যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
দীপক দেব, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
প্রকাশ : ০১ নভেম্বর ২০২৪ ০০:৪৪ এএম
আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫১ এএম
কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি : সংগৃহীত
দরজায় কড়া নাড়ছে বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নির্ধারণ করতে আগামী ৫ নভেম্বর ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন সেখানকার ভোটাররা। এবারের এ নির্বাচনে একটি লক্ষণীয় দিক হলো, মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিস উভয়ের পক্ষেই শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রচারাভিযানের মাঠে সরব হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকরা। তাদের এই সরবতার পেছনে একাধিক অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সঙ্গত কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশি কমিউনিটির ভোটাররা অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি ভোটকেন্দ্রমুখী হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে বিশ্ববাসীর কাছে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এবার কি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন নাকি দ্বিতীয় মেয়াদে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসবেন অভিবাসীবিরোধী অভিধায় আখ্যায়িত ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুই প্রার্থীরই বিজয় সম্ভাবনা থাকায় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হবেন, তা সুনিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে একেবার শেষ পর্যন্ত।
কেন বাংলাদেশি কমিউনিটির কাছে এ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ‘অভিবাসন’ ইস্যুটি অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্বভাবতই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অভিবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি চায়, এমন কেউ নির্বাচিত হয়ে আসুন, যিনি অভিবাসন ইস্যুতে উদারপন্থি অবস্থান নেবেন। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সাধারণভাবে রিপাবলিকান পার্টি রক্ষণশীল ও ডেমোক্রেটিক পার্টি উদারতাবাদী হিসেবে অভিহিত। কিন্তু অভিবাসন ইস্যু বড় হয়ে ওঠায় বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক কট্টর রিপাবলিকানও কমলা হ্যারিসের দিকে হেলতে পারেন। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক ডেমোক্র্যাট সমর্থকও রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের দিকে হেলবেন। কারণ এরকম একটি দৃষ্টিভঙ্গিও রয়েছে যে, রিপাবলিকানরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন দেখা দেবে।
আবার আন্তর্জাতিকভাবে, গাজায় ইসরায়েলিদের গণহত্যা বাংলাদেশি কমিউনিটির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তারা ভীষণ ক্ষুব্ধ ও আহত এ গণহত্যায়। যুক্তরাষ্ট্রে সাম্প্রতিক সময়ে বাঙালি তরুণ-তরুণীদের যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে দেখা গেছে। ইসরায়েলকে সাহায্য ও সমর্থন করার কারণে বাংলাদেশি কমিউনিটির অনেক ভোটারই কমলা হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার ব্যাপারে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত।
এ ব্যাপারে নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশি আমেরিকান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আবু জাফর মাহমুদ প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই নির্বাচন আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের জন্যই শুধু নয়, সকল ইমিগ্র্যান্টের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২৬ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া আগাম ভোটেও এর প্রতিফলন ঘটেছে। অতীতের যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে এবার ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে ইমিগ্র্যান্ট ভোটারদের উপস্থিতিও ছিল লক্ষণীয়।’ তিনি বলেন, ‘নিউইয়র্ক শহরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী বসবাস করায় এই রাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিসের বিজয় সম্ভাবনা অনেক বেশি।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি আমেরিকান রিপাবলিকান অ্যালায়েন্স ইউএসএর চেয়ারম্যান নাসির খান পল বলেন, ‘সময় বদলেছে। একটা সময় ছিল ইমিগ্র্যান্টরা ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করত। এখন সেই অবস্থা নেই। তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকানদের বড় একটা অংশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিকে সমর্থন করে। অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে ঘোষণা ডোনাল্ড ট্রাম্প দিয়েছেন, নতুন প্রজন্ম তার সঙ্গে পুরোপুরি একমত।’ তিনি বাংলাদেশি আমেরিকান তরুণদের যুদ্ধবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গির উল্লেখ বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগের শাসনামলে পৃথিবীর কোথাও নতুন করে কোনো যুদ্ধ হয়নি। সুতরাং পুরো পৃথিবীতে যুদ্ধ বন্ধের জন্য ট্রাম্পের মতো নেতাকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চায় তারা। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি কমিয়ে অর্থনীতির চাকা সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রাম্পের কোনো বিকল্প নেই। এই কাজে ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ হয়েছেন, যা এরই মধ্যে আমেরিকার নাগরিকরা বুঝতে পেরেছেন। তাই এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি।’
নির্বাচনের নানা দিক
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, তিনিই যে শেষ পর্যন্ত জয়ী হবেনÑ এমনটার নিশ্চয়তা নেই। এর কারণ হলো, ভোটাররা সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেন না। ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ পদ্ধতিতে হয়ে থাকে এখানকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ পদ্ধতিতে ভোটারদের দেওয়া ভোটে সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হন না। জাতীয় স্তরের নির্বাচনী লড়াইয়ের বদলে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে।
এই পদ্ধতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের একটিতে একজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সবকটি ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ ভোট পেয়েছেন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ইলেক্টোরাল কলেজের মোট ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। মাইন ও নেব্রাসকা এই দুই অঙ্গরাজ্য বাদে বাকি সব রাজ্যের ইলেক্টোরাল ভোট যোগ করলে যে প্রার্থী ২৭০টি বা তারও বেশি ভোট পাবেন, তিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০টি রাজ্য রয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজ্যের ভোটাররা প্রায় সবসময় একই দলকে ভোট দেন। আবার এমন কিছু অঙ্গরাজ্য আছে, যেখানে দুই দলের প্রার্থীদেরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো এমন জায়গা যেখানে কোনো প্রার্থী এগিয়ে থাকলে, তিনিই জয়ী হবেন নির্বাচনে। এই রাজ্যগুলো দোদুল্যমান বা সুইং স্টেট হিসেবে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলও নির্ভর করছে এমন কয়েকটি সুইং স্টেটের ওপর।
কে জিততে পারেন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোয়
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ‘রিপাবলিকান দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত অঙ্গরাজ্যগুলোকে বলা হয় ‘রেড স্টেট’ বা ‘লাল রাজ্য’ আর ডেমোক্র্যাট প্রাধান্য পাওয়া স্টেটগুলোকে বলা হয় ‘ব্লু স্টেট’ বা ‘নীল রাজ্য’। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা তাদের প্রচারাভিযানে এসব অঙ্গরাজ্যের বাইরে নির্দিষ্ট কিছু ‘সুইং স্টেটের’ দিকে বিশেষ নজর দেন- যেগুলোতে ভোটাররা কোন পার্টির পক্ষে যাবে, তা নির্দিষ্ট করে বোঝা যায় না। এ বছর এমন দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যের সংখ্যা সাত। এগুলো হলো : পেনসিলভানিয়া (১৯টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), মিশিগান (১৫টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), অ্যারিজোনা (১১টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), উইসকনসিন (১০টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), নেভাডা (৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট), জর্জিয়া (১৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট) ও নর্থ ক্যারোলিনা (১৬টি ইলেক্টোরাল কলেজ ভোট)। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকেই এই সাত অঙ্গরাজ্যে গুরুত্বসহকারে প্রচার চালাতে দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারাভিযানের শেষদিকে এসে কমলা হ্যারিস ও ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভোটারদের উদ্দেশে তাদের সমাপনী বক্তব্য দিয়েছেন। এতে দুইপক্ষকে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ পর্যন্ত করতে দেখা গেছে।
অনেক বিষয়ের পাশাপাশি কমলা হ্যারিস তার সমাপনী বক্তব্যে গর্ভপাতের অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘মানুষ তাদের নিজের শরীরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মৌলিক স্বাধীনতা রাখে।’ এর আগে বক্তব্যের শুরুতেই কমলা হ্যারিস বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘আমেরিকার নারীদের গর্ভধারণ করতে বাধ্য করবেন…আপনারা প্রজেক্ট ২০২৫ গুগল করুন।’
অবশ্য ডোনাল্ড ট্রাম্প যে এ ধরনের কিছু করার পরিকল্পনা করছেন, সেরকম কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি। তবে অনেকেই মনে করছেন, এই বক্তব্যের কারণে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ভোটার কমলা হ্যারিসকে সমর্থন জানাবেন।
অন্যদিকে একই সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প পেনসিলভানিয়ার অ্যালেন্টাউনে একটি প্রচার সমাবেশে ভোটারদের কাছে জানতে চান, ‘চার বছর আগের তুলনায় আপনি কি এখন ভালো অবস্থায় আছেন?’ এরপর একে একে তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো পুনর্ব্যক্ত করেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ মূল্যস্ফীতি কমানো এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীদের ‘অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।’
দুই প্রার্থীর সমাপনী বক্তব্যের পর রাজনীতি বিশ্লেষক ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেছেন, ‘এই বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রচার চলছে ব্যক্তিগত আক্রোশ ও অপমানের মধ্য দিয়ে। দেশের উন্নয়নে গঠনমূলক কথাবার্তা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুই প্রার্থী যেন একে অপরকে দুই প্রান্তে ফেলে দিতে চেয়েছেন। অথচ তাদের বক্তব্যের মূল স্তম্ভ হওয়া উচিত ছিল গণতন্ত্র।’