বিশেষ ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানকে সরঞ্জামগুলো সরবরাহের কাজ পাইয়ে দেওয়ার সঙ্গেও জড়িত চক্রটি। ভুক্তভোগীরা নিম্নমানের সামগ্রী পেয়ে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার কাছে প্রতিকার চেয়ে আবেদনও করেছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির উপপরিচালক এসএম জাহিদুল হাসান বলেন, ‘প্রকল্পের সব কর্মচারীকে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে যোগদান করতে বলেছি। এখানে টাকা-পয়সার কোনো বিষয় ছিল না। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’ কতদিন সংস্থাটিতে কর্মরত আছেনÑ এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে তিনি জানান, এ ধরনের প্রশ্নে তিনি বিব্রতবোধ করছেন। শিক্ষা ক্যাডারের ২২তম বিবিএসের এই কর্মকর্তা ২০১৮ সালের ৩০ জুন থেকে সংস্থাটিতে কর্মরত। তিনি সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর নিকটাত্মীয় হিসেবে সংস্থাটিতে দাপটের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছেন বলে জানা গেছে। তবে তার বক্তব্য, ১৬ বছর ধরে তিনি বঞ্চিত। যারা বিগত সরকারের দালালি করেছেন, তারাই বিএনপি-জামায়াত সেজেছেন। সাবেক উপপরিচালক এসব করেছেন।
ফাউন্ডেশনে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত ‘প্রমোশন অব সার্ভিসেস অ্যান্ড অপরচ্যুনিটিজ টু দ্য ডিজঅ্যাবল পারসন্স ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের ৩০ জুন। প্রকল্পের আওতায় মাঠপর্যায়ে ৫০টি অফিস আছে। আউটসোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে স্টাফ, গার্ড, ড্রাইভার, হেলপারসহ অন্যান্য পদে এসব অফিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এখন একটি চক্র ওই প্রকল্পের কর্মচারীদের চাকরি রাজস্ব খাতে অর্থাৎ নবগঠিত জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে আত্তীকরণে সক্রিয় হয়ে উঠছে। চক্রটি সংস্থার মূল কাঠামোতে চাকরি আত্তীকরণের টোপ দেখিয়ে কর্মচারীদের কাছ থেকে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। ফাউন্ডেশনের আওতায় দেশে ১০৩টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের জনবল ও সংস্থাটির মূল কাঠামোতে যোগ দিতে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। সংস্থাটির কিছু নন-ক্যাডার কর্মচারী নিম্নমানের থেরাপি মেশিন, হুইলচেয়ারসহ যাবতীয় কেনাকাটা সম্পন্ন করেন। ক্যাডার কর্মকর্তারা নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের সব অপকর্ম জায়েজ করেন। দরপত্র কমিটির বিরুদ্ধে একাধিক প্রতিষ্ঠান সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটে (সিপিটিইউ) অভিযোগ করে। সিপিটিইউতে করা অভিযোগ প্রমাণ হয় এবং সংস্থটি রিটেন্ডারে বাধ্য হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এক উপপরিচালক নিজের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নষ্ট যন্ত্রপাতি মেরামত করার নামে লাখ লাখ টাকার বিল হাতিয়ে নিয়েছে। ওই উপপরিচালক টেন্ডারে মালামাল কেনার জন্য নিজেই দর ও পরিমাণ ঠিক করে থাকেন। এছাড়া যে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়, সে প্রতিষ্ঠানের যোগ্যতা নির্ধারণ করে দরপত্র তৈরি করা হয়। ওই উপপরিচালকের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রলীগের ওই সভাপতির স্ত্রীর নামের প্রতিষ্ঠানকে একাধিকবার যন্ত্রপাতি সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, সংস্থাটির ওই ডিডি ‘ডিজঅ্যাবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন ফাউন্ডেশন’ নামের একটি এনজিও পরিচালনা করেন। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশ ভ্রমণও করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেবা নিতে আসা প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আবাসিক সুবিধা দিতে ২০১৯ সালে ফাউন্ডেশনের জন্য নির্মিত ১৫ তলার একটি ভবনে ২টি তলা (ফ্লোর) রাখা হয়। ভবনের পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলা বরাদ্দ করা হয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আবাসিক সুবিধা দেওয়ার জন্য। এমনকি এজন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জামও কেনা হয়। তবে এরপর পাঁচ বছর পেরোলেও এখনও সেখানে আবাসিক সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা এখানে এসে দিনের মধ্যেই সেবা নিয়ে চলে যান।
সরেজমিন ভবনটির পঞ্চম তলায় দেখা যায়, সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের থাকার জন্য ৬০টি শয্যা পড়ে আছে। তবে সেখানে কেউ নেই। আলমারি, টেবিল, চেয়ার, ফ্যানসহ অন্যান্য সরঞ্জাম অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। অন্যদিকে ষষ্ঠ তলায় গিয়ে দেখা যায়, সেটি ফাউন্ডেশনের ‘স্টোর রুম’ হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ফাউন্ডেশনটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা। ১৯৯৯ সালে এটি গঠিত হয়। ফাউন্ডেশনের সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের আবাসিক সুবিধা দিতে ২০১৯ সালে বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ৫ কোটি টাকা খরচ হয়। আবাসিক সুবিধা চালু করতে গেলে চিকিৎসক, ফিজিওথেরাপিস্ট, অফিস সহায়ক ও পিয়নের মতো জনবল দরকার। গত ২০১০ সালে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে পূর্ণাঙ্গ অধিদপ্তরে রূপ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। পরে ২০১৪ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে প্রতিবন্ধী উন্নয়ন অধিদপ্তরে রূপান্তরের ঘোষণা করে সরকার। সে সময় নামফলকও উন্মোচন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।