বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
ফারহানা বহ্নি
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১২:০৭ পিএম
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৪ ১২:১৬ পিএম
স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিহত আকতার হোসেন। ছবি : সংগৃহীত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই নিহত হন আকলিমা বেগমের স্বামী মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আকতার হোসেন। পেশায় অটোরিকশা চালক আকতার হোসেনের দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে মানবেতর দিন পার করছেন তিনি। এর মধ্যে যা সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে, তা নিচ্ছেন আকলিমার শ্বশুর বজলুর রহমান। গত ১৫ বছরের সংসারে শ্বশুরকে কখনও দেখেননি তিনি। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পরপরই জানতে পারেন শ্বশুরের কথা। কারণ আকতারের বয়স যখন সাত, তখন তাকে ও তার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন তিনি। এখন সন্তানের মৃত্যুর পর আকলিমার কাছ থেকে কাগজপত্র নিজের দখলে রেখে যাবতীয় সহায়তা নিচ্ছেন তিনি।
আকতার ও আকলিমা দম্পতির এক ছেলে ও এক মেয়ে। বড় মেয়ে লামিয়া (১৩) ষষ্ঠ শ্রেণি ও ছেলে শাহদাত (৭) দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। মোহাম্মদপুরের মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা। এখন ভাড়ার টাকা দিতে পারবেন না বলে সেই বাসা ছেড়ে বোনের সঙ্গে উঠেছেন আকলিমা। স্বামীর মৃত্যুর পর লাশ বাড়িতে নেওয়ার জন্য প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার করে যে ৩৫ হাজার টাকা নিয়েছেন, সেই টাকাও শোধ করতে পারেননি। বর্তমানে গ্রামে থাকায় বাসাবাড়িতে কাজ করে যে আয় হতো, সেটাও বন্ধ হয়ে গছে।
আকলিমা বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুর পর বাড়িতে আসছি। এখানে থাকতে হইছে অনেক দিন। যে কাজগুলো করতাম ওইসব বাসার কাজ ছুইট্টা গেছে। ছেলে আর মেয়েরে গ্রামে রাখতাম মায়ের কাছে। তারা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবার গ্রামে আসছি।’
ছেলে শাহাদাত এখনও বাবার মৃত্যু মেনে নিতে না পেরে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রতিদিন মাকে বলে, ‘বাবাকে একটা কল দাও, বাবা মরে নাই।’ একটু পরপর বলে, ‘বাবার লাইগ্যা অস্থির লাগতেছে।’ শাহাদাত তেমন খাওয়া-দাওয়াও করে না বলে জানান মা আকলিমা আকতার।
এদিকে বাচ্চাদের পড়াশোনা আর চালাতে পারবেন না জানিয়ে আকলিমা বলেন, ‘যতদিন পারছি লেখাপড়া করাইছি। স্কুলের বই-খাতাও কিন্না দেওন লাগে। কোনো কাজ না পাইলে কেমনে বাচ্চারে মানুষ করমু। মেয়ে বলে, “মা আমার কেমন করে চলব। আমি কাজে লাইগা যাই।” আমি ভাবি আমার ছোট মেয়েরে আমি কাজে দিব। কোনো উপায় না থাকলে দেয়া লাগবই।’
আকলিমা জানান তার স্বামী আকতার হোসেনের বয়স যখন সাত বছর তখনই শ্বশুরবাড়ি থেকে তাকে ও তার মা পারুল বেগমকে বের করে দেওয়া হয়। সে সময় তার দেবর জাহিদুরের জন্ম হয়নি। অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন পারুল বেগম। বিয়ের পরে আকতারও তার বাবার সম্পর্কে আকলিমাকে তেমন কিছু জানাননি। নিজেও কখনো দেখেননি শ্বশুরকে। অথচ আকতারের মৃত্যুর পর আকলিমার কাছ থেকে কাগজপত্র নিয়ে গিয়ে যাবতীয় সহায়তা নিচ্ছেন আকতারের বাবা বজলুর রহমান। কেন তার স্বামী ও শাশুড়িকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল, সেই ঘটনা কখনও বলেননি আকলিমার শাশুড়ি কিংবা স্বামী।
স্বামীর মৃত্যু ও লাশ পাওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন আকলিমা। তিনি বলেন, ‘মোহাম্মদপুরে সেদিন আমার স্বামীর সঙ্গে আরও দুজন মারা গেছিল। একজনের মাথায় গুলি ঢুকে আরেকদিকে বের হইছে। আরেকজনের পায়ে গুলি লাগছে। আর আমার স্বামীকে পিটাইয়া তার দুই পাশে দুইটা গুলি করছে। পরে তাদেরকে পাশের এক জঙ্গলে ফেলে দিছিল। বিকাল ৩টার দিকে গুলি করছিল তারে। আমি খবর পাইছি বিকাল পাঁচটায়, বছিলার একটা গোরস্তানে তার লাশ আছে। অন্য দুজনকে পাওয়া গেছিল দুই দিন পর। ওই গোরস্তানে সেদিন তারে কবর দিতে চাইছিলাম। কিন্তু তারা রাজি হয় নাই। আমার শাশুড়ি মারা গেছে অনেক আগে। একা কী করমু বুঝতে পারি না। দেবর এ খবর জানার পর ফোন দিসিলো। সে থাকে চট্টগ্রাম। ঢাকায় আসতে পারে নাই।’
সে সময়ের কথা স্মরণ করে আকলিমা আরও বলেন, ‘উপায় না দেখে ভোলায় আমার বাড়িতে ৩৫ হাজার টাকা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে নিয়া গেছি। সেখানে নেওয়ার পর আমার শ্বশুর হাজির হন, তিনি কেমন করে খবর পাইছে, জানি না। আইসাই তিনি অ্যাম্বুলেন্স উনার বাড়ি ভোলার দক্ষিণ কালমায় নেওয়ার জন্য জোরাজুরি করলেন। পরে উনার ওইখানে দাফন হইল। কিন্তু কাফনের টাকাটা দেন নাই।’
আকলিমা বলেন, ‘আমি উনাকে চিনি না, কখনও দেখিও নাই। তারে বললাম, আপনাকে তো আমি চিনি না, আপনার ওইখানে ক্যামনে দাফন দেব। নানা কথা বলে ছেলের বাবা দাবি করায় আমি রাজি হইছি। পরে উনি আমারে মিছা কথা কইয়া আমার স্বামীর নানান কাগজপত্র নিল। আমার তো এসব কাগজপত্র নিয়া দৌড়াদৌড়ির করার কেউ নাই। কোথা থেকে কী সহায়তা দিব কিছু বুঝি না, জানতামও না। সব কাগজপত্র শ্বশুরকে দিলাম, কিন্তু এখন উনি আমাকে কোনো টাকা-পয়সা দেয় না। শুনছি উনি ৫০ হাজার টাকা এক জায়গা থেকে পাইছে, আরেক জায়গা থেকে ৪০ হাজার টাকা পাইছে। জামায়াতে ইসলামী থেকে ১ লাখ টাকা পাইছে। অথচ আমার বাচ্চা দুইটা নিয়ে আমি না খাইয়া আছি, কিন্তু আমার খবর কেউ নেয় না। শ্বশুরও আমারে কোনো টাকা দেয় না।’
আকলিমার বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলার গজাইরা বাজারে। সেখানে তার বৃদ্ধ মা আছেন। ছোট ভাই বিয়ে করে অন্যত্র থাকেন। তিনি বলেন, আমার বাবা নাই। আমি আর আমার বোন মিলে মায়েরে কিছু টাকা দিতাম। এখন আমারই তো টাকা নাই। আমার বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি বলছিল ‘আমার ছেলের বাপ নাই, আমিই মা, আমিই বাপ।’ আর এখন টাকা-পয়সার জন্য আমার বাচ্চাদের বঞ্চিত কইরা বাপ ফিরা আসলো।