সংলাপে বক্তারা
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৭ পিএম
আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৭ পিএম
সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য হলেও প্রকৃত হকদারেরা তা পাচ্ছে না। এমন কি প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে মানুষকে এই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান থাকলেও অর্থের অভাবে তা করা হচ্ছে না।
বুধবার দুপুরে (২৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ডেইলি স্টার ভবনে ওয়েভ ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি: বৈষম্য ও অধিকার’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা বলেন, ‘দেশে ৩ কোটি মানুষ দরিদ্র। তাদের মধ্যে নারী দেড় কোটি। এসব নারীদের মধ্যে মাত্র ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০ জন নারীকে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হচ্ছে। দুস্থ নারীদের মধ্যে ভাতা দেওয়া হচ্ছে ১০ লাখ ৪৪ হাজার জনকে। অর্থাৎ বিপুল সংখ্যক মানুষ এই কর্মসূচির বাইরে থেকে যাচ্ছে।’
সংলাপে আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা বলেন, গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও সে অর্জনের সুফল সবার ঘরে পৌঁছায়নি। যার প্রেক্ষিত অরক্ষিত ও বঞ্চিতদের জন্য নেওয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বা সামাজিক সুরক্ষা। কিন্তু বর্তমান সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বহুবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জাতীয় বাজেটের একটি বড় অংশ এ খাতে ব্যয় হলেও কর্মসূচিসমূহের প্রকৃত প্রভাব প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম।
বক্তারা আরও বলেন, জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্র (এনএসএসএস) নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। তবে কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগীদের বাছাই প্রক্রিয়া এবং সুবিধাসমূহ বণ্টনে সুষ্ঠুতা, অনিয়ম ও বৈষম্য রয়েছে। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে বাস্তবায়নাধীন এসব কার্যক্রমের যথাযথ মনিটরিং হয় না; পাশাপাশি নির্দিষ্ট সময়ের পরে উপকারভোগীদের অবস্থার মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়নেরও তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা ব্যবস্থা নেই। ফলে সংখ্যাগত দিক থেকে কত মানুষের দারিদ্র্য অবস্থার উন্নয়ন হলো বা হলো না, তারও যথাযথ বা সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
সংলাপে বিশেষ অতিথি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব জাকারিয়া আফরোজ বলেন, ‘গত অর্থবছরে ১৬ লাখ ২২ কোটি টাকা ভাতা হিসেবে দেওয়া হয়েছে। বছরে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ২৮০ জন নারীকে মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া হচ্ছে। দুস্থ নারীদের মধ্যে ১০ লাখ ৪৪ হাজার নারীকে ভাতা দেওয়া হয়। প্রতি বছর ভাতাদারীর ১০ শতাংশ করে বাড়ানোর কথা থাকলেও অর্থের অভাবে তা করা যাচ্ছে না।’
সংবিধানের আলোকে সামাজিক বৈষম্য নিরোধ নিয়ে সম্মানীয় অতিথি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ব্যুারো অব ইকোনোমিক রিসার্চের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ বলেন, ‘সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি দরিদ্রদের দেখতে চাই। দেশে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র, তার মধ্যে নারী দেড় কোটি। এদের মধ্যে কতজনের কাছে ভাতা পৌঁছানো হয়েছে? এ অবস্থা থাকলে কাজ হবে না। দরিদ্রদের যে কর্মসূচি সেটি তাদের কাছেই জবাবদিহিতা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা এমন গণতান্ত্রিক অবস্থা সৃষ্টি করতে পারি কিনা, যেখানে গরীবরা শাসকদের টুঁটি চেপে ধরবে। এসব অর্থ ভাগ-ভাটোয়ারায় সংসদ সদস্য, স্থানীয় সরকার ও আমলাতন্ত্র জড়িত। রাজনৈতিক নেতা তাদের ভোটার সংখ্যা বাড়াতে লোকদের অন্তর্ভুক্ত করে। প্রকৃত লোকদের ভাতা দেওয়া হয় না।’
‘বাজেটে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেখানে উপজেলা পর্যায়ে এক তৃতীয়াংশ বাজেট দিতে হবে। বণ্টনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে হবে। সরকার কোথায় কতটুকু বরাদ্দ দিয়েছে তা আগেই জানিয়ে দিতে হবে,’ যোগ করেন এম এম আকাশ।
প্রকৃত উপকারভোগীদের তালিকা তৈরিতে প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আইয়ুব খান বলেন, ‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫৪টি সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। তাতে ১ কোটি ২৫ লাখ ব্যক্তিদের মধ্যে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তবে ব্যক্তি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমরা সমস্যায় পড়ছি। কে প্রকৃতপক্ষে পাবে এমন তালিকা সব সময় করা যাচ্ছে না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, ‘দারিদ্র্যের দুষ্টুচক্র থেকে বের হওয়ার চিন্তা করছি না। অতি অভিজাত পরিবারও দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত। শুধু ভাত পেলেই দারিদ্র্যবিমোচন হয়েছে এটি ঠিক না। সামাজিক সুরক্ষার আড়ালে অদক্ষতা যেন না আসে সেটি খেয়াল রাখতে হবে।’
মহসিন আলী বলেন, ‘ওয়েভ ফাউন্ডেশন টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু ন্যায্যতা, সুশাসন, অধিকার ও ন্যায্যতা- এ বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে সাফল্য এসেছে সেক্ষেত্রে আমাদের পদ্ধতিগত সংস্কার এবং তা বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। সুরক্ষা কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া, নগর এবং পার্বত্য অঞ্চলে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি, স্থানীয় সরকারের কাঠামো সংস্কার, জবাবদিহিতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের আরো কাজ করে যেতে হবে।’
সংলাপে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে— সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; প্রকৃত উপকারভোগীদের নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা; সংস্কারের ক্ষেত্রে দায় এবং দরদকে গুরুত্ব দেওয়া: সরকারি পর্যায়ে খসড়া সামাজিক সুরক্ষা কৌশলগুলোর অনুমোদন; চাহিদা বিবেচনায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো; স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসূচিসমূহ বাস্তবায়নের জন্য একটি স্বচ্ছ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ, দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা এবং সেবাগ্রহীতাদের উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনাসহ শক্তিশালী মনিটরিং ও মূল্যায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত করা।