প্রবা প্রতিবেদন
প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১২:৪৯ পিএম
আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০২৪ ১৬:১৩ পিএম
পানির তীব্রতার কারণে বাড়ি ফেরার পরিস্থিতি নেই। প্রবা ফটো
ফেনী শহরের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শফিউল আলম গত বুধবার দুপুরে মোবাইল ফোনে সর্বশেষ কথা বলেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। পরশুরামের মধ্যম ধনীকুন্ডা এলাকায় তার বাড়ি। তিনি বলেন, সন্তানদের নিয়ে প্রাণে বাঁচতে পাশের একটি দোতলা ভবনে আশ্রয় নিয়েছিল পরিবারের সদস্যরা। পানিতে নিচতলা পুরোটা ডুবে ছিল। কিন্তু তারপর থেকে আর কোনোভাবেই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। পানির তীব্রতার কারণে বাড়ি ফেরার পরিস্থিতিও নেই। শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে মালামাল নষ্ট হয়ে গেছে। ভয়ানক দুঃসময় যাচ্ছে আমাদের।
নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের সিরাজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব বাবুল মিয়া বলেন, ৬০ বছর বয়সে এবারের মতো পানি দেখিনি। চারপাশে শুধু পানি আর পানি। পানিতে বসতঘর, রান্নাঘর, বাথরুমÑ সব ডুবে গেছে। না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে আমাদের। আশ্রয়কেন্দ্রেও জায়গা নেই।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ও উজানে ভারি বৃষ্টিপাতসহ ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের দক্ষিণ ও পার্বত্য জেলাগুলোয় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। জীবন বাঁচানোর জন্য বসতঘর ও সহায়-সম্পদ ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে ছুটছে মানুষ। এ ছাড়া দেখা দিয়েছে খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বন্যায় ফসলি জমি ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি ভেসে গেছে অসংখ্য মাছের ঘের ও পুকুর। এদিকে বন্যা পরিস্থিতিতে গতকাল কুমিল্লা, কক্সবাজার ও রাঙামাটিতে শিশুসহ তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কন্ট্রোল রুম খুলেছে। বন্যায় ১২ জেলায় ৬ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া বন্যার্ত অঞ্চলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কয়েকটি জেলায় বন্যাদুর্গতদের সাহায্যে যোগ দিয়েছে কোস্ট গার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিগত ২৪ ঘণ্টায় পূর্বাঞ্চলীয় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশের অভ্যন্তরীণ অববাহিকায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার নিম্নাঞ্চলে বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে।
আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও তার কাছাকাছি উজানে ভারি বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার মনু, খোয়াই, ধলাই নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে। তা ছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল ও তার কাছাকাছি উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের প্রবণতা কমে আসতে পারে। এ সময় এ অঞ্চলের ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম জেলার মুহরী, ফেনী, গোমতী, হালদা ইত্যাদি নদীগুলোর সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে স্থিতিশীল থেকে পরবর্তী সময়ে উন্নতি হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় এসব নদীর পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের ১১৬টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৫২টি পয়েন্টে পানি বেড়েছে ও ৫৮টিতে কমেছে।
ফেনীতে প্রাণ বাঁচাতে করুণ আকুতি
স্মরণকালের বন্যার ভয়াবহ রূপ দেখছে ফেনীর পাঁচ উপজেলার বিস্তীর্ণ জনপদের তিন লাখ মানুষ। সম্পদ নয়, প্রাণ বাঁচানোই মুখ্য হয়ে উঠেছে মানুষের। ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের প্রবল চাপ ও অবিরাম বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্ট গার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিয়েছে। দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ও পানির প্রবল স্রোতে ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম। নেই বিদ্যুৎ সংযোগও। জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও দাগনভূঞার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানির নিচে।
ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ২৭টি ভাঙা অংশ দিয়ে লোকালয়ে পানি ঢুকছে। নদীর পানি বিপদসীমার ৮৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বন্যায় ভেঙে যাওয়া ২৬টির সঙ্গে এবার নতুন করে আরও একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।
জেলা প্রশাসক শাহীনা আক্তার বলেন, বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্ট গার্ড, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় কতজনকে উদ্ধার করা হয়েছে বা কোন এলাকায় কেমন আক্রান্ত তার খবর পাওয়া যাচ্ছে না। কিছু এলাকায় শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
নোয়াখালীতে থমকে গেছে জীবন
ভারী বৃষ্টি এবং মুহুরী ও ফেনী নদীর পানিতে নোয়াখালীর ৮ উপজেলা প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২২ লাখের বেশি মানুষ। এদিকে গতকাল সকাল থেকে জেলায় বজ্রসহ টানা ভারী বর্ষণে বাড়তে থাকা পানিতে থমকে গেছে জীবনযাত্রা। সরেজমিনে নোয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, টানা বৃষ্টিতে নোয়াখালীতে জলাবদ্ধতার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে আরও নতুন নতুন এলাকায়। ভেসে গেছে কয়েকশ মাছের প্রজেক্ট, মুরগি খামার, আমনের বীজতলা, শাকসবজি খেত। ঝড়ো বাতাসে ভেঙে গেছে গাছপালা। বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে পড়ায় বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে কয়েকটি এলাকা। এ ছাড়া নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসাধীন।
জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে প্রতিনিয়ত নিয়ে যাচ্ছি। তাদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ট্যাবলেট ও স্যালাইন বিতরণ করা হচ্ছে। পানিবাহিত রোগে ভর্তি রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই মানবিক বিপর্যয় ঠেকাতে আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি।
লক্ষ্মীপুরে কয়েক উপজেলায় কোমরপানি, ত্রাণের জন্য হাহাকার
লক্ষ্মীপুরের কয়েকটি উপজেলায় কোমর পরিমাণ পানিতে তলিয়ে আছে। জেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৬ লাখেরও বেশি মানুষ। রায়পুর উপজেলার চরকাচিয়া, চরজালিয়া, চরখাসিয়া, চর ঘাসিয়ার, কেরোয়া, বামনি, পৌর শহরও বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব স্থানে ত্রাণের জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া রামগতি-কমলনগর উপজেলার সবকটি ইউনিয়নের কোথাও হাঁটু, কোথাও গলা পর্যন্ত আবার কোথাও কোমরপানি। ৫ হাজার ৩০০ হেক্টর মাছ চাষের জলাশয় ডুবে গিয়ে প্রায় ৮০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে জানান জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন।
জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। প্রস্তুত ১৮৯ সাইক্লোন শেল্টার। প্রশাসনের উপস্থিতি ও জনগণের সহায়তায় বিভিন্ন খালে অবৈধ বাঁধ কাটা হচ্ছে।
কুমিল্লায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হাঁটুপানি, নিহত দুই
ভারত থেকে আসা পানি ও বৃষ্টিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কিছু অংশ ডুবে গেছে। এতে প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে যানজট। বুধবার গভীর রাত থেকে পানি বাড়তে থাকলেও গতকাল যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়ে চট্টগ্রামমুখী লেনে দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের চৌদ্দগ্রাম উপজেলার নবগ্রাম রাস্তার মাথা থেকে চৌদ্দগ্রাম বাজার পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার সড়ক পানিতে ডুবে যায়। এ ছাড়া পানিবন্দি অবস্থায় দিন পার করছে বিভিন্ন উপজেলার ১০ লক্ষাধিক পরিবার।
এদিকে নাঙ্গলকোটে বন্যার পানিতে তলিয়ে কেরামত আলী (৪৫) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। গত বুধবার মধ্যরাতে তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া একই দিন বিকালে বৈদ্যুতিক পিলারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে রাফি (১৫) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকালে গোমতী নদীর পানি বিপদসীমার ৭০ সেমি ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এ ছাড়া বুড়িচং অংশের ৩০টি স্থানে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ছুঁইছুঁই করছে পানি।
আখাউড়ায় পরিস্থিতির অবনতি, বাড়ছে পানি
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বুধবার পর্যন্ত উপজেলার ৩৪টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও গতকাল নতুন করে ডুবেছে আরও কয়েকটি গ্রাম।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মনজুরুল আলম জানান, হাওড়া নদী ও জাজীর খালসহ বিভিন্ন স্থানে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। তা অতিক্রম করলে আরও নতুন করে এলাকা প্লাবিত হতে পারে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাজালা পারভীন রুহি জানান, দুর্গতদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলা প্রশাসন থেকে বরাদ্দ পেলে দুর্গতদের ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।
কক্সবাজারে প্লাবিত অর্ধশতাধিক গ্রাম, নিহত ১
একই সঙ্গে বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢলে জেলার অন্তত ৫০টির বেশি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। এ ছাড়া গতকাল রামু উপজেলার ঈদগড়ে পানিতে ডুবে রাখাইন এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে এবং গর্জনিয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের স্রোতে দুই যুবক ভেসে গেছেন বলে জানিয়েছেন রামু থানার ওসি আবু তাহের দেওয়ান।
জেলার প্রধান নদী বাঁকখালী ও মাতামুহুরীর পানি বিপদসীমার অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে রামু, উখিয়া, টেকনাফ, পেকুয়ার প্রায় সব গ্রাম। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে ব্যহৃত হচ্ছে যোগাযোগ। এ ছাড়া পানি বাড়তে থাকায় জনজীবনে দেখা দিয়েছে দুর্ভোগ। বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণ ও খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
রাঙামাটিতে পরিস্থিতির অবনতি, নিহত এক শিশু
টানা ভারী বর্ষণে রাঙামাটির বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলা ছাড়াও নতুন করে কাউখালী উপজেলার বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়ছে বিলাইছড়ির রাইংক্ষ্যং, জুরাছড়ির শলক, বাঘাইছড়ির কাচালং, লংগদুর মাইনী, নানিয়ারচরের চেঙ্গী এবং বরকলের কর্ণফুলী নদীতে। বাঘাইছড়ির ৩১ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ২০ হাজার মানুষ। উপজেলা সাজেক ইউনিয়নে বন্যার্ত দুই শতাধিক পারিবারের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে সেনাবাহিনী। এ ছাড়া জেলা শহরের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে বাস করা বাসিন্দাদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।
এদিকে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় চেঙ্গী নদীর স্রোতে ভেসে গিয়ে শ্রেষ্ঠ চাকমা নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল উপজেলার বুড়িঘাট ইউনিয়নের কুকুর মারা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
খাগড়াছড়িতে স্মরণকালের বন্যায় বিপর্যয়
টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যয়ের মুখে খাগড়াছড়িবাসী। রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে প্লাবিত হয়েছে গ্রাম থেকে শহর। গতকাল থেকে বন্যায় প্লাবিত খাগড়াছড়ি শহরের অধিকাংশ এলাকা। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছে সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া দীঘিনালা উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলও পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এদিকে পানিতে ডুবে গিয়ে গতকাল থেকে খাগড়াছড়ির সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ রাঙামটির সাজেক, লংগদু, বাঘাইছড়ি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বন্যায় কবলিত এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণ বিতরণসহ কাজ করছে সেনাবাহিনী।
জেলা প্রশাসক সহিদুজ্জামান বলেন, পৌরসভাসহ পুরো জেলায় ১০০ আশ্রয়কেন্দ্রের মানুষদের শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো ৯০ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়িতে ৩ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি
বান্দরবানে নাইক্ষ্যংছড়ি বাইশারীতে ইউনিয়নে প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বন্যায় এক হাজার পরিবারের ক্ষয়ক্ষতি ও তিনশ পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে। স্থানীয়রা জানায়, কয়েক দিন ধরে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর রাতে মুষলধারে ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বন্যা হয়েছে। রাস্তাঘাট ও খালের বেড়িবাঁধগুলো ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
মৌলভীবাজারে ঝুঁকিতে শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ
মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর গত তিন দিনের টানা ভারী বৃষ্টিতে জেলার মনু, ধলাই, কুশিয়ারা ও জুড়ী নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫ হাজার মানুষ।
এদিকে শহরের সাইফুর রহমান সড়কে অবস্থিত শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ অনেকটা ঝুঁকিতে রয়েছে। পানিপ্রবাহ বাড়তে থাকায় যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়। এ সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল।
মৌলভীবাজার পাউবির নির্বাহী প্রকৌশলী জাবেদ ইকবাল বলেন, ‘গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের সব নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ভারতে এই মুহূর্তে বৃষ্টি বন্ধ থাকায় মনু নদীর রেলওয়ে ব্রিজ এলাকা দিয়ে পানি কমতে শুরু করেছে।’
সিলেটে ফের বন্যার পদধ্বনি
সিলেটে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর টানা বর্ষণে নদ-নদীর পানি আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ইতোমধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি সবকটি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সুরমা ও অন্যান্য নদীর পানিও বিপদসীমা ছুঁইছুঁই অবস্থায় রয়েছে। এতে ফের বন্যা হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। উজানে ভারতে বৃষ্টি কমলে তবেই সিলেট বন্যার শঙ্কামুক্ত হতে পারে।
জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান বলেন, এখন পর্যন্ত সিলেটের পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক নয়। আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
হবিগঞ্জে বাড়ছে নদীর পানি, ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা
ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বেড়েই চলেছে হবিগঞ্জের নদ-নদীর পানি। জেলার খোয়াই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টেই বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। যে কারণে নদীপারের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাঁধের ভাঙন ঠেকাতে রাত জেগে কাজ করেছে তারা। এর মধ্যে গত বন্যায় শহরতলীর জালালাবাদ এলাকার বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে প্লাবিত হয়েছে জালালাবাদ, রিচি, নছরতপুর, ছোট বহুলাসহ বিভিন্ন গ্রাম। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শামীম হাসনাইন মাহমুদ জানান, বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এবং উজানের পানি নেমে আসায় নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বৃষ্টিপাত কমে এলেই পানি কমে যাবে।
পানি ঢুকছে কিশোরগঞ্জের হাওরে
টানা ভারী বৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল সিলেট হবিগঞ্জের খোয়াই নদের পানি ঢুকছে কিশোরগঞ্জের হাওরে। ফলে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে হাওর জনপদের মানুষের। এদিকে পানিবন্দি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে ইটনা মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বাসিন্দাদের।
পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী মতিউর রহমান বলেন, হবিগঞ্জসহ উজানের পানি কমতে শুরু করেছে। তাই কিশোরগঞ্জ হাওরাঞ্চলে আগামী এক-দুই দিন পানি বাড়বে। তবে হাওরে বন্যা হওয়ার কোনো পূর্বাভাস নেই।
ডুবেছে চট্টগ্রামের রাউজান
টানা বৃষ্টি, জোয়ার আর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি। প্রতিটি ইউনিয়নে স্রোতের টানে ভেসে গেছে কাঁচা-পাকা রাস্তা, মাছের পুকুর। হাঁটু থেকে কোমরপানিতে ডুবেছে হাটবাজার অভ্যন্তরীণ সব সড়ক পথ। উপজেলার উত্তরাংশের হলদিয়া, ডাবুয়া, চিকদাইর, নোয়াজিষপুর, গহিরা ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার বহু গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে।
বন্যায় ৬ জেলায় ১ লাখ ৮৯ হজার ৬৬৩ পরিবার পানিবন্দি
আকস্মিক বন্যায় দেশের ৬ জেলায় ১ লাখ ৮৯ হজার ৬৬৩টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ১৭ লাখ ৯৬ হাহার ২৪৮ জন। গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর জেলা প্রশাসককে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, সেনাবাহিনী, মেডিকেল টিম ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
১২ জেলায় ৬ লাখ ৭ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট
দেশের বন্যাকবলিত জেলাগুলোয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সকল কর্মকর্তার ছুটি বাতিল করা হয়েছে। তা ছাড়া দেশের ১২টি জেলায় বন্যার কারণে ৬ লাখ ৭ হাজার ২৪ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। গতকাল কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়েছে।
বন্যাদুর্গতদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিতের নির্দেশ
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান আকস্মিক বন্যায় বিপদগ্রস্ত জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আশ্রয়শিবিরে প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ প্রশমনে কোনো অবহেলা প্রদর্শিত হলে বা কোনো কর্মকর্তার বিষয়ে অভিযোগ হলে তদন্ত সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮ নির্দেশনা
দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক কন্ট্রোল রুম চালুসহ আটটি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানের পাঠানো বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।