আলাউদ্দিন আরিফ
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪ ০০:৩৪ এএম
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৪ ০৮:৩৯ এএম
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থী, চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অনেককেই ‘পুলিশ’ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপর ভুক্তভোগীর আত্মীয়স্বজন থানা, র্যাবের কার্যালয়, গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়, আদালতসহ বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করেও তাদের সন্ধান পাচ্ছেন না। আটকের বিষয়টিও স্বীকার করছে না আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচির সময় সহিংসতা শুরুর পর গত ২০ জুলাই রাত থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক ব্যক্তিকেই সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাদের কয়েকজনকে ৬-৭ দিন পর আদালতে তোলা হয়েছে। কিন্তু কারও কারও কোনো হদিসই পাওয়া যাচ্ছে না। ভিকটিমদের স্বজনরা সন্ধান চেয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলে সেখান থেকে স্বজনদেরও তুলে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন।
নিখোঁজ শিক্ষার্থীর স্বজনদেরও তুলে নিল পুলিশ
গত ২৫ জুলাই রাজধানীর ডেমরা থানার বড়ভাঙ্গায় এলাকা থেকে ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটির (ডিআইআইটি) অনার্স ১ম বর্ষের শিক্ষার্থী মাসরুর হাসানকে তুলে নেওয়া হয়। তার সন্ধান চেয়ে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করে তার পরিবার। কিন্তু সংবাদ সম্মেলনের জন্য সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে গেলে সেখান থেকে মাসরুরের পরিবারের সদস্যদের সাদা রংয়ের মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্যরা। নিখোঁজ মাসরুরের মামা জানান, মাসরুরের ভাই মেহেদী হাসান ও তার মাকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ইমরুল কায়েস জানান, গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৩টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে নিখোঁজ মাসরুর হাসানের সন্ধানে সংবাদ সম্মেলন ডাকে পরিবার। তারা নির্ধারিত সময়ে সংবাদ সম্মেলনে গেলে ডিআরইউ চত্বর থেকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ তাদের তুলে নিয়ে যায়। এ সময় সাদা পোশাকধারীদের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তিও হয়। তবে কিছুক্ষণ পর মাসরুরের পিতা আবুল হাসেমকে ছেড়ে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন পণ্ড হয়ে গেলেও সাংবাদিকদের কাছে লিখিত বক্তব্য পৌঁছে দেওয়া হয়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ‘নিখোঁজ মাসরুর হাসান এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন ফাইভ পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়। গত ২৫ জুলাই বৃহস্পতিবার ডেমরা বড়ভাঙ্গায় ফজরের নামাজের পর নিকটাত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে যায় সে। কিন্তু বাসার নিচ থেকে অজ্ঞাত কয়েক ব্যক্তি ডিবি পরিচয়ে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে মাসরুর হাসানকে নিয়ে যায়। এরপর পুলিশের কয়েক সদস্য মাসরুরের মামার বাসায়ও অভিযান চালায়। মাসরুরকে কেন বাসায় আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, এমন অভিযোগে তার মামা, মামার দুই শিশু-কিশোর সন্তান ও তার ভাতিজাকে ব্যাপক মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদ করে ডেমরা থানায় নিয়ে আটকে রাখা হয়। ওই সময় পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মাসরুরকে তারা পায়নি। যদি তাকে হাজির না করা হয়, তাহলে নাকি আটককৃতদের লাশ বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হবে। পরে মাসরুরের মামা, তার সন্তান এবং ভাতিজাকে সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে সিএমএম আদালতে পাঠানো হয়। তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ভিকটিম মাসরুরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ৬ দিনেও তাকে আদালতে হাজির করা হয়নি। আশপাশের সকল থানা, ডিবি কার্যালয়, র্যাব অফিসসহ সম্ভাব্য সকল থানায় যোগাযোগ করেও তার কোনো হদিস পাওয়া যায়নি।’
গত রবিবার সন্ধ্যায় মাসরুর হাসানের বড় ভাই মো. মুয়াজ জানান, ‘আমরা ধারণা করছি তাকে সম্ভবত ডিবি কিংবা র্যাব তুলে নিয়ে যেতে পারে। তবে আমরা বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছি না। এ অবস্থায় আমরা তার জীবন নিয়ে শঙ্কিত। পরিবারের পক্ষ থেকে মাসরুরের সন্ধান চাইছি।’
নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী আহমদ সামরান
নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আহমদ সামরান ও তার বাবা খালেদ সাইফুল্লাকে বাসা থেকে গত রবিবার সন্ধ্যায় আটক করে উত্তরা পশ্চিম থানার পুলিশ। উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কের বাসা থেকে তুলে নেওয়ার এক দিন পর গত সোমবার খালেদ সাইফুল্লাকে আদালতে চালান দিলেও পুলিশ সামরানকে আদালতে পাঠায়নি। উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ জানিয়েছে, সামরানকে ডিবি পুলিশ নিয়ে গেছে। কিন্তু ডিবি অফিসে গিয়ে সামরানের কোনো সন্ধান পাননি বলে জানিয়েছেন তার মামা নাসির। সামরানের সন্ধান না পেয়ে চরম উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে তার পরিবার।
ডা. ডোনারের সন্ধান চায় পরিবার
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকে গত ২৭ জুলাই বাসা থেকে তুলে নিয়ে গেছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। গতকাল সকালে তার স্ত্রী ডা. সৈয়দা তানজিন ওয়ারইস সিমকী জানান, ‘গত রবিবার বিকালে আমার স্বামী ডাক্তার ফরহাদ হালিম ডোনারকে কোনো ওয়ারেন্ট দেখানো ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তার করে। দুই দিন পেরিয়ে গেলেও তার বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।’ ডা. ডোনারকে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ড আবেদনসহ গতকাল সন্ধ্যায় আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
ব্যবসায়ী দবির উদ্দিন তুষার
রাজধানীর মিরপুরের বাসা থেকে গত রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় সাদা পোশাকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে আটক করা হয় ব্যবসায়ী দবির উদ্দিন তুষারকে। তার স্ত্রী জানান, তুষার বাসায় ছিলেন। একটি কালো রঙের গাড়িতে করে সাদা পোশাকধারী ডিবির একটি দল তাকে আটক করতে আসে। আমরা বাধা দিলে তারা কাফরুল থানা থেকে দুটি মোটরসাইকেলে করে আরও চারজন পুলিশ নিয়ে আসে। তুষারকে বাসা থেকে কাফরুল থানায় নেওয়া হয়। সেখান থেকে গত রবিবার বেলা ৩টার দিকে ডিবির গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তুষারের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। থানা পুলিশ তার গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারছে না। ডিবি কার্যালয়ে গেলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এই অবস্থায় চরম অনিশ্চয়তায় আছে তুষারের পরিবার।
মনোয়ার হাসান জীবন
রাজধানীর আদাবরের বাসা থেকে পুলিশ তুলে নিয়ে যাওয়ার ১০ দিনেও হদিস মিলছে না আদাবর থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনোয়ার হাসান জীবনের। গত ২১ জুলাই আদাবর ৮ নম্বর রোডের একটি বাসা থেকে জীবনসহ পাঁচজনকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পরিবারের সদস্যদের দাবি ওই দিন বেলা ৩টার দিকে বাসা ঘেরাও করে বিএনপি নেতা মনোয়ার হাসান জীবন, মেহেদীজ্জামানসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়। পরে আদাবর থানায় চারজনকে হস্তান্তর করলেও জীবনকে কে বা কারা নিয়েছে তা জানা যায়নি। পরিবারের সদস্যরা আদাবর, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও থানা এবং ডিবি কার্যালয়ে গিয়েও তার হদিস পাননি। জীবনকে আটকের পর থেকে তারা থানা পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতে গিয়ে তাকে নিয়মিত খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন, কারা তাকে আটক করেছে কিংবা তাকে এখন কোথায় রাখা হয়েছে, তা নিয়ে অবস্থান পরিষ্কার করছে না পুলিশ।
মনোয়ার হাসান জীবনের স্ত্রী সোনিয়া বেগম জানান, ২১ জুলাই আদাবর থানা পুলিশের উপস্থিতিতে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশজনের একটি দল এসে ৮ নম্বর রোডের বাড়ি থেকে তিন বিএনপি নেতাসহ ৫ জনকে তুলে নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আদাবর থানায় ছুটে যান। গিয়ে দেখেন মেহেদীজ্জামানসহ আরও তিনজন হাজতখানায় রয়েছে। কিন্তু তার স্বামী জীবন থানায় নেই। জীবনকে আটকের সময় আদাবর থানার ওসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু আদাবর থানা পুলিশ এখন তা অস্বীকার করে বলছেন, তারা আমার স্বামীকে আটক করেননি। তাহলে আমার স্বামী কোথায় গেল!’
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, জীবনকে থানা থেকে ডিবির কাছে এবং পরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
নাজিম উদ্দিন
মিন্টো রোডে কথা হয় মিরপুরের ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দিনের স্ত্রী শারমিন বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত ২৭ জুলাই সন্ধ্যায় বাসার দরজায় নক করলে আমি দরজা খুলে দিই। ওই সময় আমার স্বামী নামাজ পড়ছিলেন। সাদা পোশাকধারী কিছু লোক নিজেদের ডিবি পরিচয় দিয়ে নামাজ থেকে তাকে তুলে নিয়ে আসে। আমি বারবার চিৎকার করে জানতে চাইছিলাম, তারা সত্যিই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার লোক কি না। কিন্তু তারা আমার হাত থেকে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। তারা আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালও করে। তাদের সঙ্গে কোনো নারী পুলিশ ছিল না। আমার দুটি বাচ্চা এ অবস্থা দেখে ভয়ে বারান্দায় শুয়ে কান্নাকাটি করছিল।’
শারমিন বেগম জানান, নাজিম উদ্দীন একজন বেকারি ব্যবসায়ী। এক আত্মীয়ের বাসা ভাড়া করে সেখানে স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে থাকতেন। গত শনিবার সেই বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসার পর পুরো পরিবার স্থানীয় থানা, র্যাব অফিস, গোয়েন্দা কার্যালয় এবং আদালতে খুঁজেও তার কোনো সন্ধান পায়নি।
সোহাগ হাওলাদার
বরিশাল শহরের রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকার মুদি দোকানি সোহাগ হাওলাদার। তার বাবার নাম হেমায়েত হোসেন হাওলাদার। রাজধানীর হেলথ এইড হাসপাতালে ভর্তি স্বজনকে দেখতে এসে নিখোঁজ হয়েছেন ২৪ জুলাই দুপুরে। এরপর থেকে তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না মা বসিরুন বেগম। কারও কাছে শুনেছেন ছেলেকে ধরে এনেছে ডিবি পুলিশ। তাই মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ের সামনে ঘুরঘুর করছিলেন ছেলের জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে। বসিরুন বেগম বলেন, ‘সোহাগ রোগী দেখতে হাসপাতালে গিয়েছিল। সেখান থেকেই তাকে ধরে নেয় ডিবি। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। একজন ফোন করে জানিয়েছে ছেলে ডিবিতে আছে।’
মেসবাহ উদ্দিন সাঈদ
গত ২১ জুলাই রাতে ডিবির পোশাক পরা একদল সদস্য ধানমন্ডির বাসা থেকে ব্যবসায়ী মেসবাহ উদ্দিন সাঈদকে তুলে নেয়। যাওয়ার সময় তারা সাঈদের তিনটি গাড়ির চাবিও নিয়ে যায়। ৮ দিন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজ পায়নি পরিবারের সদস্যরা। পরে গত সোমবার তাকে সহিংসতার মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
আরিফ সোহেল
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে শনিবার দিবাগত রাত সোয়া ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী আট-নয়জনের একটি দল তুলে নিয়ে যায়। এ সময় তারা নিজেদের সিআইডি ও ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়েছিল বলে জানায় তার পরিবার। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার পর আরিফ সোহেলকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চায় পুলিশ। আদালত তার ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে।
‘এসবই মানবাধিকার লঙ্ঘন’
সাদা পোশাকে তুলে নেওয়া এবং তাদের খোঁজ না দেওয়ার বিষয়টিতে মানবাধিকার ও সাংবিধানিক অধিকারের লঙ্ঘন হচ্ছে উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আছে, কাউকে পুলিশ আটক করলে তিন ঘণ্টার মধ্যে তার অপরাধ জানাতে হবে। এই সময়ের মধ্যে ভিকটিমকে আটকের বিষয়টি তার পরিবারের সদস্য বা স্বজনদের জানাতে হবে। এ ছাড়া তার পছন্দমতো আইনজীবীর মাধ্যমে আইনি সহায়তা যেন নিতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এগুলো না করলে সাংবিধানিক আইন, সুপ্রিম কোর্টের দিকনির্দেশনা ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হবে।’