দীপক দেব
প্রকাশ : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:১৬ এএম
আপডেট : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:৩৭ এএম
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে আজ ২৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এই দ্বিপাক্ষিক বৈঠককে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। দুই দেশের শীর্ষ নেতার এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের মাত্রা এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে বলেও কূটনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সবচেয়ে শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এই বৈঠকের বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে। বৈঠকে শুধু বাংলাদেশের আগামী দিনের সংস্কার এবং এর জন্য অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ পাবে না, পাশাপাশি ভূরাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতিও এক্ষেত্রে গুরুত্ব পেতে পারে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র বলছে, স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলতে গেলে এবারের জাতিসংঘ অধিবেশনের এই সফরে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট। এজন্য পূর্বনির্ধারিত সময়ের এক দিন আগেই প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে যাত্রা করেছেন। সোমবার ভোরে কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে রওনা হন তিনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম বিদেশ সফর।
ঢাকা এবং জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে অধিবেশনের ফাঁকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সব ঠিক থাকলে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় ২৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই শীর্ষ নেতা বৈঠকে বসবেন। বাংলাদেশের পক্ষে ড. ইউনূসের সঙ্গে থাকবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। গত বৃহস্পতিবার বিকালে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সাধারণত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে নিউইয়র্কে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন না। এ ধরনের বৈঠকগুলো হয়ে থাকে ওয়াশিংটনে। বহুল আলোচিত এই বৈঠকে সংস্কার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক এম হুমায়ূন কবির প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমার জানামতে ১৯৮৪ সালে এরশাদের (তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) আমলে হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হতে যাচ্ছে, নিঃসন্দেহে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকারের অনেক বিষয়ে সমর্থন দরকার। এ ছাড়া সরকার যে সংস্কার করতে চাচ্ছে তার জন্য কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত সহযোগিতারও দরকার হবে। এই বিষয়গুলো নিশ্চয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সামনে তুলে ধরা হবে। উনি (জো বাইডেন) যদি বিষয়গুলো উপলদ্ধি করে তাতে সহযোগিতার আশ্বাস দেন, তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য সবদিক থেকেই সহজ হয়ে যাবে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এক ধরনের আঞ্চলিক চাপও রয়েছে, সেটা সমাধানেও এই বৈঠক কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যদি এই সরকারের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কাজ করে তাহলে ইইউ, কানাডা, জাপানের পাশাপাশি বিশ্বের অন্যান্য দেশও বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হবে। সেই বিবেচনায় এই বৈঠক ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘এই বৈঠকের বার্তা হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয় দুই দেশ। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর জন্য এটি একটি সুযোগ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রেক্ষাপট এবং সরকার গৃহীত বিভিন্ন খাতে সংস্কার পদক্ষেপগুলো নিয়েও আলোচনা করতে পারবেন প্রধান উপদেষ্টা।’ তিনি বলেন, ‘মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের একটি প্রতিনিধিদল ইতোমধ্যে ঢাকা সফর করেছে। বিভিন্ন খাতে সংস্কার নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মার্কিন দলের বৈঠক হয়েছে। ভবিষ্যৎ সহযোগিতা আরও বেগবান করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সম্ভাব্য এই বৈঠকটি ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়।’
অপর এক কূটনৈতিক সূত্রে জানায়, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইন্দো-প্যাসিফিকের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থাকার কারণে দুই নেতার এই বৈঠকে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনাও হবে। সেখানে স্বাভাবিকভাবে ভারত প্রসঙ্গও উঠে আসবে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক। এজন্য বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ভালো সম্পর্কের বিষয়টিকে যুক্তরাষ্ট্রও গুরুত্বসহকারে দেখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ২১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনা হওয়ার প্রসঙ্গটিকেও সূত্রটি উল্লেখ করে। এর আগে ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও প্রধানমন্ত্রী মোদি বাংলাদেশে চলমান ঘটনা নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন বলেও ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়।
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, প্রথম বিদেশ সফরে জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন। নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী ডিক স্কফ, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিনকেন, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও ইউএসএআইডির প্রশাসকের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হবে।
জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন সূত্রে জানা গেছে, জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় জাতিসংঘের একটি মিলনায়তনে ‘জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি’ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে বিশ্বনেতাদের স্বাগত জানাবেন ড. ইউনূস। গত ৫ দশকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে এবং বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অবদানের প্রসঙ্গসহ সামনের দিনগুলোতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোরও আহ্বান জানাবেন প্রধান উপদেষ্টা। ২৭ সেপ্টেম্বর ৭৯তম জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার পর ওইদিনই ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি।