প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৩৩ পিএম
আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২২:৪০ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
গতকাল শনিবার থেকে সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগ ছাড়া দেশের অন্যান্য বিভাগে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। লাগাতার ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে জনজীবনে দেখা দেয় দারুণ ভোগান্তি। আজ রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে বৃষ্টিতে বিপাকে পড়েন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতাসহ তলিয়ে গেছে ফসলের ক্ষেত ও কয়েকশ মাছের ঘের।
তবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আগামীকাল সোমবার বিকাল থেকে দেশের সব বিভাগেই বৃষ্টির মাত্রা কমতে পারে। তার পরের দিন মঙ্গলবারও বৃষ্টির সম্ভাবনা কম। এদিকে আজ রবিবার দেশের ৬ বিভাগে ২ হাজার ৮৯৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৬২১, রাজশাহীতে ১২১, রংপুরে ৮৪, চট্টগ্রামে ৭৮০, খুলনায় ৫৬৫ ও বরিশাল ৭২৩ মিলিমিটার।
রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে জানানো হয়েছে, আগামীকাল রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অধিকাংশ জায়গায়; রংপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা, ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেইসেঙ্গ কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, স্থল গভীর নিম্নচাপটি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তার কাছাকাছি এলাকায় অবস্থান করছে। এটি আরো উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে পারে।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্ককীরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের উপকূলীয় জোয়ার ভাটার নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ ও তার কাছাকাছি এলাকায় একটি স্থল নিম্নচাপ অবস্থান করায় উপকূল ও মধ্যাঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের নদীগুলোর পানি বাড়তে পারে।
কক্সবাজারে কমছে পানি, স্পষ্ট হচ্ছে ক্ষত
বৃষ্টিপাত কমে আসায় কক্সবাজারে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। বন্যার পানি সরে যাওয়ার সঙ্গে গ্রামীণ সড়কসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত ক্ষত ভেসে উঠতে শুরু করেছে। কক্সবাজার সদর, রামু, উখিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী ও চকরিয়া উপজেলার গ্রামীণ সড়কের বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকায় খাবার সুপেয় পানি সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
রবিবার সরেজমিনে শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পানি অনেকটা নেমে গেছে। সেই সঙ্গে স্পষ্ট হয়েছে সড়কের ক্ষত। স্থানীয়রা বলছেন নলকূপের পানি লবনাক্ত হওয়ায় খাবার পানির সংকট তৈরি হয়েছে। এছাড়াও চকরিয়া, পেকুয়া, রামু, মহেশখালী ও উখিয়া উপজেলার প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নেমে গিয়েছে। তবে এসব এলাকায় বন্ধ রয়েছে বিদুৎ সংযোগ।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বিভীষণ কান্তি দাশ বলেন, পানি নেমে যাচ্ছে। তবে ক্ষত ক্ষতির চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের কাজ চলছে।
এদিকে রবিবার কক্সবাজার শহরের পশ্চিম কুতুবদিয়া পাড়া সমুদ্র উপকূলে এই মরদেহটি ভেসে আসে বলে জানিয়েছেন সি সেইফ লাইফগার্ডের সিনিয়র লাইফগার্ড মোহাম্মদ ওসমান।
ভারী বৃষ্টিতে প্লাবিত খুলনা, জনদুর্ভোগ
খুলনায় টানা দুইদিনের ভারী বর্ষণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট, বসতবাড়িসহ নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের ও পুকুর। বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় বিপাকে পড়েছেন শ্রমজীবী, স্কুল-কলেজগামী শিক্ষাথীরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পানি উঠে যাওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম সচল রাখা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গতকাল সকাল থেকে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বিকেলে সরজমিনে দেখা যায়, নগরীর খালিশপুর, মুজগুন্নি মহাসড়ক, বাস্তহারা কলোনি, রায়েরমহল, কেডিএ এভিনিউ, সাতরাস্তা, বাইতিপাড়া, মৌলভীপাড়া টিভি বাউন্ডারী রোড, শিপইর্য়াড, বারনগাতী, সোনাডাঙ্গা,ফুলবাড়ি গেইট, তেলিগাতী, শিরোমনিসহ বেশকিছু নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু কোন ব্যবস্থা না থাকা, ড্রেনগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি সরতে না পারায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
রাজবাড়ীতে ভারী বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত
রাজবাড়ীতে টানা ভারি বর্ষণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বর্ষণের ফলে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। পানি জমে সবজি ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
বৈরী আবহাওয়ার কারণে পদ্মা-যমুনা নদী উত্তাল থাকায় গতকাল শনিবার সকাল থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ। তবে স্বাভাবিক রয়েছে ফেরি চলাচল।
লঞ্চ ঘাটের ট্রাফিক সাব ইন্সপেক্টর শিমুল ইসলাম বলেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দুর্ঘটনা এড়াতে শনিবার সকাল থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে লঞ্চ চলাচল শুরু হবে।
রেকর্ড বৃষ্টিতে পানিতে টইটুম্বুর যশোর
টানা বৃষ্টিপাতে যশোরের রাস্তাঘাট পানিতে টয়টুম্বুর পরিনত হয়েছে। অনেক নিম্নাঞ্চল পানির তলায় তলিয়ে গেছে। শহরের প্রতিটি রাস্তায় হাঁটু পানি বেধেছে। দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্নআয় ও জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ।
শহরের বেজপাড়া, টিবি ক্লিনিকপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, শংকরপুর, মিশনপাড়া, উপশহর, চাঁচড়া, কারবালা, এমএম কলেজ এলাকা, নাজির শংকরপুর, বকচর, আবরপুরসহ শহরের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। শংকরপুর, বেজপাড়া, খড়কি, কারবালা, স্টেডিয়ামপাড়ার অনেক বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে।
আবহাওয়া অফিসের তথ্য মতে, গতকাল শনিবার রাত ১২টা থেকে রবিবার বেলা ১২টা পর্যন্ত ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টিতে পানিবন্দি সাতক্ষীরার কলারোয়া
গত ৩ দিনের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরার কলারোয়ার জনজীবন বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে মাছের ঘের ও পুকুর, ফসলের ক্ষেত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও রাস্তা। ক্ষতি হয়েছে আগাম শীতকালীন সবজি চাষীদেরও।
এছাড়াও পৌরসভা ও উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির আঙিনা, রাস্তা পানিতে তলিয়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জে বৃষ্টিতে জনজীবন বিপর্যস্ত
টানা বৃষ্টিতে নারায়ণগঞ্জের জনজীবন বিপর্যস্ত। তলিয়ে গিয়েছে নগরীর অনেক এলাকার সড়ক। নগরীর চাষাড়া, দুই নং রেলগেইট, নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ ও বাস টার্মিনাল, কালীরবাজার, নিতাইগঞ্জ ঘুরে দেখা যায় টানা বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত জনজীবন। বৃষ্টির কারণে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ছিল কম। ফলে বিভিন্ন কাজে যারা বের হয়েছেন, দুর্ভোগ পোহাতে হয় তাদের। নির্মাণ শ্রমিক লোকমান মিয়া জানান, নির্ধারিত জায়গায় বসে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন, তবে কোন ঠিকাদার আসেনি। ফলে কাজে যাওয়া হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে।
মোংলায় তলিয়েছে সাতশ চিংড়ি ঘের
তিন দিনের টানা বৃষ্টিপাতে জলাবদ্ধতা মোংলা শহর ও শহরতলী জুড়ে এক ধরণের বন্যা পরিস্থিতিতে রুপ নিয়েছে।
উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় সাত শতাধিকেরও বেশি চিংড়ি ঘের। পানিতে তলিয়ে আছে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি। পৌর শহর ছাড়াও উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার লোকজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অঞ্জন বিশ্বাস বলেন, প্রাথমিক খোঁজ খবর বিভিন্ন এলাকার সাত শতাধিক চিংড়ি ঘের তলিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে এর সংখ্যা আরও হয়তো বাড়বে।
বাগেরহাট শহরজুড়ে হাটুপানি
গত ২৪ ঘণ্টায় টানা বৃষ্টিতে বাগেরহাট পৌর শহরের অধিকাংশ এলাকায় জমেছে হাটুপানি গেছে। জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্ম আয়ের মানুষ।অন্যদিকে টানা বৃষ্টিতে জেলার মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল ও কচুয়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। পানিতে অনেকের মাছের ঘের ডুবে ভেসে গেছে মাছ। বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী বলেন, পশুর নদীর পানি বিপৎসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে নদীর পানি আরও বৃদ্বির সম্ভবনা রয়েছে।
ভাণ্ডারিয়ায় থমকে গেছে জনজীবন
টানা বৃষ্টিতে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া শহরে জীবনযাত্রা স্থবির হয়ে পড়েছে। এছাড়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চল জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানে আমন ধানের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। জোয়ারে নদীতে বেড়েছে পানির উচ্চতা। এতে আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলের মানুষ।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নজরুল ইসলাম জানান, টানা বৃষ্টির ফলে জনজীবনে সমস্যা হচ্ছে। ফসলি জমি প্লাবিত হলেও ভাটার টানে পানি নেমে গেলে আমনের কোন ক্ষতি হবে না। তবে পানি জমে থাকলে আমনের ক্ষতি হবে।
মোরেলগঞ্জে ডুবেছে তিন শতাধিক মৎস্য ঘের
গত ৪ দিনের টানা ভারী বর্ষণে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পৌরসভাসহ কমপক্ষে ৪০টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ডুবে গেছে ৩ শতাধিক মৎস্য ঘের। পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে ১ হাজার হেক্টর ফসলি জমির রোপা আমন ধানের ক্ষেত। উপজেলার খাউলিয়া, মোরেলগঞ্জ সদর, বারইখালী, হোগলাবুনিয়া, বলইবুনিয়া, পঞ্চকরণ, পুটিখালী, রামচন্দ্রপুর ও তেলীগাতি ইউনিয়নের অধীকাংশ গ্রামের শত শত বসতবাড়ি পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কৃষি কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বলেন, ১৬ হাজার হেক্টর ফসলী জমির মধ্যে নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১ হাজার হেক্টরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে।
বেতাগী পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ
বরগুনার বেতাগীতে গত ৭৮ ঘণ্টায় অস্বাভাবিক বর্ষণে ঘর বন্দি হয়ে পড়েছে বাসিন্দারা। জনজীবনে নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। এতে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন ও স্বল্প আয়ের মানুষ।
উপজেলার বেতাগী পৌরসভা, বিবিচিনি, বেতাগী সদর, হোসনাবাদ, মোকামিয়া, বুড়ামজুমদার, কাজিরাবাদ ও সড়িষামুড়ি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় হাঁটুসমান কোথাও বাড়িঘরে ঢুকে পড়েছে পানি। অতিবৃষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে বিষখালী নদীতে জোয়ারে পানিবৃদ্ধি। ফলে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।