ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ০০:৪২ এএম
ছবি : সংগৃহীত
বাজেট-১ শাখার অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নুর চৌধুরী। টানা সাড়ে ৯ বছর অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত রয়েছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ে কর্মরত থাকাকালেই ধাপে ধাপে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন অতিরিক্ত সচিব। অভ্যন্তরীণ পদায়ন, বিদেশে প্রশিক্ষণ ও প্রকল্প কর্মকর্তা নিয়োগের দায়িত্ব রয়েছে এই কর্মকর্তার অধীনে। যে কারণে মন্ত্রণালয়ের সবাই তাকে সমীহ করেন। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের আস্থাভাজন ছিলেন এই কর্মকর্তা। যে কারণে সেই সময় তার দাপট বেশি ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অনেকের জায়গা নড়ে গেলেও সিরাজুন নুর চৌধুরী রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
আরেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মানজারুল মান্নানও প্রায় সাড়ে ৯ বছর ধরে অর্থ বিভাগে রয়েছেন। সাবেক সরকারের অর্থমন্ত্রী, অর্থ সচিব ও গভর্নরের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। একসময় ছিলেন জেলা প্রশাসকও (ডিসি)। অর্থ বিভাগে পদায়নের পর তদবিরের জোরে আর কোথাও বদলি হতে হয়নি তাকে। মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তাদের আস্থাভাজন হিসেবে দাপট দেখিয়ে বেড়িয়েছেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এলেও অপরিবর্তিত রয়ে গেছে মান্নানের অবস্থান। মাত্র দুই মাসের মধ্যেই তিনি নিজেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হিসেবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এভাবে বদলি ঠেকাতেও সক্ষম হয়েছেন বলে আলোচনা রয়েছে। শুধু এই দুই কর্মকর্তা নন, ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে থাকা অতিরিক্ত সচিব বেগম নাসরিন সুলতানা, ১১ বছরের বেশি সময় থাকা দুই যুগ্ম সচিব রওনক জাহান ও তনিমা তাসনিম এখনও বহাল রয়েছেন। তারা সবাই সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ও সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। একইভাবে প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা নানারকম তদবিরের মাধ্যমে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত রয়েছেন। এই মন্ত্রণালয়ে বদলি না হওয়াই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে মিশ্র অসন্তোষ রয়েছে প্রশাসনের মধ্যে। অনেকেরই প্রশ্ন- বছরের পর বছর একটি মন্ত্রণালয়েই থাকতে হবে কেন? এই মন্ত্রণালয়ের ভেতর কী এমন মধু আছে যে, কেউ এটা ছেড়ে যেতে চান না?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগে কারিগরি বা টেকনিক্যাল অথবা তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত ইস্যু থাকলে এসবের প্রয়োজনে দুয়েকজন বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তাকে দীর্ঘদিন স্বপদে বহাল রাখা যেতে পারে। তবে ঢালাওভাবে বদলি না করাটা বাঞ্ছনীয় নয়। দীর্ঘদিন স্বপদে থাকার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার দুর্নীতির সুযোগ বাড়ে। তাই একটা সময় পরপর বদলি করা উচিত। তা না হলে ওই কর্মকর্তার কাছ থেকে নতুন পরিকল্পনা বা সার্ভিস আশা করা যায় না। পুরোনো ধ্যান-ধারণা নিয়েই তিনি একই পদে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ফলে সরকার ওই কর্মকর্তার কাছে কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
জানা গেছে, দ্রুত পদোন্নতি, যানবাহন সুবিধা ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে। যারা মন্ত্রী ও সচিব থাকেন তারা পদোন্নতি ও পদায়নে নিয়ামক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারেন। বিশেষ করে পদোন্নতির জন্য গঠিত সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড- এসএসবির অন্যতম সদস্য থাকেন অর্থ সচিব। ফলে এক্ষেত্রে সহজেই তার আনুকূল্য পেয়ে থাকেন এই মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি প্রত্যাশীরা। বিশেষ এই সুবিধাটি নিতে তাই মরিয়া হয়ে ওঠেন কর্মকর্তারা। এক কর্মস্থলেই বছরের পর বছর থাকতে সব চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এজন্য কেউ কেউ রাজনৈতিক তদবির থেকে শুরু করে আর্থিক লেনদেন করতেও দ্বিধা করেন না। বিশেষ ফায়দা থাকায় অনেকেই অর্থ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মতে, ক্ষমতা ও খুঁটির জোরে অনেক কর্মকর্তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাদের বদলি করা হলেও সেটার মানে হচ্ছে, মন্ত্রণালয়েই অভ্যন্তরীণভাবে এক উইং থেকে অন্য উইংয়ে বদলি করা। খুঁটির জোর আর তদবির বলেই তাদের বদলি স্থগিত হয় বলে জানা গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, বদলি না হওয়া এসব আমলার খুঁটির জোর কোথায়?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের কেউ কেউ প্রভাবশালী সাবেক ও বর্তমান আমলা অথবা রাজনৈতিক নেতাদের ছায়া হিসেবে কাজ করেন। এর মধ্যে দেখা যায়, কেউ সাবেক অর্থ সচিব, কেউ বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নরের আস্থাভাজন ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সুবিধাবাদী এই কর্মকর্তারাও ভোল পাল্টে অন্তর্বর্তী সরকারে সংশ্লিষ্টদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনপ্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দুই মাস হতে যাচ্ছে। তবে তারা এখনও পুরোপুরি প্রশাসনিক সংস্কার আনতে পারেনি। ফলে এখনও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার অনুগতরাই বেশিরভাগ এই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। বদলি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হলেই সতর্ক হয়ে যান পদ আঁকড়ে থাকা আমলারা। পুরোনো কৌশলেই ধরনা দিতে ছুটে যান নতুন সরকারের ঘনিষ্ঠদের কাছে।
উল্লেখ্য, নিয়মানুযায়ী সরকারি চাকরিতে সর্বোচ্চ তিন বছর একই কর্মস্থলে থাকার বিধান রয়েছে। এ সময় অতিক্রম হলে অন্যত্র বদলি করা হয়। ক্ষণ-গণনা শুরু হয় নতুন কর্মস্থলের জন্য। অথচ অর্থ বিভাগের পুরো চিত্রই ভিন্ন। এক-দুই বছর নয়; টানা এক যুগের বেশি সময়েও মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়নি এমন কর্মকর্তাও রয়েছে। ৫ বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন প্রায় অর্ধশত কর্মকর্তা। এ নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। যদিও এতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়তে দেখা যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সদ্য পদোন্নতি পেয়ে সরকারের অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন বেগম নাসরিন সুলতানা। এক-এগারো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বদলি হয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে যোগদান করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় ছিলেন এই বিভাগে। বর্তমান সরকারের আমলেও স্বপদে বহাল আছেন তিনি। এই বিভাগেই ১৭ বছর দুই মাস কর্মরত রয়েছেন। আর ৯ মাস পর তিনি অবসরে যাবেন। তাই শেষ সময়টা অর্থ বিভাগেই থেকে যেতে চালাচ্ছেন লবিং। বিভাগের অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে ১২ বছর ৭ মাস ধরে আছেন সুলেখা রাণী বসু, আবুল মনসুর রয়েছেন ১০ বছর ১ মাস, ড. মো. মতিউর রহমান ১০ বছর, বিলকিস জাহান রিমি ৯ বছর ১০ মাস, মুন্সী আবদুল আহাদ ৮ বছর ১১ মাস, হাসানুল মতিন ৮ বছর ৩ মাস, মনজুরুল হক ও নজরুল ইসলাম ৯ বছর ধরে, দিল আফরোজ, মুহাম্মদ আনিসুর রহমান ও মোহাম্মদ আনিসুজ্জামান ৮ বছর ধরে এবং ৭ বছর ধরে রয়েছেন ড. আবদুর রহিম, সৈয়দ মুহাম্মদ প্রমুখ।