বৈদেশিক সম্পর্ক
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৪ ১০:২৮ এএম
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুক্রবার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বৈঠকের আগে মালেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। ছবি : পিআইডি
সফর সংক্ষিপ্ত হলেও সম্পর্কের উষ্ণতায় এর ব্যাপ্তি অনেক বড়। গতকাল শুক্রবার চার ঘণ্টার সফরে ঢাকায় পা রাখেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। নিছক রাষ্ট্রীয় সফর নয়, এ যেন দুই বন্ধুর পুনর্মিলনের আয়োজনও। তাই ছকে বাঁধা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেই দেখা গেছে বিশেষ আন্তরিকতা ছোঁয়া কিছু মুহূর্ত। সেই সঙ্গে দেশের জন্য মিলেছে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে যেতে না পারার কারণে মালয়েশিয়ার দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাগ্যবিড়ম্বিত ১৮ হাজার শ্রমিকের সামনে আবার সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার সুসংবাদও।
বিমানবন্দরে দুপুর ২টার দিকে ড. ইউনূস ফুল দিয়ে স্বাগত জানান আনোয়ার ইব্রাহিমকে। এরপর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার। সেখানেই দুই নেতার মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত বৈঠক হয়। এ সময় ড. ইউনূস জানান, ঢাকায় তার পুরোনো বন্ধুকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুবই খুশি। শুধু তাই নয়, দুই নেতা তাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে একই গাড়িতে চড়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের ভেন্যু হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে যান।
বিমানবন্দরের বৈঠক নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, পুরোনো বন্ধু আনোয়ার ইব্রাহিমকে বাংলাদেশে স্বাগত জানাতে পেরে প্রধান উপদেষ্টা খুবই আনন্দিত। একান্ত বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেন। এ ছাড়া অভ্যুত্থানে ছাত্র-নাগরিকের আত্মদান এবং তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দেন। আলাপচারিতায় মালয়েশিয়ার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সে দেশের নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগের বিষয়গুলো তুলে ধরেন ড. ইউনূস।
সংক্ষিপ্ত এই বৈঠক শেষে দুই বন্ধু একই গাড়িতে করে বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে পৌঁছেন। সেখানে তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। এ সময় বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন দুই শীর্ষ নেতা। বৈঠক শেষে যৌথ ব্রিফিংয়ে এমন প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা। দুই শীর্ষ নেতা বৈঠকে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের নানাবিধ সমস্যার বিষয়ে কথা বলেন এবং সেগুলো সমাধানের কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন।
এ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস বলেন, মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে বৈঠকে দেশটিতে বাংলাদেশি শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা মালয়েশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। অন্যদিকে টিকিট জটিলতার কারণে মালয়েশিয়ায় যেতে না পারা ১৮ হাজার শ্রমিককে সব সহায়তা দেওয়ার কথা জানান আনোয়ার ইব্রাহিম। তিনি আরও বলেন, এ অঞ্চল শান্তিপূর্ণ রাখতে আসিয়ানকে আরও কার্যকর করতে চায় মালয়েশিয়া। এ সময় তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে নিজের আগ্রহের কথাও জানান।
যৌথ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস বলেন, দুই দেশই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্মত হয়েছি। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে। তা ছাড়া বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, প্রযুক্তিসংক্রান্ত বিষয়, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জনশক্তি রপ্তানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কর্মসংস্থান তৈরি, ভিসা সহজীকরণের বিষয়েও আলোচনা হয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি বলেন, প্রতিদিন চারশ থেকে পাঁচশ রোহিঙ্গা প্রবেশ করছেÑ এটা উদ্বেগের বিষয়। তবে এটির সমাধান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। এ সংকটে কেবল বাংলাদেশই নয়, মালয়েশিয়াও ভুক্তভোগী। এটি নিরসনে আমরা একসঙ্গে কাজ করছি।
অন্যদিকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, মানুষের মর্যাদা রক্ষায় ড. ইউনূসের ভূমিকা আমরা জানি। তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। তাই তার ওপর ভরসা রাখছি। বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন থাকবে। ড. ইউনূস বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
দুই দেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবদানের কথা তুলে ধরে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, যখন আপনারা আমাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, সাত হাজার বা তার বেশিসংখ্যক কর্মীর বিষয়টি বিবেচনার জন্য, যারা নিবন্ধন করেও রাজনৈতিক অবস্থা, এখানকার অভ্যুত্থানের কারণে যাওয়ার সুযোগ হারিয়েছে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে সেটা বিবেচনা করেছি। এই সংখ্যা ১৮ হাজার হওয়ার কথা ড. ইউনূস মনে করিয়ে দিলে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, প্রথম ধাপে সাত হাজার জনের যাওয়ার উদ্যোগ দ্রুত নেওয়া হবে। সব সন্তোষজনক হলে বাকিদেরও ক্রমান্বয়ে নেওয়া হবে। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ওই ১৮ হাজার কর্মী সব ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছে এবং যেতে না পারা তাদের দোষ নয়। সুতরাং প্রয়োজনীয় সমন্বয় ও পরিবর্তন করা আমাদের দায়িত্ব।
চলতি বছর নতুন-পুরোনো প্রবাসী কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিল মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানের টিকিট স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে ওই সময়ের মধ্যে যেতে পারেননি প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী। তাদের নেওয়ার ব্যবস্থা করতে মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছিল বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার কথা জানালেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।
মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগে সিন্ডিকেটের তৎপরতা নিয়ে এক প্রশ্নে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, এক্ষেত্রে অতীতের পদ্ধতি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগ হচ্ছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা আমাদের উদ্বেগের বিষয় নয়। আমাদের মাথাব্যথা হলো এটা নিশ্চিত করা যে, আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেটা যেন ঠিকমতো মানা হয়। আমাদের শ্রমিক দরকার এবং তাদের প্রতি যেন আধুনিক দাসের মতো আচরণ করা না হয়। সব দেশের কর্মীদের ক্ষেত্রে একই নিয়ম থাকার কথা তুলে ধরে মালয়েশিয়ার সরকারপ্রধান বলেন, তার মানে হচ্ছে, প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছ হতে হবে এবং তথাকথিত সিলেক্টেড লোকদেরও কঠোরভাবে নীতি মানতে হবে। শ্রমিকদের আবাসনের ব্যবস্থা এবং কাজের ক্ষেত্রে কোনো ব্যত্যয় কেউ ঘটালে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়ে আনোয়ার ইব্রাহিম বলেন, আমরা তাদের বাদ দিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছি এবং বাদও দিয়েছি। অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে সমালোচনা হয়, সেটা উচিত নয়। তিনি বলেন, অনুগ্রহ করে নিশ্চিত থাকুন যে, আমি নিজেও এই বাজে এবং নির্যাতনের সিস্টেমের ভুক্তভোগী। সুতরাং এটাকে চলতে দেওয়ার কিংবা কোনোভাবে উপেক্ষা করার সরকার আমরা নই।
মালেশিয়ার প্রধানমন্ত্রী এরপর বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সৌজন্য সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে চার ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে তিনি মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। এই সফরে আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে ৫৮ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা।