ফসিহ উদ্দীন মাহতাব
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪ ১০:১৫ এএম
জেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসক আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি। তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ কমিটির সভায় কমিটিভুক্ত সকল সদস্যেরই উপস্থিত থাকার কথা। কিন্তু অধিকাংশ জেলাতেই কমিটির সভা আহ্বান করা হলে জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) উপস্থিত হন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে সভা অনেকাংশেই ফলপ্রসূ হয় না। এ অভিযোগ অতীতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও উত্থাপন করা হয়েছে। এরপরও সরকার তা আমলে নেয়নি।
এ কারণে জেলা প্রশাসক কমিটির প্রধান হয়েও জেলার আইনশৃঙ্খলা সম্পর্কে অনেক ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ অবগত থাকতে পারেন না। অথচ জেলার সকল উন্নয়ন-অগ্রগতিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসংক্রান্ত প্রতিবেদন বিভাগীয় কমিশনারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে উপস্থাপন করতে হয়। প্রতিটি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনেই ডিসিরা তাই সংক্ষিপ্ত বিচারসহ ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) কয়েকটি ধারার ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তারা এ-ও জানিয়ে আসছেন যে, অতীতে জেলা প্রশাসকরা পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন (এসিআর) লিখতেন। যে কারণে জবাবদিহি থাকত। তাই এসিআর লেখার ক্ষমতা ডিসিদের ফিরিয়ে দেওয়া দরকার। অন্যদিকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতেও সমস্যা হচ্ছে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে এসব সংস্কারসহ করণীয় আরও কিছু বিষয় সম্পর্কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। বিভিন্ন সূত্র জানাচ্ছে, রাজনৈতিক পালাবদলের পর পুলিশকে আরও জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে। কারণ বিশেষত এক দশক ধরে পুলিশের ক্ষমতার ব্যাপক অপব্যবহার ঘটেছে। ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। রাজনৈতিকভাবে পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাই পুলিশকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে হবে। এ লক্ষ্যে অতীতের মতো জেলা প্রশাসকদের পুলিশ সুপারের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া যায় কি না, বর্তমান সরকারকে তা বিবেচনায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়ে আসছে। জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হয়েও জেলা প্রশাসক কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। জবাবদিহি না থাকায় কমিটির প্রধান হয়েও জেলা প্রশাসক ভূমিকা রাখতে পারেন না। অথচ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ, নীতি যথাযথ প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে জেলা প্রশাসকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস দমনে মাঠপর্যায়ে মূল ভূমিকা রাখে জেলা পুলিশ। দুই পক্ষই নানা প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়ে বিভিন্ন সময় জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। গত ১৭ বছরে জবাবদিহি না থাকায় পুলিশের কিছু কর্মকর্তার বিতর্কিত ভূমিকার কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। যা গত সরকারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। যার দায়িত্ব ওই সরকারকে বহন করতে হচ্ছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রংপুর বিভাগের এক জেলা প্রশাসক প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা তাদের মতো করে কাজ করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে যেকোনো অপরাধের বিচার দ্রুত করায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু মাঠপর্যায়ে অন্য কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে এমন ক্ষমতা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না।’
প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসকের চেয়ে পুলিশ সুপার চাকরিতে সিনিয়রÑ এমন পদায়ন কখনই কোনো সরকারের সময়ে হয়নি। ২০১০ সালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে পুলিশের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকদের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কিছু গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। একটি অভিযোগ ছিলÑ ডিসি জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হলেও পুলিশ সুপাররা তাদের আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত সব আদেশ মানেন না। অনেক ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নেতৃত্বেই চলে মাদকের ব্যবসা। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে ডিসিরা যাতে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন, সম্মেলনে সে ক্ষমতা ডিসিদের দেওয়ার প্রস্তাবও করা হয়। ডিসি ও কমিশনারদের পুলিশের কর্মতৎপরতার ওপর প্রতিবেদন দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে একজন সহকারী পুলিশ সুপার, দুজন পরিদর্শক, চারজন উপপরিদর্শক ও ৩০ জন কনস্টেবলের সমন্বয়ে ‘প্রশাসনিক ফোর্স’ গঠনের প্রস্তাব করেন ডিসিরা। ভ্রাম্যমাণ আদালতের আওতায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সংক্ষিপ্ত আদালত গঠন ও মামলা আমলে নিয়ে বিচারের ক্ষমতা দেওয়ার দাবিও করা হয় সম্মেলনে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব দাবি সমর্থন করলেও তৎকালীন সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে সবুজ সংকেত মেলেনি। বরং পুলিশের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
জেলা প্রশাসকদের এসব অভিযোগ ও প্রস্তাবে পুলিশ কর্তৃপক্ষ চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পরদিন অনেক পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ করা হয়।
তৎকালীন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ তখন বলেছিলেন, ‘পুলিশ সম্পর্কে এ রকম ঢালাও মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা অনভিপ্রেত। কারও কারও মধ্যে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার মতো অবস্থা সৃষ্টির মনোভাব থাকতে পারে। পুলিশের সবাই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতÑ এ রকম ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।’
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান বলেন, ‘কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে না তাদের সব লোক সৎ।’ থানায় করা মামলার পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৬০ শতাংশ মামলা হয় জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে। জমিজমার এই বিরোধের পেছনে আছে প্রশাসনের লোকজন। তাদের অনিয়মের কারণেই ৬০ শতাংশ মামলা হচ্ছে।’
পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের দাবি জানানো হয়। এসব অভিযোগ-পাল্টাঅভিযোগের মধ্য দিয়ে সমন্বয় ও পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে প্রজাতন্ত্রের এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অতীতের দুর্ভাগ্যজনক দ্বন্দ্বাত্মক সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়। যার রেশ এখনও চলছে।
এদিকে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। তারা মনে করছেন, এখনই সংস্কারের উপযুক্ত সময়।
কয়েকজন জেলা প্রশাসক জানান, কিছু ধারা প্রয়োগের ক্ষমতা না থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্বাহী বিভাগ (প্রশাসন) থেকে বিচার বিভাগ আলাদা করার পরও সংক্ষিপ্ত বিচারসহ ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১১টি ধারার ক্ষমতা রাখা দরকার ছিল। সিআরপিসির ১১টি ধারা সংশোধনসহ আইন ও বিচারসম্পর্কিত ২০টি বিষয়ে সমস্যা চিহ্নিত করে তা থেকে উত্তরণ করলে ভালো হয়।
উল্লেখ্য, ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর উচ্চ আদালতের রায়ে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়। এরপর সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীন বিচার বিভাগও প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে নির্বাহী বিভাগের বিচারিক ক্ষমতা অনেকাংশে কমে আসে। তবে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর আওতায় নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা এখনও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালনা, ইভটিজিং নিয়ন্ত্রণসহ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন। কিন্তু এরপরও বিচারিক ক্ষমতার প্রয়োগ নিয়ে কয়েক বছর ধরে নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে প্রকাশ্যে ভিন্নমত দেখা গেছে। নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের সব ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইছে বলে অভিযোগও করেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে তিনি আইনজীবীসহ বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মোবাইল কোর্ট আইন অবৈধ ঘোষণার ছয় মাস পর আবার বৈধ করা হয়। তবে এ নিয়ে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে চরম বিরোধ রয়েছে।