ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের মাসপূর্তি আজ
প্রবা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩০ এএম
ছবি : সংগৃহীত
আজ ৫ সেপ্টেম্বর। আজ থেকে এক মাস আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে; অবসান ঘটে তিনটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরিচালিত একাধিপত্যপূর্ণ ১৫ বছরের শাসনামলের। গণঅভ্যুত্থানের দুদিন পর ৮ আগস্ট আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ গ্রহণ করেন এবং গঠন করেন ২১ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়কও স্থান পেয়েছেন ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদে। গতকাল বুধবার উপদেষ্টা পদমর্যাদায় আরও একজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূতকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে শিক্ষার্থী-চাকরিপ্রত্যাশীরা আন্দোলন শুরু করে পহেলা জুলাই থেকে। এরপর জুলাইয়ের মাঝামাঝি এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। পরে তা পরিণত হয় সরকারের পদত্যাগের এক দফার আন্দোলনে। আন্দোলনের মধ্যে ১৬ জুলাই থেকে ৬ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে সাত শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য এসেছে সংবাদমাধ্যমে। এ সময় আহত হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির হিসাবে, ৭০ শতাংশ মৃত্যুই হয়েছে গুলিতে।
পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার শাসনামলের পতনের এই দিনটিতে ধ্রুপদি অর্থে বিপ্লব না ঘটলেও ছাত্র-জনতার এ অভ্যুত্থান অনেক বিপ্লবী উপাদানের জন্ম দিয়েছে, বিপ্লবী সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের শক্তিকে পরাজিত করেছে, ছাত্র-জনতার গণকর্তৃত্ব, বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক ও নৈতিক গণক্ষমতারও একধরনের উত্থান ঘটিয়েছে। ছাত্র-তরুণরা বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছে, পুরোনো শাসনব্যবস্থা, পুরোনো জমানা পরিবর্তনে যে জনমত তৈরি করেছে, তার মধ্যে বিপ্লবী সম্ভাবনা রয়েছে। এর ফলে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্র সংস্কারের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিল করেন। ১৯৯৬ সালে ও পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতের ওই দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেছিল। এ ছাড়াও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন, ২০০৯ বাতিল করে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার সুবিধা আর বহাল নেই।
গত ২৫ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তার সরকারের লক্ষ্য নির্ধারণ করে বলেছেন, বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র-জনতা আন্দোলেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তিনি তাদের সেই স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ।
সেই ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা খাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবিদহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।’
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সচিবদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেও এই মর্মে তাদের কাজের নির্দেশ দেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন মানবিক দেশ গড়ার যে প্রত্যয়, যে ভয়হীন চিত্ত আমাদের উপহার দিয়েছে, তার ওপর দাঁড়িয়ে বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে।’
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারসহ তার সরকারের কর্মপরিধি ও তার সরকারের মেয়াদ বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবী নেতাদের সঙ্গেও মতবিনিময় করেন।
মাসপূর্তি উপলক্ষে কর্মসূচি
সরকার পতনের মাসপূর্তির এ দিনে ‘শহীদি মার্চ’ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ সময় এ মোর্চার সমন্বয়ক সারজিস আলম জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে বৃহস্পতিবার বেলা ৩টায় কেন্দ্রীয়ভাবে ‘শহীদি মার্চ’ শুরু হয়ে নিউমার্কেট, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হবে।
সারজিস বলেন, ‘দেশ সংস্কারে যারা বুলেটের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, তাদের এখনই স্মরণ করার সময়। আমরা চাইব, পুরো বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে এই শহীদি মার্চে অংশ নেবে। আগামীকালও (আজ বৃহস্পতিবার) সারা দেশে গণজোয়ার নামবে।’
কর্মসূচির বিস্তারিত তুলে ধরে সারজিস বলেন, ‘শহীদি মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া, দেশ নিয়ে প্রত্যাশা এবং কেমন রাজনীতি চাই-এসব বিষয় ব্যানার-ফেস্টুনে তুলে ধরতে চাই। চিত্রকর্মের মাধ্যমেও অংশ নিতে পারেন।’
দলের সংবিধানকে জাতীয় সংবিধান হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল
সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কিন্তু কোনো রাজনীতি না, আওয়ামী লীগ ছিল একটা ধর্ম। ধর্মের অবয়বে বঙ্গবন্ধুকে, শেখ মুজিবকে নবী হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছিল-যে সব সময় থাকবে আনচ্যালেঞ্জড, তাকে কখনোই কোনো চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে না। আওয়ামী লীগকেও কখনও চ্যালেঞ্জ জানানো যাবে না। মনস্তাত্ত্বিকভাবে আমরা সেই বিষয়টিকে মেনেও নিয়েছিলাম। এই মেনে নেওয়ার পেছনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করেছে গণমাধ্যম থেকে শুরু করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ইনস্টিটিউশন।’
তিনি বলেন, ‘বাহাত্তরের যে সংবিধান সেটি একটি জাতীয় সংবিধানের জায়গায় হয়ে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের সংবিধান। এই আওয়ামী লীগের সংবিধানটাকে আমরা জাতীয় সংবিধান হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগের সংবিধান আমরা বাংলাদেশের সংবিধান হিসেবে ধরে নিয়েছিলাম। একটা দলের সংবিধানকে যখন একটা জাতির সংবিধান হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়, সেই জায়গাতেই প্রথম ফ্যাসিবাদের বীজটা বপন করে দেওয়া হয়।’
সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, ‘৬ সেপ্টেম্বর থেকে সবাইকে সংগঠিত করার জন্য বিভাগীয় ও জেলা শহর সফর শুরু করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আমরা জনগণের সঙ্গে কথা বলব। তারা কী চায় সেটা জানব, আমরাও কিছু পরামর্শ দেব। এরপর মানুষ যা চায় আমরা তা বাস্তবায়ন করব।’
কাউকে আইন নিজের হাতে না তোলার আহ্বান জানিয়ে সমন্বয়ক আবু বাকের বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম যে বাংলাদেশ চায় সবাইকে সেই বাংলাদেশকে স্বাগত জানাতে হবে। তাই আপনারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনকে সহায়তা করুন।’