শুভ জন্মদিন
সিরাজুল ইসলাম আবেদ
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:১৩ এএম
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ১৩:৩৩ পিএম
কবি হেলাল হাফিজ
সেলফোনের ওপার থেকে ভেসে আসে মধুর এক কণ্ঠ, ‘কেমন আছো প্রিয়’...
এই কণ্ঠস্বর অনেকবার শুনেছি। প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনে চায়ের পেয়ালায় আলতো করে ছুঁয়ে যেত ঠোঁট। অপর পাশের চেয়ারে বসা কখনও উঠতি কোনো কবিÑ হতে পারে পুরুষ, তবে বেশিরভাগ সময়ই নারী। কখনোবা আমার মতো অকেজো কেউ। টকটকে লাল চোখ টিস্যু বা রুমালে মুছতে মুছতে ধোঁয়া ওঠা কাপে যখন চুমুক দিলেন, দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করিÑ রুমালটা কোন বান্ধবী দিল, পয়সা দিয়েছিলেন তো? নাকি এবারও বিনে পয়সায় নিয়েছেন? রসিকতা বুঝে স্বভাববিরুদ্ধ হা হা শব্দে হেসে ওঠেন। দুয়েকজন কৌতূহলী হয়ে তাকান। ক্ষণিকের সেই উচ্চ তরঙ্গ দ্রুতই মিলিয়ে যায় শূন্যতায়। নিচু স্বরে কবি বলে ওঠেন, ‘আজন্ম মানুষ আমাকে পোড়াতে পোড়াতে কবি করে তুলেছে/ মানুষের কাছে এ-ও তো আমার একধরনের ঋণ।’
প্রেম, বিরহ ও দ্রোহের এক অমলিন সংগীত কবি হেলাল হাফিজ। প্রেমের অঙ্গীকার, বিচ্ছেদের বেদনা এবং সমাজের প্রতিবাদ একসুতোয় বাঁধেন তিনি। তার কবিতায় প্রেমিক হৃদয়ের আকুতি যেমন স্পষ্ট ফুটে ওঠে, তেমনি মূর্ত হয়ে ওঠে সবুজ জমিনের কোমলতায় পোড়া কাঠকয়লার গভীর যন্ত্রণার রেশ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ সমাজের প্রতি এক তরুণ বিপ্লবীর ক্ষোভ প্রকাশ করে, আর ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ পরিণত বয়সের প্রেম ও সহিষ্ণুতার সূক্ষ্ম চিত্র তুলে ধরে। হেলাল হাফিজের কবিতায় মানবিক অভিজ্ঞতার সংবেদনশীলতা, সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনবোধের সূক্ষ্মতা পাঠককে তার অনুভূতির গভীরে নিয়ে যায়। তখন তার ‘অশ্লীল সভ্যতা’র ‘নিউট্রন বোমা বোঝ/মানুষ বোঝ না’-এর মতো পঙ্ক্তিমালা কেবল কবিতা না, হয়ে ওঠে নতুন এক দর্শন।
হেলাল হাফিজ ব্যক্তি ও সমাজের মাঝে এক আন্তরিক সংযোগ স্থাপন করেন। তার কবিতায় নিপুণভাবে ফুটে ওঠে মানব অভিজ্ঞতা ও জীবনের জটিলতা। একই সঙ্গে সমাজের অসংগতি ও অসমতার বিরুদ্ধে দৃপ্ত প্রতিবাদ কবির সহজাত কণ্ঠস্বর।
বাংলা কবিতার স্রোতধারা পরিবর্তনের কালে উদিত হন হেলাল হাফিজ। তার ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ আমাদের দ্রোহ ও সংগ্রামের প্রতীক হয়ে এখনও ফেরে মানুষের মুখে মুখে। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে তার কবিতা প্রজন্মের কাছে ধরা দেয় প্রতিজ্ঞা ও প্রতিশ্রুতির শপথ হিসেবে। মানুষের মনে গভীর ক্ষতচিহ্ন এঁকে যাওয়ার দুর্বার ক্ষমতা রয়েছে তার কবিতায়। যা পাঠককে বিশ্বাস করায়, কবিতা কেবল শিল্প নয়, কবিতা বেঁচে থাকার অনুবাদ।
হেলাল হাফিজের কবিতা তার নিজের অন্তর্জগতের প্রকাশ হলেও তাতে সমাজের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। তিনি যে সমাজে বাস করেন, তা তার কবিতায় ফুটে ওঠে নিখুঁতভাবে। আমাদের অবক্ষয়, বৈষম্য ও রাজনৈতিক বাস্তবতা তিনি তুলে ধরেছেন এমনভাবে যা কেবল শিল্পীসুলভ অনুভব নয়, বরং গভীর বিশ্লেষণাত্মক সে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও। ‘যুক্তি যখন আবেগের কাছে অকাতরে পর্যুদস্ত হতে থাকে/কবি কিংবা যেকোনো আধুনিক মানুষের কাছে/সেইটে বোধ করি সবচেয়ে বেশি সংকোচ আর সংকটের সময়।’ কবির এ উচ্চারণে গভীর আবেগ ও তীক্ষ্ণ সমাজচেতনা রূঢ় সত্য হয়ে উঠে আসে।
হেলাল হাফিজের কবিতা একদিকে যেমন রাজনৈতিক প্রতিবাদ, দ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করে; অন্যদিকে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলে প্রেমের বেদনাও। তার প্রেম ক্ষণস্থায়ী আবেগ নয়, বরং জটিল অনুভূতি হিসেবে স্থিতি পেয়েছে। বেদনার সমার্থক করে সেই প্রেমকে কবি বহন করে চলেছে জীবনভর।
কবির জীবনের বড় অংশ জুড়ে রয়েছে একাকিত্ব। বহুর মাঝে থেকেও দিন শেষে তিনি নিঃসঙ্গ, একা। ‘তোমার জন্যে সকাল, দুপুর/ তোমার জন্যে সন্ধ্যা/ তোমার জন্যে সকল গোলাপ/ এবং রজনীগন্ধা।’ প্রিয়র প্রতি অর্ঘ নিবেদনের এই উচ্ছ্বাস দীর্ঘ হয় না, বরং দীর্ঘশ্বাস হয়ে ধরা দেয় যখন তিনি বলে ওঠেন, ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছো।’ একলাইনের কবিতা কবিহৃদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদীর্ণ করে পাঠকহৃদয়ও।
দীর্ঘ বিরতি নিয়ে কবিতা লেখা, জীবনের প্রতি নিরাসক্তি এবং বহু বছর নতুন কোনো গ্রন্থ প্রকাশ না করলেও স্বল্পপ্রজ কবির আবেদন তার পাঠকের কাছে একটুও কমে না। তার কালজয়ী কবিতার গভীর দাগ বয়ে চলতে হয় পাঠককে। তাইতো দ্রোহ কিংবা ভালোবাসা, বেদনা বা বিচ্ছেদ সবকিছু ছাপিয়ে হেলাল হাফিজ হয়ে ওঠেন শাশ্বত সুন্দরের কবি। তার কবিতায় শব্দের মাধুর্য পাঠককে মোহিত করে, প্রতিফলিত করে জীবনের গভীরতর ভাবনাকে, সত্যকে। স্পর্শ করে মন ও মননে। কবির কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন খুব সাবধানে বাছাই করা। হাজারো শব্দ থেকে আলতো করে তুলে নেওয়া। সংক্ষিপ্ত ও সুনির্বাচিত সেই শব্দমালায় বেদনার্ত চিত্তকে যেমন প্রকাশ করেছেন, তেমনি তুলে ধরেছেন আমাদের সামাজিক বাস্তবতাও। ইথারে ভেসে আসে কবির কণ্ঠস্বরÑ ‘আমিতো কাচের নই/তবুও চৌচির হয়ে গেছি!’ জীবন ও জগতের গল্প এমন করে আর কে বলতে পারে? একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে বেদনার গভীরতর স্তর; সমান্তরাল হাঁটে দ্রোহের আগুন। কবির সেই আখ্যান কেবল ব্যক্তিজীবনের নয়, বরং মহাকালের পানে চেয়ে সময়ের সুনিপুণ সিদ্ধান্তÑ ‘আমার হলো না তাতে কি হয়েছে?/ তোমাদের হোক।’
আজ ৭৭তম জন্মদিনে কবিকে বলতেই পারিÑ আগামীর কাছে আপনার কবিতা আপন মাধুর্যে থাকবে ‘দুধে-ভাতে’। শুভ জন্মদিন কবি।