সুজন কৈরী
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:২৪ পিএম
রাজধানীর সড়কে ভেঙে পড়া ট্রাফিক ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এবং যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী, আধুনিক পদ্ধতিতে গড়ে তোলা হবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৩৪০টি সিগন্যাল, নতুন করে বসানো হবে ২৫০টি ট্রাফিক বক্স। একই সঙ্গে ট্রাফিক কারিগরি ইউনিটের ৩৯টি পদে ৬ হাজার জনবল নিয়োগসহ লজিস্টিক সাপোর্ট এবং যুগোপযোগী আইন ও বিধিমালা তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ বিভাগ।
উল্লেখ্য, কোটা সংস্কার আন্দোলন ও ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সময় সারা দেশের থানাসহ ট্রাফিক পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে ডিএমপির ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হয়। আত্মগোপনে চলে যান পুলিশের অনেক কর্মকর্তা। ফলে ভেঙে পড়ে রাজধানীর সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এমন প্রেক্ষাটে বেশ কয়েক দিন বিভিন্ন সড়কে শিক্ষার্থীরাই নিয়ন্ত্রণ করেন ট্রাফিক। পরে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও এখনও জনবল, গাড়িসহ নানা সংকটে কাজ করতে বেগ পেতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশকে।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সহযোগিতা
ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় মূলত অপারেশনাল ভূমিকা পালন করে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। কিন্তু ট্রাফিক অবকাঠামো, ট্রাফিক বিভাগের প্রকৌশলগত বিষয়, রাস্তায় চলাচলরত সকল যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস, রুট পারমিট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পার্কিং নীতিমালা, গাড়ির ধারণক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষণ ইত্যাদি দায়িত্ব পালন করে মূলত বিআরটিএ। এ ছাড়া ফুটপাথ, পার্কিং নীতিমালা, বায়ুদূষণ, বাস-বে, বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন, সরকারি ডাম্পিং স্টেশন, ট্রাফিক সিগন্যাল ও পথচারীদের নিরাপদ পারাপার, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করিডোর ব্যবস্থাপনাসহ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার প্রায় সকল বিষয়ই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, সেতু বিভাগ, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ব্যবস্থাপনা করে থাকে। ফলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে তাদের সহযোগিতা নিয়েই ট্রাফিককে ঢেলে সাজানোর এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়ন করা হবে।
সূত্রমতে, ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও ডিজিটাল সিগন্যাল ব্যবস্থাপনার জন্য কয়েক দশক ধরে বারবার হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হলেও বাস্তবে তা পূর্ণতা পায়নি। নানা সীমাবদ্ধতার পরও ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগই অধিকাংশ ট্রাফিক মোড়ে হাতের ইশারায় নগরবাসীকে ট্রাফিকসেবা দিয়ে আসছে। অথচ ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে সরকারের ১১-১২টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যদিও সবাই ট্রাফিক বিভাগের ওপরই দায় চাপিয়ে থাকে। কিন্তু সূত্র জানাচ্ছে, ট্রাফিক বিভাগের উন্নয়নে ও আধুনিকায়নে বিশেষ করে ঢাকা মহানগরীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
রিফ্লেক্ট ট্রাফিক ক্যানোপি নেই কোথাও
ঢাকায় অতি গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ ট্রাফিক ইন্টারসেকশন রয়েছে ৩৪০টি। এই ট্রাফিক ইন্টারসেকশনের ব্যবস্থাপনা ও গতিশীল ট্রাফিক ধারাবাহিকতার জন্য পুলিশ সদস্যদের রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান ও বৈরী আবহাওয়া থেকে রক্ষা করতে রিফ্লেক্ট ট্রাফিক ক্যানোপি স্থাপন করা প্রয়োজন। যা এখন কোথাও নেই। এসব সমস্যাকে মাথায় রেখেই সম্প্রতি ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ পুলিশ সদর দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা মহানগরীর সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য আধুনিক ডিএআরসি সফটওয়্যারের মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করেছে। যার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা জরুরি।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তাদের গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীর জন্য প্রায় ২৫০টি বিভিন্ন ক্যাটাগরির ট্রাফিক অফিস, ট্রাফিক বক্স, ট্রাফিক ইনফরমেশন ও সার্ভিস সেন্টার, ট্রাফিক এডুকেশন সেন্টার এবং ট্রাফিক ট্রেনিং পার্ক স্থাপন অতি জরুরি। ডিএমপি ট্রাফিক কারিগরি ইউনিটির জন্য মোট ৩৯টি পদ রয়েছে। এসব পদে অতিদ্রুত নিয়োগ দেওয়াসহ আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য ৬ হাজার ট্রাফিক জনবল সংস্থাপন, লজিস্টিক সাপোর্ট, আধুনিক ট্রাফিক কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করতে হবে। টেকসই ও আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ধরে রাখতে অবশ্যই ‘ডিএমপি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও সড়ক নিরাপত্তা গবেষণা কেন্দ্র’ গড়ে তুলতে হবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় এসব বিষয়ও সংযুক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার বেশ ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিক উন্নয়নে বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এখন সেগুলোরই বাস্তবায়নে কাজ চলছে।’
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বর্তমানে সড়কে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে কাজ করতে হচ্ছে। এতে মূল কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এরপরও ট্রাফিক সদস্যরা সাধ্যমতো যান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছে।’ তিনি নগরবাসীকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ে মূল সড়কে চলাচল না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, মেগাসিটি ঢাকার প্রায় দুই কোটি মানুষের জন্য ট্রাফিক পুলিশ সদস্য রয়েছে প্রায় ৪ হাজার। রাজধানীর ৩৩৯টি পয়েন্টে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য দিন-রাত কঠোর পরিশ্রম করছেন ট্রাফিক বিভাগের সদস্যরা। ফলে ট্রাফিক বিভাগকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজন সময়ের দাবি।