ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৪ ১৫:২৫ পিএম
ফাইল ফটো
রাজনৈতিক পাস নিয়ে সচিবালয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ব্যক্তিদের অবাধ বিচরণে এবার লাগাম টানা হচ্ছে। এসব পাস নিষিদ্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সচিবালয় একটি স্পর্শকাতর এলাকা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক বিবেচনায় দলীয় ব্যক্তিদের পাস দিয়ে তদবির-বাণিজ্যের মহোৎসব তৈরি করে দিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। বিশেষ সুপারিশে দলীয় কর্মীরা এই পাসগুলো পেতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই পাস নিয়ে তদবির করাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন স্তরের হাজারখানেক দলীয় নেতার নামে এ পাস ইস্যু করা হয়। সচিবালয়ে তাদের নিয়মিত দৌড়ঝাঁপের ঠেলায় অস্থির থাকতেন মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ডেস্কের কর্মকর্তারা। অনেক সময় তদবির না শুনলে ডেস্ক পরিবর্তন হয়ে যেত আমলাদের কারও কারও। এই রাজনৈতিক তদবিরবাজরা টেন্ডার-বাণিজ্য থেকে বদলি, পদোন্নতিসহ বহু বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় ইস্যু করা পাসগুলো বাতিল বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৫০০ জনের পাস বাতিল হতে পারে। এর বাইরে আরও কারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাস নিয়েছিলেন, তাদের চিহ্নিত করার কাজও অব্যাহত রেখেছে মন্ত্রণালয়ের সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা।
সূত্র জানিয়েছে, যাদের পাস বাতিল হচ্ছে, তাদের সবাই আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্ন পদ-পদবির নেতা ছিলেন। ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিট কমিটির নেতাদের নামও রয়েছে এই তালিকায়। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও তাদের ছাত্র সংগঠনের বিভিন্ন নেতাকর্মী ঠিকাদারি ক্যাটাগরিতেও এতদিন এসব পাস নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করেছেন। জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেই এসব পাস বাতিলের পাশাপাশি এই তদবিরবাজদের চিহ্নিত করে তাদেরকে কালো তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে।
এদিকে গত পাঁচ আগস্টের পর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে সচিবালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে। সাধারণত যুগ্ম সচিব থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের পাস ইস্যু করার ক্ষমতা থাকলেও সেটা শিথিল করা হয়েছে। আগে এই কর্মকর্তারা সচিবালয়ে ঢোকার জন্য দিনে ৫টি পাস ইস্যু করতে পারতেন। কিন্তু ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সচিবালয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, তদবিরবাজ ও আগন্তুকদের উটকো প্রবেশ ঠেকাতে ওই কর্মকর্তাদের পাস ইস্যু করার সেই সুযোগ বন্ধ রাখা হয়।
কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমরা সচিবালয়ে প্রবেশে কাউকে পাস দিতে পারছি না। কী কারণে, কেন এটা বন্ধ রাখা হয়েছে জানি না। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবালয় নিরাপত্তা শাখা এককভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করছে। বর্তমানে কোনো কর্মকর্তার একান্ত পরিচিত কেউ সচিবালয়ে প্রবেশ করতে চাইলে ওই শাখাকে অনুরোধ জানানোর পর প্রাধিকার অনুযায়ী পাস মিলছে।
জননিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পাসের জন্য প্রচুর আবেদন বা অনুরোধ পাচ্ছি, কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় পাস দেওয়া হচ্ছে। অপর একজন বলেন, এই শাখাটি খুবই ঝামেলার। তাই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। দর্শনার্থী, ভুক্তভোগী, দালাল ও তদবিরবাজদের অবৈধভাবে সচিবালয়ে প্রবেশের ফলে নিরাপত্তা নিয়ে অতীতেও প্রশ্ন উঠেছে, এখনও উঠছে।
জানা যায়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিবের (সচিবালয় নিরাপত্তা) কাছে উপমন্ত্রীর পক্ষে তিনজন ব্যক্তির সচিবালয়ে পাসের অনুমতির অনুরোধ করেন। পরে জানা যায়, ওই তিন ব্যক্তি ‘অন্য উপায়ে’ সচিবালয়ে প্রবেশ করেছিলেন। এতে বিব্রত হচ্ছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা। এ পরিস্থিতিতে দালাল শ্রেণির লোকজনও প্রশ্রয় পাচ্ছে।
আরও জানা গেছে, করোনা মহামারির সময় সচিবালয়ে দর্শনার্থী প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল। কিন্তু তদবিরবাজদের তখনও আটকানো যেত না। পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা ঠিকই ভেতরে ঢুকে পড়তেন। এখনও অনেক আগন্তুক নিরাপত্তাকর্মীদের ম্যানেজ করে ভেতরে প্রবেশ করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হওয়ার পথে। ফলে তদবিরবাজরা আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। পুরোনো রাজনৈতিক পাস দেখিয়ে তারা ঠিকই তাদের দলীয় মানসিকতার কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ঢালাও পাস বন্ধ করার পরও মতলববাজদের আটকানো যাচ্ছে না। এতে নিরাপত্তা নিয়ে কিছু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন সংশ্লিষ্টরা। পরে পাস ইস্যুর নথি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া রাজনৈতিক বিবেচনায় অকাতরে পাস ইস্যু করার বিষয়টি। পরে আলোচনা করে রাজনৈতিক বিবেচনায় ইস্যুকৃত পাস বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে ঘোষণা আসতে পারে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক সরকারের অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় পাস ইস্যুর প্রথা বিলুপ্ত হওয়া জরুরি। যে কেউ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গার পাস নিয়ে তদবির, টেন্ডার ইত্যাদি বিষয়ে দেনদরবারে নেমে পড়েন। বদলি-পদোন্নতির বিষয় নিয়ে আমলাদের টেবিলের সামনে বসে থাকেন। আমলারা অসুবিধা বোধ করলেও চাকরি বা বদলির ভয়ে নীরব থাকেন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তা ইতিবাচক। তবে প্রকৃত প্রয়োজন যাদের রয়েছে, তারা যাতে পাস পেতে হয়রানির শিকার না হন, সেটিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
দায়িত্বশীল একজন পুলিশ কর্মকর্তাও সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সচিবালয়ের গেটে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের এখন কাজের চাপ কম। অবৈধভাবে প্রবেশ করে যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে তদবির নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার দিকে নজর দেওয়ার কথাও জানান তিনি।