× ই-পেপার প্রচ্ছদ বাংলাদেশ রাজনীতি দেশজুড়ে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য খেলা বিনোদন মতামত চাকরি ফিচার চট্টগ্রাম ভিডিও সকল বিভাগ ছবি ভিডিও লেখক আর্কাইভ কনভার্টার

জননী সাহসিকা সুফিয়া কামালের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এখনও অনেক বাধা

প্রবা প্রতিবেদন

প্রকাশ : ২০ নভেম্বর ২০২২ ০০:০৪ এএম

কবি সুফিয়া কামাল। ছবি : সংগৃহীত

কবি সুফিয়া কামাল। ছবি : সংগৃহীত

চার দেয়ালে বন্দি নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন ‘জননী সাহসিকা’ কবি সুফিয়া কামাল। সেই সংগ্রামের সুফল পেতে এখনও বহু দূর হাঁটতে হবে বলে মনে করেন তার সহযোদ্ধারা।

সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে যে অকুতোভয় যুদ্ধ সুফিয়া কামাল শুরু করেছিলেন তা বাস্তবায়নে চলমান আইনের সঠিক প্রয়োগে গুরুত্বারোপ করেছেন নারী অধিকার আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বরা। সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গণে যে অশনিসংকেত দেখা দিয়েছে তা মোকাবিলায় কবি সুফিয়া কামালকে আদর্শ হিসেবে মেনে নিয়ে পথ চলার কথা বলেছেন অগ্রজ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা।

রবিবার (২০ নভেম্বর) নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী কবি সুফিয়া কামালের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৯৯ সালের এ দিনে তিনি মারা যান।

কবি সুফিয়া কামালের পুরো নাম সৈয়দা সুফিয়া বেগম। ১৯১১ সালের ২০ জুন তৎকালীন আসাম প্রদেশের বাকেরগঞ্জ জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়ি রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা সৈয়দ আব্দুল বারী ওকালতি ছেড়ে সুফিবাদের দিকে ঝুঁকে গেলে সুফিয়া কামাল মা সৈয়দা সাবেরা বেগমের সঙ্গে মামার বাড়িতেই বড় হন। সুফিয়া কামালের নানা খান বাহাদুর নবাব সৈয়দ মীর মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন একজন জমিদার এবং বিখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট।

যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হতো না। তার মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এই কারণে অন্দরমহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সুফিয়া কামাল বাংলা শেখেন মূলত তার মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তার বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তার।

১৯২২ সালে ১১ বছর বয়সে মামাতো ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়া হয়। নেহাল আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন তিনি।

১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিল বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার।

সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি সুফিয়া কামাল সাহিত্য রচনা শুরু করেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ত্রিশের দশকে কলকাতায় অবস্থানকালে বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র যেমন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র প্রমুখের দেখা পান। মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়। বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ও প্রতিজ্ঞা তার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়, যা তার জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।

সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি তার সাহিত্যচর্চা চলতে থাকে। ১৯৩৭ সালে তার গল্পের সংকলন ‘কেয়ার কাঁটা’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সাঁঝের মায়া’র মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম।

১৯৩২ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সুফিয়া কামাল কলকাতা করপোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন এবং ১৯৪২ সাল পর্যন্ত এ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এর মাঝে ১৯৩৯ সালে কামালউদ্দিন আহমেদের সাথে তার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তারপরই তিনি নামের সঙ্গে স্বামীর পদবী জুড়ে নেন। দেশবিভাগের পূর্বে কিছু কাল তিনি নারীদের জন্য প্রকাশিত সাময়িকী বেগমের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদিকা ছিলেন।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর সুফিয়া কামাল পরিবারসহ ঢাকায় চলে আসেন। ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং এতে অংশ নেওয়ার জন্য নারীদের উদ্বুদ্ধ করেন।

১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবি জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতোপূর্বে প্রদত্ত ‘তমঘা-ই-ইমতিয়াজ’ পদক বর্জন করেন।

১৯৭০ সালে কবি সুফিয়া কামাল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাসভবন সংলগ্ন গোটা ধানমন্ডি এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে ছিল, আর ঐ সময় তিনি ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে সপরিবারে নিরাপদে অবস্থান করেন ।

স্বাধীন বাংলাদেশে নারীজাগরণ আর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা রেখে গেছেন।

১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন, কারফিউ উপেক্ষা করে নীরব শোভাযাত্রা বের করেছেন।

মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।

‘সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা সুফিয়া কামাল ’

কবি সুফিয়া কামালের তেইশতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এক অকুতোভয় যোদ্ধা।’

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘সুললিত ভাষায় ও ব্যঞ্জনাময় ছন্দে তাঁর কবিতায় ফুটে উঠত সাধারণ মানুষের সুখ-দু:খ ও সমাজের সার্বিক চিত্র। তিনি নারী সমাজকে অজ্ঞানতা ও কুসংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। মহান ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার, মুক্তিযুদ্ধসহ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলনে তিনি আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তিনি ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা।’

‘বাংলার প্রতিটি আন্দোলনে ছিল তার দৃপ্ত পদচারণা’

গণতন্ত্র, সমাজ সংস্কার এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা কবি সুফিয়া কামাল স্মরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সুফিয়া কামাল ছিলেন একদিকে আবহমান বাঙালি নারীর প্রতিকৃতি, মমতাময়ী মা, অন্যদিকে বাংলার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে ছিল তার আপোষহীন এবং দৃপ্ত পদচারণা।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামসহ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তার প্রত্যক্ষ উপস্থিতি তাকে জনগণের ‘জননী সাহসিকা’উপাধিতে অভিষিক্ত করেছে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল যে আদর্শ ও দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’

পঁচাত্তরে ১৫ আগস্টের পর কবি সুফিয়া কামালের ভূমিকার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টে নির্মমভাবে হত্যা করে যখন এদেশের ইতিহাস বিকৃতির পালা শুরু হয়, তখনও তাঁর সোচ্চার ভূমিকা বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল। আমি আশা করি, কবি বেগম সুফিয়া কামালের জীবনী চর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।’

‘আইনের সুশাসন ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোই হবে কঠিন চ্যালেঞ্জ’

কবি সুফিয়া কামাল জীবনভর নারীদের অধিকার আদায়ের সপক্ষে সোচ্চার থেকেছেন। সমাজের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে একাই উচ্চকিত হয়েছেন বহুবার। তার আজীবনের সেই সংগ্রামকে সার্থক রূপ দিতে গেলে আরও বেশি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল ও চলমান আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের কথা বললেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু।

মালেকা বানু বলেন, ‘সমাজের নারী পুরুষের ব্যবধান ঘুচাতে দেশিয়, আন্তর্জাতিক অনেক উদ্যোগ হয়তো রয়েছে; কিংবা নারী নির্যাতন বন্ধে অনেক আইন রয়েছে। কিন্তু আমাদের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কি বদলেছে বা নারীর আইনি অধিকারের প্রসঙ্গে জবাবদিহিতা কি নিশ্চিত হয়েছে? আমরা দেখি, নারীর প্রতি অন্যায় করে অপরাধীরা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ও পাচ্ছে। তাই বলি, সমাজ বহুলাংশে এগিয়ে গেলেও নারীর প্রতি সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়নি। এখানে আমাদের বহু চ্যালেঞ্জ।’

মালেকা বানু বলেন, ‘কবি সুফিয়া কামাল লড়ে গেছেন অসাম্প্রদায়িতার পক্ষে। আজ দেখুন, প্রশ্নপত্রে বা সিলেবাসে সাম্প্রদায়িকার নমুনা। সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামোতে সাম্প্রদায়িকতার নতুন করে উত্থান হয়েছে, তা কী করে রোধ করব আমরা? এখানে আবার রাজনৈতিক বহু সমীকরণের কথাও রয়েছে।এসব প্রতিকূলতা মোকাবিলা করাই হবে আমাদের চ্যালেঞ্জ। আমরা তবেই জননী সাহসিকাকে যথাযথ সম্মান দিতে পারবো।’

শেয়ার করুন-

মন্তব্য করুন

Protidiner Bangladesh

সম্পাদক : মুস্তাফিজ শফি

প্রকাশক : কাউসার আহমেদ অপু

রংধনু কর্পোরেট, ক- ২৭১ (১০ম তলা) ব্লক-সি, প্রগতি সরণি, কুড়িল (বিশ্বরোড) ঢাকা -১২২৯

যোগাযোগ

প্রধান কার্যালয়: +৮৮০৯৬১১৬৭৭৬৯৬ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (প্রিন্ট): +৮৮০১৯১১০৩০৫৫৭, +৮৮০১৯১৫৬০৮৮১২ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন (অনলাইন): +৮৮০১৭৯৯৪৪৯৫৫৯ । ই-মেইল: [email protected]

সার্কুলেশন: +৮৮০১৭১২০৩৩৭১৫ । ই-মেইল: [email protected]

বিজ্ঞাপন মূল্য তালিকা